ক্ষমতা যখনঃ অমরনাথ কর্মকার ১৭/১২/২০২০
ক্ষমতা যখন অক্ষম হয়ে ক্ষমা চায়
ক্ষমতাহীনের কাছে,
তখন ক্ষমতার ঘায়ে পঙ্গু মানুষও
মেতে ওঠে উদ্দাম নাচে।
ক্ষমতার বহুমুখী পথে দাঁড়িয়ে যদি
দিকভ্রান্ত ক্ষমতাধারী
বেছে নেয় স্বার্থপরতার চোরা গলি
সেই পথে বিপদ ভারি।
ক্ষমতা যখনঃ অমরনাথ কর্মকার ১৭/১২/২০২০
ক্ষমতা যখন অক্ষম হয়ে ক্ষমা চায়
ক্ষমতাহীনের কাছে,
তখন ক্ষমতার ঘায়ে পঙ্গু মানুষও
মেতে ওঠে উদ্দাম নাচে।
ক্ষমতার বহুমুখী পথে দাঁড়িয়ে যদি
দিকভ্রান্ত ক্ষমতাধারী
বেছে নেয় স্বার্থপরতার চোরা গলি
সেই পথে বিপদ ভারি।
ইতিহাস-ঐতিহ্যে ক্যানিং : অমরনাথ কর্মকার
ক্যানিং – সুন্দরবনের
কথা উঠলেই এই জায়গাটির নাম সবার আগে উঠে আসে মুখে।কারন এই শহরটি মূলত সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার
হিসাবেই বেশি পরিচিত। কিন্তু এই শহরের যে এক বিশাল ঐতিহাসিক গুরুত্ত্ব রয়েছে সে সম্পর্কে
জানার আগ্রহ খুব কম মানুষের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। আর সেই অনাগ্রহের যুক্তিসঙ্গত কারনও
রয়েছে যথেষ্ট। কারন ক্যানিং-এর ঐতিহ্য রক্ষায় সরকার,স্থানীয় প্রসাশনের ভূমিকা সেভাবে
চোখে পড়ে না। নইলে ক্যানিং এতদিনে হয়ে উঠতে পারত ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান হিসাবে দর্শনীয়।
১৮৫৬ থেকে ১৮৬২এই সময়
কালের প্রথম দু’বছর ভারতের গভর্নর
জেনারেল এবং পরের চার বছর ভাইসরয় ছিলেন চার্লস যোহান আর্ল (লর্ড) ক্যানিং। তাঁর
আমলে গঠিত হওয়া ‘পোর্ট ক্যানিং
কোম্পানি’র
সুবাদে
মাতলা নদীর ধারে তৈরি হয় স্ট্র্যান্ড, হোটেল,কিছু বাড়ি। সুপরিণামদর্শী লর্ড ক্যানিং-এর উদ্দেশ্য ছিল
সিঙ্গাপুর বন্দরকে টেক্কা দেওয়া। কিন্তু ১৮৬৭ সাল নাগাদ নদীপথ পরিবর্তনের ফলে সে
সব ভেঙে যায়। ইতিমধ্যে ১৮৬২-তে শিয়ালদহ দক্ষিণ (তত্কালীন বেলেঘাটা স্টেশন) থেকে
ক্যানিং পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন করে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেল কোম্পানি। ১৮৮৭-তে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেল কোম্পানি
রাষ্ট্রায়ত্ত হয়। আজ ক্যানিং স্টেশন থেকে মিনিট কুড়ির হাঁটা পথে হাইস্কুল পাড়ায় যে
জীর্ন ইমারতটি লর্ড ক্যানিং-এর স্মৃতি বিজড়িত হয়ে ইতিহাসের সাক্ষ বহন করছে আসলে
সেটি ছিল ‘পোর্ট ক্যানিং
কোম্পানি’-র সদর দফতর। ১৮৭২-এ সংস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নামমাত্র টাকায়
ওই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় দু’তিনজন ওই বাড়ি ও সংলগ্ন জমি কিনে নেন। তবে তিনি এবং লেডি
ক্যানিং ওখানে গেলে যে বাড়িটিতে থাকতেন,সেটির অস্তিত্বের বেশির ভাগটাই লোপ পেয়েছে। প্রাচিন
ভবনটির অবস্থা জীর্ণ, ভবনে ঢোকার মুখে যে বিশাল লোহার গেট ছিল সেটিও উধাও। পুরু
দেওয়ালের বিভিন্ন অংশে ফাটল। বাড়ির তিন দিকে বিভিন্ন জায়গায় বটবৃক্ষ বাড়িয়ে চলেছে
এই ফাটলের মাত্রা। উঁচু স্তম্ভগুলোর ইট খসে পড়ছে। বাড়ির দু’টি তল মিলিয়ে অন্তত
পনেরোটি ঘর। কড়িকাঠের ছাদের উচ্চতা অন্তত ১৫ ফুট। ভূগর্ভেও একটি তল আছে। একসময়ে
সেটি ব্যবহৃত হত। বহুকাল ব্যবহৃত হয় না। বন্ধ করে রাখা হয়েছে একতলার বেশির ভাগ
অংশ। বাড়ির আইনি মালিকানা নিয়ে ধন্দ ও সংশয়ের
নিয়মিতকরণ আজও হয়নি। একদা ব্রিটিশ আমলে পৌরসভার কৌলিন্য মর্যাদা পেয়েছিল
ক্যানিং। পরাধীন ভারতবর্ষের তথা বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ সুন্দরবনের উন্নয়নকে
কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বন্দর। তৈরী হয়েছিল চালকল,নুনের গোলা। নানান কারনে ক্যানিং
তার পৌরসভার অস্তিত্ব হারায়।
ভৌগলিক কারণে
বিদ্যাধরী নদীর একটি শাখা বাঁক নিয়ে মিশেছিল আঠারোবাঁকি ও করাতী নদীতে। তিনটি নদীর
সংযোগস্থলে সৃষ্টি হয়েছিল পর্বল একটি ঘুর্ণী। যা কিনা পরে মাতলা নদীর জন্ম দেয়। আর
এই নদীর পাড়েই তৈরী হয় “মাতলা গঞ্জ”। বিভিন্ন সরকারি নথীতে যা “মাতলা মৌজা ”নামে উল্লেখ করা
হয়েছে। অতীতের তথ্য অনুযায়ী সে সময় মাতলা নদী এতই খরস্রোতা ছিল যে ভাটার সময় বড় বড়
জাহাজ অনায়াসেই নোঙর করতে পারতো মাতলা নদীর পাড়ে। লর্ড ডালহৌসির আমলে ক্যানিং এ
বন্দর তৈরীর কাজ শুরু হয়।
ডালহৌসির পরে গভর্ণর হয়ে আসেন
লর্ড ক্যানিং। তাঁর আমলে কলকাতার সাথে রেলপথের মাধ্যমে যুক্ত হয় মাতলা এলাকা।
অন্যদিকে নদীপথে হলদিয়ার সাথে ও যোগাযোগের কাজ শুরু হয়। লর্ড ক্যানিং এর নাম
অনুসারে “মাতলা গঞ্জ” বা “মাতলা মৌজার” নামকরণ হয় “ক্যানিং টাউন”। ১৮৬২-৬৩ সালে
সর্বপ্রথম ক্যানিং-এ রেলপথ চালু হয়। ১৯৩২ সালের ২৯ ভিসেম্বর স্যার ড্যানিয়েল
হ্যামিলটনের আমন্ত্রণে বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর যখন গোসাবায় তাঁর পল্লীউন্নয়ন
দেখতে গিয়েছিলেন, তিনি ক্যানিং পর্যন্ত গিয়েছিলেন এই রেলপথেই। ১৮৬২ সালে ক্যানিং
কে পৌরসভা করে উন্নয়নের তোড়জোড় শুরু হয়। একদা পৌর শহর হিসাবে তকমা পাওয়া ক্যানিং
আজ পঞ্চায়েত এলাকাভুক্ত। ১৯৬৭-৬৮ সালে এক মারাত্মক ঘুর্ণিঝড়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি
হয়েছিল সুন্দরবনে। ফলে ক্যানিং বন্দরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং সব জাহাজ ক্যানিং
বন্দর ত্যাগ করে। ফলে ১৮৭২ সালে লর্ড
ক্যানিং-এর স্বপ্নের বন্দরের যবনিকাপাত হয়। সেই সূত্রেই পৌরসভার কাজ ও থমকে যায়।
বর্তমান সরকার এই শহরকে পৃথক পৌরসভার মার্যাদা দানের চেষ্টা চালালেও নানান
প্রশাসনিক জটিলতায় ক্যানিংবাসীর স্বপ্নের বাস্তবায়ন আজও সম্ভব হয়নি। লর্ড
