বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০২০

পুজোয় মন খারাপঃ আজ ষষ্ঠী

 

ষষ্ঠীতে মন খারাপঃ ষষ্ঠী ২২/১০/২০২০ অমরনাথ কর্মকার

আজ ষষ্ঠী। প্রতিবারই পুজোতে মন খারাপ হয়। তাই নিয়ে প্রতি বছর ষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত প্রতিদিন আমার মনখারাপের বৃত্তান্ত লিখে থাকি। এবছরও তার ব্যত্যয় নেই। অন্যান্যবারে মনখারাপের নির্দিষ্ট কোন কারন খুঁজে পাই না, অথচ মন খারাপ হয়। আসলে পুজো এলে যখন উতসবের আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাবার কথা, তখন টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো কিলবিল ক'রে ঢুকে পড়ে মনে, ভাইরাসের মত। আর তখনই শরীর নয়, মন খারাপ হয়। এবার অবশ্য শুধু আমার কেন, প্রায় সকলেরই মন খারাপ। কারন ব'লে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। করোনা ভাইরাস মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর যে মর্মান্তিক প্রভাব বিস্তার করেছে তাতে পুজো মাথায় উঠেছে। আজ ষষ্ঠী। একদিকে মহামান্য হাইকোর্ট রায় দিয়েছে পুজো মন্ডপে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ - অন্যদিকে বাঙালীর ঐতিহ্যের দুর্গাপুজোর আবেগমিশ্রিত করোনাভীতি - দুয়ে মিলে বাঙালী মানসে চলছে দড়ি টানাটানি। করোনার ক্রান্তিকালে সমাজ ব্যবস্থার আকষ্মিক ও অনভিপ্রেত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। সামাজিক দূরত্ব নামক এক অসামাজিক প্রথাকে মানতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। অথচ দুর্গাপুজোর মত বাঙালীর আবেগের উতসব, যার মূল প্রতিপাদ্য সামাজিক মিলন, সেখানেও জীবন রক্ষার তাগিদে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ - এতে সবার মন খারাপ হওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, অনেক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। করোনার অতিমারীর সঙ্গে অর্থনৈতিক অতিমারীর মেলবন্ধনে সকলেই আজ দিশাহারা। বহু মানুষের কাজ নেই। ট্রেন বন্ধ। বন্ধ স্কুল-কলেজ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে 'ভার্চুয়াল' নামক গালভরা পদ্ধতিতে কাজ চালানোর ব্যবস্থা চলছে - তাতে কাজ হয়ত চলছে কিন্তু মন ভরছে কই? মুখচ্ছদে মুখ ঢাকা সবার - ফলে পরিচিতকে চেনাটাও দায় হয়ে দাঁড়িয়েছ। সামান্য আনুবীক্ষনিক একটা ভাইরাস মানব সভ্যতা ঐতিহ্যে থাবা বসিয়েছে। ভাবলেই  মন খারাপ হয়। আজ ষষ্ঠীর সন্ধ্যেয় বেরিয়েছিলাম এবারের দুর্গাপুজোয় মানুষের উতসাহ অবলোকন করতে। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে মানুষের আনাগোনা অন্যান্য বছর গুলোর তুলনায় কম থাকলেও করোনার বিপন্মুক্তির মাত্রা ছাড়ানো অবশ্যই। বোঝা গেল স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দেশে সাহসী বিপ্লবীর সংখ্যা কম থাকলেও বর্তমানে তার সংখ্যাধিক্য। কারন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে ঠাকুর দর্শনের জন্য আত্মবলিদান করতে এরা সদা প্রস্তুত। অর্থাৎ এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যতিক্রম সামান্যই। তবে শুধু একটা নতুন জিনিস নজরে এল। পুজো প্যান্ডেলের বাইরে এবং রাস্তাঘাটে প্রচুর সাহায্যপ্রার্থী। এদের প্রত্যেকেরই মুখ ঢাকা মুখচ্ছদে। কেন জানিনা বার বার মনে হচ্ছিল এদের মধ্যে আমার পরিচিত কেউ নেই তো !  এরা প্রত্যেকেই মুখচ্ছদে প্রায় পুরো মুখটাই ঢাকার চেষ্টা করেছেন লজ্জায়। ওদের দিকে তাকাতে আমার কেমন যেন সঙ্কোচ হচ্ছিল। কিন্তু হঠাতই চোখ পড়ে গেল ধুতি পরিহিত থালা হাতে এক বৃদ্ধের দিকে। অসাবধানতায় মুখচ্ছদটা অনেকটা নেমে গেছে। চিনে ফেললাম নিমেষে। আমার এক বন্ধুর বাবা। বন্ধুটি ব্যাঙ্গালোরে এক বেসরকারী সংস্থায় কাজ করত। লকডাউনের সময় কাজ হারিয়েছে। তবুও এখানে ফেরেনি। আমার সঙ্গে প্রায়ই ফোনে কথা হ'ত। তারপর হঠাত ফোন বন্ধ। অনেক চেষ্টা করেও আমি কিংবা ওদের বাড়ির লোক যোগাযোগ করতে পারেনি। পরিবারের একমাত্র ছেলের এই পরিস্থিতিতে  আমি ওর বৃদ্ধ বাবাকে আর্থিক সাহায্য করতাম।তারপর আমার অফিস চালু হয়ে যাবার পর আর যোগাযোগ রাখতে পারিনি। আজ বন্ধুর বাবাকে দেখে তাঁর কাছে যেতেই তিনি দ্রুত মুখচ্ছদটা ঠিক ক'রে মুখ ঢাকার ব্যবস্থা করলেন। মানিব্যাগটা বের করতে গিয়েও করলাম না। দ্রুত পায়ে ফিরে এলাম বাড়িতে একরাশ মনখারাপ নিয়ে। রাতে শুয়ে শুয়ে সেই বৃদ্ধের মুখচ্ছবি চোখের সামনে যেন স্থির চিত্রের মত দাঁড়িয়ে রইল। আফশোস হচ্ছিল - একজন মানুষের দুর্দশা দেখেও আমি কেন ফিরে এলাম সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, এখন নয়, পুজোর পরে ওনার বাড়ি যাব। মুখোশ যতই থাকে, মুখোশের আড়ালে মুখও থাকে অনেকের।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?