ক্যানিং-এর ঐতিহাসিক বাড়িটি 'হেরিটেজ বিল্ডিং' হিসাবে সরকারীভাবে ঘোষিত হলেও
বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষনের সেভাবে হয় না। যার ফলে ইংরেজ
আমলের ব্যবহৃত বহু জিনিসপত্র ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে বা বিক্রি হয়ে গেছে প্রশাসনের
অজান্তেই।এছাড়াও আরও একটি ইতিহাস জড়িয়ে আছে ক্যানিংকে নিয়ে যা নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র
মাথাব্যথা নেই।রসগোল্লার পেটেন্ট নিয়ে এত সমালোচনা হয়, অথচ লেডিকেনি নামক জনপ্রিয় মিষ্টান্ন
আবিষ্কারের সঙ্গে লেডি ক্যানিং-এর (লর্ড ক্যানিং-এর স্ত্রী,লর্ড ক্যানিং-এর
স্ত্রী শার্লট লেডি ক্যানিং)যে নিবিড় সম্পর্ক আছে সে
ইতিহাস অধিকাংশেরই অজানা। জানা যায়,লেডি ক্যানিং-এর জন্মদিনের উপহার হিসাবে ভীম নাগ
এই মিষ্টি প্রস্তুত করেন যা আজও বাঙালীর রসনা
তৃপ্ত ক’রে চলেছে।
অতীত ইতিহাসের ঐতিহ্যমন্ডিত
ক্যানিং ঐতিহাসিক শহর হিসাবে জনপ্রিয় হোউক,সযত্নে রক্ষিত হোউক যাবতীয় ঐতিহাসিক স্মৃতি,
ক্যানিং শহর তাঁর হৃত গৌরব ফিরে পেয়ে উন্নত পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে
উজ্জ্বল হয়ে উঠুক এই প্রত্যাশা পূরণের স্বপ্ন সফল করার জন্য সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন
দ্রুততার সঙ্গে কাজ করুক এই আন্তরিক ইচ্ছা বোধ হয় সকল ক্যানিংবাসীরই। প্রত্যন্ত সুন্দরবনের
মানুষের কাছে ক্যানিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর। এই ক্যানিং শহরে রয়েছে ক্যানিং মহকুমা
দপ্তর, রয়েছে মহকুমা হাসপাতাল, জমজমাট মাছের বাজার, বিস্তীর্ণ ফলের বাজার, উন্নত বানিজ্য
কেন্দ্র, ডেভিড সাশুন-এর মত উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলেজ, থানা, আধুনিক স্টেডিয়াম,ব্লক
অফিস, নামী ক্লাব, সুন্দর রাস্তা-ঘাট সহ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা অর্থাৎ একটি পৌর শহরের
যাবতীয় উপাদান এখানে উপস্থিত। ক্যানিং থেকে ঝড়খালী পর্যন্ত সম্প্রসারিত রেলপথ তৈরির
অনুমোদন মেলার পর ২০০৯ সালে উদ্বোধন হওয়া রেলপথের কাজ নানান প্রশাসনিক জটিলতায় থমকে
আছে। সেই কাজ দ্রুত সম্পন্ন হ’লে সুন্দরবনবাসীর যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নততর হবে তা বলাই
বাহুল্য। এই সমস্ত প্রত্যাশা পূরণের আশায় অপেক্ষমান ক্যানিং তথা সমস্ত সুন্দরবাসী।
সুতরাং সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকরী উদ্যোগে ক্যানিং তার ঐতিহাসিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার
পাশাপাশি পৌর শহরের মর্যাদা পাক এবং অসমাপ্ত রেলপথের কাজ দ্রুত শেষ হোউক এই কামনা সকলেরই।
বিষয় আলু-পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি : অমরনাথ কর্মকার
সম্প্রতি আলু ও পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে রাজ্য
তোলপাড় ।প্রতিকেজি আলুর মুল্য ইতিমধ্যেই অর্ধশত ছুঁই ছুঁই,পেঁয়াজ শতকের পথে।এবং আরোও
মূল্যবৃদ্ধির অশনি সংকেত শোনা যাচ্ছে । ইতিপূর্বে আলু বা পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে
বেশ কয়েকবার কিন্তু এতটা বাড়েনি। সবচেয়ে বড়কথা হ'ল মূল্যবৃদ্ধির এই দীর্ঘ স্থায়ীত্ব
চোখে পড়েনি এবং আরও বিষ্ময়কর ব্যাপার হ'ল এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকার,বিরোধীপক্ষ
সকলের মধ্যেই কেমন যেন আলুথালু ভাব - এর প্রতিকার নিয়ে কেমন যেন আলস্য - তৎপরতার অভাব
লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০১৪ সালে আলুর দাম বেড়েছিল যখন তখন তার কারন অনুসন্ধানে জরুরী
ভিত্তিতে টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছিল সরকারীভাবে এবং কালোবাজারীর সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের
জব্দ করতে সরকারী কর্মীরা বাজারে রীতিমত অভিযান চালিয়েছিলেন। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর
নির্দেশে আলুর অহেতুক মজুতদারী এবং উচ্চমূল্যে আলু বিক্রি বন্ধ করার কড়া সরকারী পদক্ষেপ
নেওয়ার সাথে সাথেই পড়ে গেল আলুর আকাল । ইতিপূর্বে মুরগীর লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম
পরাতে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মুরগীর মূল্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। বিগত বছরে আলু-পেঁয়াজের
দামে নিয়ন্ত্রণ আনতে সরকারী তরফে নির্দিষ্ট মূল্যে আলু ও পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়েছিল।
এবারও আলু-পেঁয়াজ মহার্ঘ্য বটে, তবে অন্যান্যবারের মত এবারে এরা বাজার থেকে উধাও হয়ে
যায়নি। অতএব, বুঝতে অসুবিধা নেই যে আলু-পেঁয়াজের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে
প্রশাসনিক কোন কড়া পদক্ষেপ নেই। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভীতির লেশমাত্র নেই ।
করোনার অতিমারীর প্রভাবে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দুর্বলতার মধ্যে তাদের সহজ উদর পূর্তির
মুখ্য উপকরণের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে তাদের যে কি করুন অবস্থা সেকথা বলাই বাহুল্য।
বাঙালীর আলুবিহীন জীবন অকল্পনীয় । আলুময় ব্যঞ্জন বাঙালীর রান্নার বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্য
– ঝালে ঝোলে অম্বলে সর্বত্র আলুর অবধারিত উপস্থিতি । পেঁয়াজও বাঙালীর রান্নায় অপরিহার্য,
বাঙালীর আমিষ মানেই পেঁয়াজের সাহচর্য । আলুর দোষ কী সে সম্বন্ধে ধারণা থাক বা না থাক
আলুর গুনাগুণ যে কি বাঙালী মাত্রেই সে সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল । আলু-পেঁয়াজের এই
অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং তার এই দীর্ঘ স্থায়ীত্বে বাঙালীর মাথায় হাত । আলুহীন বাঙালীর
চোখের সামনে এখন আলোহীন অন্ধকার । একসময় মহার্ঘ্য
পেঁয়াজের পরিবর্তে স্যলাডে আপেল ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে । এবারের অবস্থাও সেই
একই পথে। বাস্তবে বর্তমানে আলু আর আপেলের মূল্যে ফারাক নেই। কিন্তু আলুর বিকল্প ? আলুবখরা
নিশ্চয়ই নয় । মন্বন্তরের সময় দেখা গেছে মানুষকে শাক-পাতা, মেটে আলু খেয়ে বেঁচে থাকতে
। এখন বাজারে গিয়ে দেখবেন সব্জির উচ্চমূল্যের কারনে বাজারে প্রচুর বিকোচ্ছে মেটে আলু,
মান-কচু । মনে পড়ে যাচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’-এর কথা । কেন্দ্রীয় সরকার আলু
ও পেঁয়াজকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মজুতদাররা
নিজেদের ভাঁড়ার ভরাচ্ছে, যার মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, বিশেষ ক’রে করোনার ক্রান্তিকালে
অসহায় মানুষদের কাছে এই মূল্যবৃদ্ধি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতই যন্ত্রনাদায়ক।
আলু-পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি এর আগে অনেকবারই ঘটেছে। কিন্তু
সেই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাজ্য সরকারের নিজস্ব ক্ষমতা ছিল কারন তখন অত্যাবশ্যকীয়
পণ্য আইনে আলু পেঁয়াজের মত অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাজ্য সরকারের নিজস্ব
আইনগত ভূমিকা ছিল। আলু ও পেঁয়াজকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পরে
মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাজ্য সরকারের ক্ষমতা খর্ব হয়। সম্ভবত সেই কারনেই আলু পেঁয়াজের
ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরাতে রাজ্য সরকারের ভূমিকা স্বাভাবিকভাবেই চোখে পড়ছে
না । আর কেন্দ্রীয় সরকারের এ ব্যাপারে মাথাব্যথা আদৌ আছে ব’লে মনে হয় না। সম্প্রতি
মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়ে এই সমস্যার আশু সমাধান করতে বলেছেন। এদিকে
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের সংশোধন নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত লেগেই আছে।
আলু-পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যে রাজনৈতিক খেলা চলছে তার
কতটা মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে আর কতটা আসন্ন নির্বাচনে জনসমর্থন পাওয়ার কৌশল
তা ঈশ্বরই জানেন। তবে এইসব দ্বন্দ্বের যাঁতাকলে পিষে মরা মানুষগুলোর দিকে মানবিকতার
দৃষ্টি নিয়ে না তাকালে করোনার অতিমারী, লকডাউনে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষগুলোর
পরিণতি সত্যিই করুন হয়ে উঠবে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ চিরকাল হয়ে এসেছে, চলবেও। কিন্তু উলুখাগড়ার
মত সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করাটা বন্ধ হওয়া উচিৎ।
আলুর এহেন আলুলায়িত পরিস্থিতিতে সবচেয়ে আনন্দে আছেন বোধহয়
রক্তে শর্করা-সমৃদ্ধ মানুষজন। বাঙালীর পাতে আলুবিহীন ব্যঞ্জন কল্পনাতীত। আর বাঙালীর
আমিষ মানে অবধারিতভাবে পেঁয়াজ। দিন আনা দিন খাওয়া হতদরিদ্র বাঙালীর সবচেয়ে সস্তার খাবার
‘আলুভাতে ভাত’ কিংবা ‘কাঁচা পেঁয়াজ সহযোগে পান্তাভাত’ও কি তবে জুটবে না ? না হয় বাঙালীর
একটু বেশিই আলুপ্রীতি আছে – এব্যাপারে আলুর দোষ নেই – হ’লই বা দোষটা আমাদের রসনার
– তাই ব’লে এই বঞ্চনা !
এই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন আবশ্যক। একটা গণতান্ত্রিক দেশের
পক্ষে এই পরিস্থিতি কখনোই মানানসই নয়।
দশমীতে মন খারাপঃ দশমী অমরনাথ কর্মকার ২৬/১০/২০২০
আজ তো স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ সবার। আমার মন খারাপ ভিন্ন কারনে। উৎসব শেষ হয়্রে গেল ব'লে একটুও নয়। এ বছর শুরু আর শেষের মধ্যে প্রভাদই বা কি ছিল? আমার খারাপ লাগছে বিজয়া দশমীতে পারস্পরিক মিলনের করুন অবস্থা দেখে। ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে তো এতদিন অনেক কিছুই চলল। কিন্তু কোলাকুলি, প্রণাম, আশির্বাদ এগুলো কি ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে সম্ভব। স্পর্শ না থাকলে অনুভূতি অনুপস্থিত। মানুষ রক্ত-মাংসে গড়া। অতএব, স্পর্শ ছাড়া অনুভূতি আসে না। হ্যাঁ, মন দিয়েও অনুভূতির আস্বাদ মেলে। সে তো উচ্চ দর্শন। প্লেটোনিক প্রেম, ইউটোপিয়া এসব সাধারণ ব্যাপার-স্যাপার নয়। কোলে কোলে মিলনের নাম কোলাকুলি। অতএব সোস্যাল মিডিয়ায়, অন লাইনে কোলাকুলি আদৌ সম্ভব নয়। বিদেশ থেকে বাবা ছেলেকে যতই আশির্বাদ করুক ভিডিও কলে, আশির্বাদের হাত তো আর ছেলের মাথায় পড়ে না! কিংবা বাবার পায়ে ছেলের হাতের স্পর্শ পেলে বাবার যে অনুভূতি হয় তা কি ভার্চুয়াল মাধ্যমে সম্ভব? মোটকথা এগুলো মূলত যান্ত্রিকতা, মানবিকতা বা সামাজিকতা কোনটাই নয়। এবছর দশমীতে বাঙালীর এই বঞ্চনা ইতিহাস হয়ে থাকবে। আজ আর বেশি কিছু নয়। করোনার ক্রান্তিকাল অতিক্রম ক'রেআগামী বছর পুজো ফিরে আসুক তার স্বাভাবিক মেজাজে এই শুভ কামনায় সকলকে বিজয়ার শুভেচ্ছা জানিয়ে এবং আজ লেখা একটি কবিতা দিয়ে শেষ করলামঃ
ভার্চুয়াল ভালোবাসাঃ অমরনাথ কর্মকার
বলছি আমি খোলাখুলি
ভারচুয়াল কোলাকুলি,
আশির্বাদ বা ভালোবাসা
সামাজিক নয়, যান্ত্রিকতায় ঠাসা।
স্পর্শ যদি নাই-ই থাকে
অনুভূতির মূল্যটাকে
কেমন ক'রে করবে স্থির?
কারন, রক্ত-মাংসে মানব শরীর।
নবমীতে মন খারাপঃ নবমী অমরনাথ কর্মকার ২৫/১০/২০২০
এ বছর যার আসাটাই প্রায় অর্থহীন, অতএব তার
যাওয়া নিয়ে মন খারাপ করা বোধ হয় নিরর্থক। সুতরাং 'যেয়োনা নবমী নিশি' ক'রে মন ভারাক্রান্ত
ক'রে কোন লাভ আছে ব'লে আমার মনে হয় না। বরং উৎসবহীন দুর্গোৎসবের নাম ক'রে গোমড়ামুখে
ঘরবন্দি ছুটি কাটানোর চেয়ে কর্মমুখর হয়ে সময় কাটানো এবছরে বেশি প্রয়োজন - কারন দীর্ঘ
লকডাউনে আর্থিক ক্ষতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে। আজ নবমী ব'লে আনন্দের লয়ে কোন পরিবর্তন
দেখলাম না। সেই ঢিমে তালে চলল দুর্গোৎসব - আনন্দহীন - সেই মুখচ্ছদে মুখ ঢাকা কিছু মানুষের
সুবেশে দলবেঁধে পথ চলা, সংক্রমণের আশঙ্কায় সন্দিগ্ধ চাহনি, রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা অস্থায়ী
খাবারের দোকানে খাওয়ার জন্য বায়না করা শিশুকে বাবার ধমকানি, নিরাশ দোকানি এই অপরিচিত
প্রেক্ষাপট। একটা পুজো মন্ডপে দেখলাম শিশুদের
নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। দেখার জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। কবিতা, গানে
শিশুরা বেশ মাতিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বাদ সাধল কবিতা আবৃত্তি করতে ওঠা এক শিশু। মুখে
তার মাস্ক। সে সেই অবস্থাতেই আবৃত্তি শুরু করতে উদ্যত। কারো অনুরোধই সে শুনতে চাইছে
না। শেষ পর্যন্ত তার বাবার ধমকানিতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাস্ক খুলল - তবে আবৃত্তির সঙ্গে
স্পষ্ট শোনা গেল মৃদু কান্নার শব্দ। মন খারাপ হ'ল। না, শুধু ঐ শিশুটির জন্য নয় - সব
শিশুর জন্য। সদ্য পৃথিবীতে এসেই এরা মাতৃভাষার মত শিখছে মুখোশ পরা জীবন যাপন। মন খারাপ
না হয়ে পারে, বলুনতো ? করোনা ভাইরাস যে কত
মানুষের মনস্তত্বে আঘাত হেনেছে তার ইয়ত্তা নেই। প্রসঙ্গত, একটা ঘটনার কথা মনে প'ড়ে
গেল। সে ঘটনার কথা ভাবলে মন খারাপের মাত্রা তীব্রতর হয়ে ওঠে। কয়েক মাস আগে লকডাউনে
গরীব মানুষদের যখন চরম দুরবস্থা তখন খাদ্য সামগ্রি বিতরণের এক অনুষ্ঠানে আমি হাজির
ছিলাম। আমার এক পরিচিত শিক্ষক এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা। সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত
গ্রামে খাদ্য সামগ্রি বিতরণ চলছে। প্রচুর হতদরিদ্র মানুষ সাহায্য পেয়ে তৃপ্তির হাসি
নিয়ে বাড়ি ফিরছে। হঠাৎ সেই শিক্ষক উঠে এসে আমাকে
'এবার আপনি দিন' বলেই সেখান থেকে দ্রুত পায়ে গ্রামের ভেতরে চ'লে গেলেন এবং ফিরে
এলেন সব শেষ হয়ে যাবার পর। প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি একদা এই গ্রামেই থাকতেন , তাই হয়ত
পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। কিন্তু আসল সত্যটা ওনার মুখ থেকে যখন শুনলাম তখন
তার চোখে জল দেখে আমিও কান্না চাপতে পারিনি। আসলে খাদ্যসামগ্রি বিতরণ করতে এক সময় খেয়াল
করলেন তার স্কুলের তার সময়ের হেডমাস্টার লাইনে অপেক্ষা করছেন। জীবনে তিনি আথা নত করেননি
এবং ছাত্রদের সবসময় মাথা উঁচু ক'রে বাঁচার উপদেশ দিয়ে গিয়েছেন। তার সেই হেডমাস্টারকে
লাইনে দেখে তিনি একটা আদর্শের এমন পরাজয় সহ্য করতে পারবেন না বলেই দ্রুত চ'লে গিয়েছেন।
গ্রামের মধ্যে গিয়ে সত্যটাও জেনে এসেছেন। হেডমাস্টারমশায়ের একমাত্র ছেলে মুম্বাই-এ
ছোটখাটো একটা কাজ করত। লক ডাউনে সেই কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আত্মঘাতি হয়েছে। এখন তাই বৃদ্ধ
মাস্টারমশায়ের সংসার অচল। পরিস্থিতির কাছে নীতি, আদর্শের এই অভাবনীয় পরাজয় মেনে নেওয়া
কঠিন। তবুও এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতি আমাদের এমন কিছু শিক্ষা দিল যে শিক্ষা হয়ত আগামী
দিনের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে। নবমী যাক। দুর্গোৎসব এবছর তাড়াতাড়ি বিদায় নিক - কোন
আক্ষেপ থাকবে না। কিন্তু আগামী বছর এতদিনের আনন্দঘন ঐতিহ্য নিয়ে আসুক এই নিশ্চয়তা পেলেই
আমরা খুশি।
অষ্টমীতে মন খারাপঃ অষ্টমী অমরনাথ কর্মকার
২৪/১০/২০২০
আজ আর 'মহা' শব্দের সঙ্গে 'অষ্টমী'র সন্ধি
করলাম না। আসলে পুজোর মাহাত্ম বা মহত্ব কোনটাই নেই এবার। আসলে একটা চলমান ঐতিহ্য মাঝপথে
এভাবে থমকে যাবে এটা অভাবনীয়। বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের জীবনের উপভোগ্যতা বাড়াচ্ছে
অথচ সামান্য একটা আনুবীক্ষণিক বস্তুকে হার মানাতে বিজ্ঞান হিমশিম খাচ্ছে। মুহূর্তে
ধ্বংস করার কত অত্যাধুনিক অস্ত্রের আবিষ্কার হয়েছে অথচ করোনা ভাইরাস নিরাময়ে বিজ্ঞান
এখনো পর্যন্ত ব্যর্থ। ভাবলে মন খারাপ হয়। 'ভার্চুয়াল' ব্যাপারটি যে ক্রমশ সাধারণ মানুষের
মধ্যে বাস্তবায়িত হ'তে শুরু করেছে তার প্রমাণ মিলল আজ - অষ্টমীর অঞ্জলী দেওয়ার সময়।
যেহেতু পুজো মন্ডপে ভীড় করা নিষেধ, তাই অনেককেই দেখলাম অনলাইনে অঞ্জলী দিতে। জীবনে
কি অদ্ভুত পরিবর্তন! অন্তর থেকে মেনে নেওয়া
কঠিন, তবুও নিরুপায় মানুষ। বৈদ্যুতিন পর্দা এখন সামাজিক দর্পণ। আজ অষ্টমীতে মেঘমুক্ত
আকাশ, ঝলমলে প্রকৃতি। কিন্তু উৎসবের ঝলমলানি নেই - নেই আনন্দের উচ্ছ্বাস। বেশিরভাগই
ঘরবন্দী। ঢাকের আওয়াজ কানে আসছে মাঝে মাঝে কিন্তু কেমন যেন ম্লান - সে শব্দে মন খারাপের
সুর। অষ্টমীর সন্ধ্যায় টিভিতে কলকাতার বিভিন্ন বড় পুজোর মন্ডপসজ্জা আর আলোকসজ্জা দেখছিলাম।
দেখছিলাম থিমের বাহার। সবই আছে অথচ কিছুই নেই। জনস্রোতে ভাটা। আসলে বাঙালীর মন ভালো
নেই। সবচে খারাপ লাগে ছোটদের জন্য। এদের আনন্দে বাধা দেওয়ার নির্মমতা অসহনীয় অথচ প্রায়
বলপূর্বক এদের সরল মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে আনন্দের বঞ্চনা। বাইরে পুজো প্যান্ডেল, আলোকসজ্জা,
ঢাকের আওয়াজ অথচ বাচ্চাগুলো ভূতে ভয় পাওয়ার মত করোনা নামক ভাইরাসের ভয়ে গোমড়ামুখে গৃহবন্দি।
এদের দিকে তাকালে সত্যি মন খারাপ হয়।আজ আর নয়। ক’দিন
আগে পুরোনো কর্মস্থল থেকে বদলী হয়ে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়েছি। সেদিনের সেই মন
খারাপকে কেন্দ্র ক’রে একটা কবিতা লিখেছিলাম। সেই কবিতা দিয়েই অষ্টমী শেষ করছি। শুভ
রাত্রি সবাইকে।
বিষন্ন বিকেলে মন ভালো নেই
......
অমরনাথ কর্মকার ২৫/০৯/২০২০
মন ভালো নেই আজ বিষন্ন
বিকেলে
সকালেও সূর্য হেসেছে
সাদা দাঁত মেলে।
বিকেলে চায়ের রঙটাও কেমন
বেমানান
স্বাদু টোস্ট বিস্কুটও
মনে হয় যেন নিষ্প্রাণ।
দুপুরে আকাশ সাজল কালো
রং দিয়ে,
বিকেলে নিভল আলো বৃষ্টি
এল ঝমঝমিয়ে।
এএক আহত সময়, চায়ের কাপে
ঠোঁট নেই
মোবাইলের সামাজিক মাধ্যমে
ছবি আপলোড নেই
দূরান্তে তোমার বায়বীয়
অবয়ব দৃষ্টিতে ভাসে
অস্তিত্বহীন, তবু সশরীরে
এই বুঝি কাছে আসে।
এখন মন ভালো নেই, ডুবে
আছি গভীর মৌনতায়
কিছু নেই, তবু যেন সব
আছে,ভালো নেই মনটাই।
মনের কোনে আসন পেতেছে
অতিকায় অবয়ব,
বুকের বাঁপাশে জমাট বেঁধেছে
স্নেহ,মায়া সব।
চুমুকহীন ধুমায়িত চা
ক্রমশ শীতল হয়ে যায়,
মনে কোন চাপ নেই, হৃদয়
চঞ্চল নয় উষ্ণতায়।
মনে হয় সবই আছে স্বাভাবিক,
একদম ঠিকঠাক,
তবু মন ভালো নেই, শুধু
ভাবি এই বুঝি দিল ডাক।
বৃষ্টিস্নাত বিষন্ন বিকেলে
বিদ্যাধরীর দিকচক্রবালে
রংধনুটা হারিয়ে গেছে,তবু
ভাবি হাতের নাগালে।
সপ্তমীতে মন খারাপঃ সপ্তমী অমরনাথ কর্মকার ২৩/১০/২০২০
উৎসবের সুর সপ্তমীতে যে সপ্তমে উঠবে না সে তো পূর্ব নির্ধারিত। এবারের পুজোটা অনেকটা ঢাকের বাঁয়ার মত। মানে সুসজ্জিত প্যান্ডেল থাকবে, প্রতিমা থাকবে অথচ সেখানে প্রবেশাধিকার থাকবে না। নেহাতই বাঙালীর আবেগ আর ঐতিহ্যকে শুধুমাত্র প্রদর্শন করে অস্তিত্বের সঙ্কটমোচনের চেষ্টা। সকালে বাজার ক'রে ফেরার সময় দেখলাম পাড়ার মহিলা মহলের প্যান্ডেলের প্রবেশপথ দড়ি দিয়ে আটকানো আর বড় বড় অক্ষরে লেখা 'দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ'। সবই করোনার করুনা। বাইরে থেকে যাদুঘরের অট্টালিকা দেখে কি আসল উদ্দেশ্য সাধন হয়! কিন্তু উপায় নেই। করোনার করাল থাবা থেকে জীবন রক্ষা উৎসবের আনন্দে প্রাণ ভাসানোর চেয়ে ঢের বেশি জরুরি। কিন্তু এত বজ্র আঁটুনি যে কিছু অবুঝ মানুষের কাছে ফসকা গেরো তা টের পেয়েছি সপ্তমীর সব্ধ্যেয়। প্যান্ডেলে ভিঁড় নেই অথচ রাস্তায় দলে দলে মানুষ, না আছে শারীরিক দূরত্ব, না আছে মুখচ্ছদের বালাই। অথচ সব আশঙ্কা সত্যি করে গতকালই এ রাজ্যে করোনা আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড করেছে। এভাবে চলতে থাকলে পুজোর শেষে হয়ত অধিকাংশের অস্থায়ী ঠিকানা হবে হাসপাতাল এবং অনেকেরই স্থায়ী ঠিকানা হবে পরলোক। আজ ভোর পাঁচটায় শুনতে পাচ্ছিলাম জমজমাট ঢাকের বাদ্যি। নবপত্রিকা স্নানের সারম্বর সমারোহ দেখে মনে হচ্ছিল উৎসব স্বাভাবিক মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু সকালের সমারোহ ক্রমশ ম্লান হ'তে শুরু করল বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। হাল্কা ঠান্ডা বাতাস সহযোগে ঝিরঝিরে বৃষ্টি - বাইরের পরিবেশের সঙ্গে মনের কোনেও মেঘ জমতে শুরু করল। এরই মাঝে আমার এক কাছের বন্ধুর করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর মনকে আরও ভারাক্রান্ত ক'রে তুলল। কাল থেকে আবার খবরের কাগজ বন্ধ। সময় কাটানোর একটা প্রধান উপকরণ বন্ধ। যতই অলস সময় কাটাই ততই দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে কপালে। এখন না হয় ছুটি, কিন্তু ছুটি ফুরোলেই আবার করোনা সংক্রমনের ঝুঁকি, আবার প্রতিকুলতার সঙ্গে লড়াই ক'রে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া, আবার মানুষের দুর্দশার যন্ত্রণাকাতরতা। অতএব, মনখারাপের মাত্রা প্রশমণের কোন উপায় নেই। অন্যান্যবার পুজোর উৎসব যত শেষের দিকে আসত আমার মনখারাপের তীব্রতা ক্রমশ কমত। এবার ব্যাপারটা ঠিক তার বিপরীত। সন্ধ্যেবেলা বেরিয়েছিলাম কিছু সাংসারিক জিনিসপত্র কিনতে। রথ দেখতে গিয়ে কলা বেচা অর্থাৎ কয়েকটা প্যান্ডেলও দেখা হয়ে গেল। প্যান্ডেলে জনসমাগম কম কিন্তু রাস্তা দিয়ে চলা দায়। প্রাণের আবেগে, উৎসবের উচ্ছ্বাসে মানুষের বহির্গমন রোধ করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। বাঁচার জন্য সারাটা বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর পুজোর আনন্দে প্রেমের জোয়ারে কয়েকটা দিন গা ভাসাতে তারা বদ্ধপরিকর। কোন আইন, কোন তত্ত্ব দিয়ে এদের আটকানো সহজ নয়। এদের হয়ত শিক্ষা কম কিন্তু শিক্ষিতদের মত এদের আয়ও কম। অতএব, শুধু উপদেশ দিয়ে, সচেতনতা সৃষ্টি ক'রে যে এদের নিরস্ত করা সম্ভব নয় তা শিক্ষিত মাত্রেই হৃদয়ে উপলব্ধি করলেও মুখে বাস্তব কথা বলার সাহস রাখেন না। বাইরে শীতের হাওয়ার নাচন, সপ্তমী শেষ, কাল অষ্টমী। অর্থাৎ উৎসবের মধ্যগগন। উৎসব আর উৎসাহের অনুপাতে ঘাটতি হয়ত এবারের পুজোয় আছে, কিন্তু যতই করোনার আতঙ্ক থাক না কেন, ভিতরে বাইরে, অন্তরে অন্তরে দুর্গোৎসব আছে। আমার মন খারাপ। কিন্তু যাদের জন্য মন খারাপ তারা যদি ভালো থাকে তাহলে আমার মন ভালো থাকাটাই স্বাভাবিক। আসলে মনকে সময়ের গন্ডীতে কিছুতেই বেঁধে রাখা যায় না। যখন যেখানে খুশি গিয়ে হাজির হয়। আর আমার ক্ষেত্রে আমার মন কেবলই দুঃখের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়, তাই মন খারাপের অন্ত নেই। কাল অষ্টমীতে লিখব আশা করি। শান্তি হোউক সর্বজনীন।
ষষ্ঠীতে মন খারাপঃ ষষ্ঠী ২২/১০/২০২০ অমরনাথ কর্মকার
আজ ষষ্ঠী। প্রতিবারই পুজোতে
মন খারাপ হয়। তাই নিয়ে প্রতি বছর ষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত প্রতিদিন আমার
মনখারাপের বৃত্তান্ত লিখে থাকি। এবছরও তার ব্যত্যয় নেই। অন্যান্যবারে মনখারাপের
নির্দিষ্ট কোন কারন খুঁজে পাই না,
অথচ মন খারাপ হয়। আসলে পুজো এলে যখন উতসবের আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাবার কথা, তখন টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো কিলবিল ক'রে ঢুকে পড়ে মনে, ভাইরাসের মত। আর তখনই শরীর নয়, মন খারাপ হয়। এবার অবশ্য শুধু আমার কেন, প্রায় সকলেরই মন খারাপ। কারন ব'লে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। করোনা ভাইরাস
মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর যে মর্মান্তিক প্রভাব বিস্তার করেছে তাতে পুজো মাথায়
উঠেছে। আজ ষষ্ঠী। একদিকে মহামান্য হাইকোর্ট রায় দিয়েছে পুজো মন্ডপে দর্শনার্থীদের
প্রবেশ নিষেধ - অন্যদিকে বাঙালীর ঐতিহ্যের দুর্গাপুজোর আবেগমিশ্রিত করোনাভীতি -
দুয়ে মিলে বাঙালী মানসে চলছে দড়ি টানাটানি। করোনার ক্রান্তিকালে সমাজ ব্যবস্থার
আকষ্মিক ও অনভিপ্রেত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। সামাজিক দূরত্ব নামক এক অসামাজিক
প্রথাকে মানতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। অথচ দুর্গাপুজোর মত বাঙালীর আবেগের উতসব, যার মূল প্রতিপাদ্য সামাজিক মিলন, সেখানেও জীবন রক্ষার তাগিদে সামাজিক দূরত্ব
বজায় রাখার নির্দেশ - এতে সবার মন খারাপ হওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। প্রতিদিন হাজার
হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে,
অনেক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। করোনার অতিমারীর সঙ্গে অর্থনৈতিক অতিমারীর
মেলবন্ধনে সকলেই আজ দিশাহারা। বহু মানুষের কাজ নেই। ট্রেন বন্ধ। বন্ধ স্কুল-কলেজ।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে 'ভার্চুয়াল' নামক গালভরা পদ্ধতিতে কাজ চালানোর ব্যবস্থা
চলছে - তাতে কাজ হয়ত চলছে কিন্তু মন ভরছে কই? মুখচ্ছদে মুখ ঢাকা সবার - ফলে পরিচিতকে চেনাটাও দায় হয়ে
দাঁড়িয়েছ। সামান্য আনুবীক্ষনিক একটা ভাইরাস মানব সভ্যতা ঐতিহ্যে থাবা বসিয়েছে।
ভাবলেই মন খারাপ হয়। আজ ষষ্ঠীর সন্ধ্যেয়
বেরিয়েছিলাম এবারের দুর্গাপুজোয় মানুষের উতসাহ অবলোকন করতে। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে
মানুষের আনাগোনা অন্যান্য বছর গুলোর তুলনায় কম থাকলেও করোনার বিপন্মুক্তির মাত্রা
ছাড়ানো অবশ্যই। বোঝা গেল স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দেশে সাহসী বিপ্লবীর সংখ্যা কম
থাকলেও বর্তমানে তার সংখ্যাধিক্য। কারন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে ঠাকুর দর্শনের
জন্য আত্মবলিদান করতে এরা সদা প্রস্তুত। অর্থাৎ এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে
ব্যতিক্রম সামান্যই। তবে শুধু একটা নতুন জিনিস নজরে এল। পুজো প্যান্ডেলের বাইরে
এবং রাস্তাঘাটে প্রচুর সাহায্যপ্রার্থী। এদের প্রত্যেকেরই মুখ ঢাকা মুখচ্ছদে। কেন
জানিনা বার বার মনে হচ্ছিল এদের মধ্যে আমার পরিচিত কেউ নেই তো ! এরা প্রত্যেকেই মুখচ্ছদে প্রায় পুরো মুখটাই
ঢাকার চেষ্টা করেছেন লজ্জায়। ওদের দিকে তাকাতে আমার কেমন যেন সঙ্কোচ হচ্ছিল।
কিন্তু হঠাতই চোখ পড়ে গেল ধুতি পরিহিত থালা হাতে এক বৃদ্ধের দিকে। অসাবধানতায়
মুখচ্ছদটা অনেকটা নেমে গেছে। চিনে ফেললাম নিমেষে। আমার এক বন্ধুর বাবা। বন্ধুটি
ব্যাঙ্গালোরে এক বেসরকারী সংস্থায় কাজ করত। লকডাউনের সময় কাজ হারিয়েছে। তবুও এখানে
ফেরেনি। আমার সঙ্গে প্রায়ই ফোনে কথা হ'ত। তারপর হঠাত ফোন বন্ধ। অনেক চেষ্টা করেও আমি কিংবা ওদের
বাড়ির লোক যোগাযোগ করতে পারেনি। পরিবারের একমাত্র ছেলের এই পরিস্থিতিতে আমি ওর বৃদ্ধ বাবাকে আর্থিক সাহায্য
করতাম।তারপর আমার অফিস চালু হয়ে যাবার পর আর যোগাযোগ রাখতে পারিনি। আজ বন্ধুর
বাবাকে দেখে তাঁর কাছে যেতেই তিনি দ্রুত মুখচ্ছদটা ঠিক ক'রে মুখ ঢাকার ব্যবস্থা করলেন। মানিব্যাগটা বের
করতে গিয়েও করলাম না। দ্রুত পায়ে ফিরে এলাম বাড়িতে একরাশ মনখারাপ নিয়ে। রাতে শুয়ে
শুয়ে সেই বৃদ্ধের মুখচ্ছবি চোখের সামনে যেন স্থির চিত্রের মত দাঁড়িয়ে রইল। আফশোস
হচ্ছিল - একজন মানুষের দুর্দশা দেখেও আমি কেন ফিরে এলাম সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, এখন নয়, পুজোর পরে ওনার বাড়ি যাব। মুখোশ যতই থাকে, মুখোশের আড়ালে মুখও থাকে অনেকের।
ভার্চুয়াল জগত – অমরনাথ কর্মকার
কোভিড-১৯
অতিমারীর প্রভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে আমাদের মত
দেশের মানুষদের মানসিকতারও যথেষ্ট পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। বিশেষ ক’রে ‘ভার্চুয়াল’ শব্দটি অধিকাংশের
মধ্যেই একটা অপরিচিত জগতের মত মনে হচ্ছে যা খুবই স্বাভাবিক। ক্লাসরুমে ছাত্র-শিক্ষক
নেই,অথচ ঘরে বসেই বৈদ্যুতিন পর্দায় ক্লাস করতে হচ্ছে। অফিসের
মিটিং চলছে অনলাইনে। সামাজিক দূরত্ববিধি মানতে গিয়ে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই
বিশ্বকে হাজির করছি। পারস্পরিক দৈহিক সাক্ষাতে অভ্যস্ত জীবন থেকে আকষ্মিক
একাকীত্বের পরিবেশে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে,মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে – এ সবই ঠিক।
কিন্তু সত্যি বলতে কি আমাদের চাহিদা তো এ রকমই ছিল। প্রথম দিকে আমরাও কম্পিউটারের ‘অনুপ্রবেশ’মেনে নিতে পারিনি
অথচ আজ কম্পিউটার ছাড়া জীবন অচল। যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে
আমাদের অন্য জগতে পা রাখা শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। বাস্তব জীবনের সঙ্গে
অবিচ্ছিন্ন সংযোগের মধ্যে দিয়ে প্রযুক্তির উন্নতির হাত ধ’রে প্রতিনিয়ত আমাদের জগত সমৃদ্ধ ও গতিময় হচ্ছে। এই সুবাদেই
একটা ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ করার চেষ্টা বহুদিন থেকেই চলে আসছে। সুতরাং ‘ভার্চুয়াল’শব্দটি কোভিডের
কারনে জন্ম নেয়নি,অনেক আগে থেকেই
এর বাস্তবায়ন একটু একটু ক’রে হতে শুরু
করেছিল।
আচ্ছা
ভেবে দেখুন,টেলিফোন আবিষ্কার হওয়ার পর দৈহিক
সাক্ষাৎ ছাড়াই আমরা দূর-দূরান্তের মানুষের সঙ্গে অতি সহজেই এবং নিমেষে যোগাযোগ
রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছি। তখন থেকেই বোধ হয় আমাদের ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশের শুরু।
তখন থেকেই চিঠি লেখার অভ্যেস হ্রাস পেয়েছে এবং ডাক পরিষেবার গুরুত্ত্ব ক্রমশ কমতে
শুরু করেছে। আর আজ ইমেল আসার কারনে টিম টিম ক'রে জ্বলা ডাক ব্যবস্থা প্রায় নিভু নিভু। ঐতিহ্যের ডাক ব্যবস্থার এই করুন
পরিণতিতে দুঃখ পেলেও সেই দুঃখ পুষে রাখার মানসিকতাকে বোধহয় আমরা অনেকটা অতিক্রমও ক'রে ফেলেছি ইতিমধ্যে। রেডিও,টেলিভিশনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা কি আমাদের ভার্চুয়াল জগতের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ
করে না ?
আসলে এই যে ভার্চুয়াল জগতে আমাদের প্রবেশ (অনেকের কাছে তা ‘অনুপ্রবেশ’ও বটে) তা ঘটেছে
আমাদের অগোচরে এবং অত্যন্ত ধীরে ধীরে,যার ফলে আমাদের মানিয়ে নিতেও অসুবিধা হয়নি। এইভাবে আমরা যোগাযোগ প্রযুক্তির
একটা চরম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি ইন্টারনেটের হাত ধ’রে।
ইন্টারনেট
কেন্দ্রিক পৃথিবীতে সময়ের সীমাবদ্ধতা নেই,নেই রাত-দিনের বিভাজন । প্রচলিত ধারণাকে পালটে দিয়ে মানবজাতির কল্যাণে কল্পনাতীতভাবে বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তের
সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে নিমেষেই। অর্থাৎ আমাদের ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশের সম্ভাবনা
ত্বরান্বিত করেছে ইন্টারনেট। একথা অনস্বীকার্য যে নানা সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টির
পাশাপাশি এই জগত অনেক সংকটেরও জন্ম
দিয়েছে। যোগাযোগের ধরন ও বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো
মানুষের বাস্তব জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরতার
কারণে মানুষের আচার-আচরণেও পরিবর্তন আসছে। এ পরিবর্তন কখনো ইতিবাচক কখনো আবার তা নেতিবাচক।
সহজে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পথও খুলে গেছে। যন্ত্রকেন্দ্রিক যোগাযোগের কারনে মাধ্যমহীন
যোগাযোগ ও সম্পর্ক ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। বিদেশে থাকা ছেলে বা মেয়ের জন্মদিন পালনের
অনুষ্ঠান বাবা-মা উপভোগ করছেন বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সরাসরি, অথচ বাবা-মায়ের আশির্বাদের হাত সন্তানের মাথায়
পড়ছে না। ভার্চুয়াল জগতে সবকিছুই আছে অথচ কোথাও যেন বাস্তবতার সঙ্গে অনেকটা ফারাক,মনস্তত্বের ওপর যার প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু অভিযোজন
শব্দের বাস্তব ভিত্তিকে মান্যতা দিলে,হয়ত অনেক বছর বাদে এই মনস্তাত্বিক প্রভাব কেটে যেতে বাধ্য।
কল্পবিজ্ঞানের
বিখ্যাত লেখক উইলিয়াম গিবসনের স্বকপোলকল্পিত 'ভার্চুয়াল জগত' আজ কল্পবিজ্ঞানের
গণ্ডী ছাড়িয়ে সটান হাজির আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। মানুষে মানুষে যে যোগাযোগ ও
লেনদেন তা বাস্তব জীবনের বিপরীতে
বিশ্বজনীন করার স্বপ্ন সত্যি সত্যিই আজ সফল হতে চলেছে এবং কোভিড-১৯ নামক
অপ্রত্যাশিত অতিমারীর প্রভাব নিঃসন্দেহে একে ত্বরান্বিত করেছে। কিন্তু প্রশ্ন
হচ্ছে আমাদের মত অনুন্নত দেশে ভার্চুয়াল পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা কতটা? যে দেশে অধিকাংশ মানুষ কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন ব্যবহার তো
দূরের কথা,বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহের জন্যে
হিমশিম খায় সেখানে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে পড়াশুনা চালানো বা নানাবিধ কাজ সম্পন্ন করা
সত্যি দুরুহ। আর শিক্ষার হার কম হবার কারনে অত্যাধুনিক এই ভার্চুয়াল ব্যবস্থার
ইতিবাচক দিক নিয়েও অনেকে সন্দিহান। ফলে উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মত আমাদের
দেশে ভার্চুয়াল যোগাযোগ দ্রুত সর্বজনীন হওয়া সম্ভব নয়।
তবে ধীরে
হলেও ভার্চুয়াল ব্যবস্থার প্রতি নির্ভরশীলতা যে ক্রমশ বাড়ছে তা বলাই বাহুল্য।
বিষন্ন বিকেলে মন ভালো নেই
...... অমরনাথ কর্মকার ২৫/০৯/২০২০
মন ভালো নেই আজ বিষন্ন বিকেলে
সকালেও সূর্য হেসেছে সাদা দাঁত মেলে।
বিকেলে চায়ের রঙটাও কেমন বেমানান
স্বাদু টোস্ট বিস্কুটও মনে হয় যেন নিষ্প্রাণ।
দুপুরে আকাশ সাজল কালো রং দিয়ে,
বিকেলে নিভল আলো বৃষ্টি এল ঝমঝমিয়ে।
এএক আহত সময়, চায়ের কাপে ঠোঁট নেই
মোবাইলের সামাজিক মাধ্যমে ছবি আপলোড নেই
দূরান্তে তোমার বায়বীয় অবয়ব দৃষ্টিতে ভাসে
অস্তিত্বহীন, তবু সশরীরে এই বুঝি কাছে আসে।
এখন মন ভালো নেই, ডুবে আছি গভীর মৌনতায়
কিছু নেই, তবু যেন সব আছে, ভালো নেই মনটাই।
মনের কোনে আসন পেতেছে অতিকায় অবয়ব,
বুকের বাঁপাশে জমাট বেঁধেছে স্নেহ,মায়া সব।
চুমুকহীন ধুমায়িত চা ক্রমশ শীতল হয়ে যায়,
মনে কোন চাপ নেই, হৃদয় চঞ্চল নয় উষ্ণতায়।
মনে হয় সবই আছে স্বাভাবিক, একদম ঠিকঠাক,
তবু মন ভালো নেই, শুধু ভাবি এই বুঝি দিল ডাক।
বৃষ্টিস্নাত বিষন্ন বিকেলে বিদ্যাধরীর দিকচক্রবালে
রংধনুটা হারিয়ে গেছে, তবু ভাবি হাতের নাগালে।
মাস্ক পরা বিপ্লবিঃ অমরনাথ কর্মকার ১২/০৯/২০২০
আমি স্লোগানবিহীন মৌন মিছিলে মাস্ক পরা বিপ্লবি
মৌনতার শ্লোগানে আঁকি আগামী সমাজের ছবি।
এখন সবার শরীরে অসুখ
সকলেরই অর্ধেক ঢাকা মুখ।
আমি মৌন মুখর বিপ্লবি।
অজস্র শবদেহ শ্মশানে পোড়ে রোজ রোজ
বেওয়ারিশ লাশের মত স্বজন নেয় না খোঁজ
শত্রুর ভয়ে ঘরেই বন্দি থাকি
শত্রুর ভয়ে মুখ ঢেকে রাখি
পাল্টে গেছে গত সমাজের ছবি।
চেনা অচেনা শত্রু মিত্র ভেদ করা দুঃসাধ্য
ওঁত পেতে থাকা ঘাতকের ভয়ে একাকীত্বে হয়েছি বাধ্য
বৈদ্যুতিন পর্দা আজ অনুভূতিহীন মিলনের অলীক পরিবেশ
সমাজ যেন হয়ে গেছে শরীরবিহীন ভূতের রাজার দেশ।
হুঙ্কারে নয়, মুখঢাকা মৌনতা দিয়ে
বিপ্লবি হয়ে আগের সমাজ আনব ফিরিয়ে।
বন্ধু এসো ক্রান্তিকালে পাল্টে ফেলি সমাজের ছবি।
কেমন আছে রেলের হকার ?
অমরনাথ কর্মকার ০৮/০৯/২০২০
রেল স্টেশন দিয়ে যখনই যাই, তখনই দেখতে পাই লোকটাকে। প্লাটফর্মে একা একা ব'সে আছেন সত্তরোর্ধ ব্যক্তিটি। খুব চেনা চেনা লাগে অথচ কিছুতেই মনে করতে পারি না। প্রায় ছ' মাসের বেশি হতে চলল, একদা বিরামহীন রেল পরিবহণ করোনা ভাইরাসের অতিমারীর প্রভাবে আজ পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে আছে। করোনা ভাইরাস রেলের চলমান ঐতিহ্যকে একেবারে থামিয়ে দিয়েছে। যাত্রিহীন প্লাটফর্মে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। লোকটাকে কিছুতেই মনে করতে পারছি না ব'লে ভেতরে ভেতরে একটা অস্থিরতা কাজ করছে। আজ অনেক ভেবেচিন্তে উদ্ধার করতে পেরেছি তার পরিচিতি। লজেন্স কাকু। সেই ছোট্ট বেলা থেকে আমি ট্রেনের নিত্য যাত্রী, স্কুলে যাওয়া- আসার নিত্য পরিবহণ। তারপর চাকরী জীবনেও সেই রেলই ভরসা। ছোট্ট বেলা থেকেই তাকে দেখে আসছি বয়াম ভর্তি লজেন্স নিয়ে ট্রেনের কামরায় বিচিত্র আকর্ষনীয় ভঙ্গিমায় লজেন্স বিক্রি করতে। আমরা ডাকতাম 'লজেন্স কাকু'। ট্রেন বন্ধ হবার আগের দিনও তার কাছ থেকে লজেন্স কিনেছি। লজেন্স বিক্রি ক'রে সামান্য উপার্জন অথচ পেশা পরিবর্তন করেননি। ট্রেনের যাত্রীদের প্রতি অনুরাগেই হয়ত পেশা পাল্টাননি। লকডাউনে কত লোকের জীবিকা বন্ধ হয়ে গেছে। লক ডাউন উঠে যাবার পর অনেকেই বাঁচার তাগিদে উপার্জনের বিকল্প পথ বেছে নিয়েছেন। ট্রেন কবে চালু হবে তা অনিশ্চিত। তাহ'লে ট্রেনে হকারি করা মানুষগুলো কেমন আছেন ? এই প্রশ্নের মধ্যে কিন্তু অনেক উদ্বেগ লুকিয়ে আছে।
শিয়ালদা থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর পর্যন্ত যে ঝালমুড়িওয়ালা একদা নিত্যযাত্রীদের চাহিদা পূরণে হিমশিম খেত, 'গরম চায়ে' হাঁক দেওয়া মাত্র যার পেটমোটা চায়ের কেটলি নিমেষে নিঃশেষ হয়ে যেত কিংবা বাঁশিতে বাচ্চার কান্নার নিখুঁত শব্দ শুনিয়ে জোকারের মত মানুষকে আনন্দ দিয়ে বাঁশি বিক্রি করত তাদের সংসার এখন চলছে কি ভাবে? পরিবারের দারিদ্র্য নিরসনে ক্যানিং কিংবা বনগাঁ লোকালে যে সমস্ত মহিলারা ভিড়ে ঠাসা রেলের কামরায় রীতিমত ঝগড়া আর মল্লযুদ্ধ করতে করতে কলকাতায় বাবুদের বাড়িতে কাজ করতে যেত তাদের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন? ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। তিল ধারনের অসাধ্য ট্রেনের কামরায় ঘর্মাক্ত কলেবরে গায়ে গা লাগিয়ে, ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা সহযাত্রীদের সাথে কুস্তি করতে করতে গন্ত্যব্যে পৌঁছনোয় অভ্যস্ত জীবনে আকষ্মিক দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা আমার মত অনেককেই হয়ত উপার্জনের পথ থেকে নিরস্ত করতে পারেনি, কিন্তু যাদের কাছে রেলের কামরাই ছিল উপার্জনের এক এবং একমাত্র জায়গা তাদের পরিণতির কথা মনকে ভারাক্রান্ত করে। যে অন্ধ ছেলেটা সুন্দর গান গেয়ে ট্রেনযাত্রীদের প্রশংসা সহ অর্থ উপার্জন করত সে কি এখন আর গান শুনিয়ে ভিক্ষে করতে পারে আগের মত?
আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়ত ট্রেন চালানো শুরু হবে বিভিন্ন নিয়ম কানুনের বজ্র আঁটুনি দিয়ে। মাস্ক বাধ্যতামূলক হবে, মানা হবে দূরত্ব বিধি। তাতে যাত্রী সাধারণ অবশ্যই উপকৃত হবেন। কিন্তু হকাররা, বাচিক শিল্পীদের মত অসাধারণ দক্ষতায় শুধুমাত্র 'কথা' দিয়ে যারা জিনিস বিক্রি করতেন তাদের দুর্দশার কিন্তু অবসান হওয়া প্রায় অসম্ভব। মাস্কের আড়াল থেকে মুখোচ্চারিত শব্দ আগের মত হবে না। অথবা ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে আসা কাজের মাসি আর কি কাজ পাবেন বাবুর বাড়িতে? করোনা সংক্রণের ভয়ে নির্ঘাত নৈব নৈব চ। গান গেয়ে ভিক্ষে করা ছেলেটা কি আর পারবে মাস্ক-মুখে গান গাইতে? আর এভাবেই যদি চলতে থাকে এই পরিবর্তিত ট্রেন যাত্রা তাহলে দেশের বেকারত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি আমরা চিরতরে হারাব একঘেয়ে ট্রেন যাত্রায় আমাদের মানসিক বিনোদন দানের প্রতিভাবান কুশিলবদের। এদের বিকল্প উপার্জনের পথ খুলতে আশাকরি সরকার সচেষ্ট হবেন।
মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু নাকি সত্যের চির সমাধি? নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?