রবিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২০

নবমীতে মন খারাপ

 

         নবমীতে মন খারাপঃ নবমী                 অমরনাথ কর্মকার ২৫/১০/২০২০

 

এ বছর যার আসাটাই প্রায় অর্থহীন, অতএব তার যাওয়া নিয়ে মন খারাপ করা বোধ হয় নিরর্থক। সুতরাং 'যেয়োনা নবমী নিশি' ক'রে মন ভারাক্রান্ত ক'রে কোন লাভ আছে ব'লে আমার মনে হয় না। বরং উৎসবহীন দুর্গোৎসবের নাম ক'রে গোমড়ামুখে ঘরবন্দি ছুটি কাটানোর চেয়ে কর্মমুখর হয়ে সময় কাটানো এবছরে বেশি প্রয়োজন - কারন দীর্ঘ লকডাউনে আর্থিক ক্ষতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে। আজ নবমী ব'লে আনন্দের লয়ে কোন পরিবর্তন দেখলাম না। সেই ঢিমে তালে চলল দুর্গোৎসব - আনন্দহীন - সেই মুখচ্ছদে মুখ ঢাকা কিছু মানুষের সুবেশে দলবেঁধে পথ চলা, সংক্রমণের আশঙ্কায় সন্দিগ্ধ চাহনি, রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা অস্থায়ী খাবারের দোকানে খাওয়ার জন্য বায়না করা শিশুকে বাবার ধমকানি, নিরাশ দোকানি এই অপরিচিত প্রেক্ষাপট।  একটা পুজো মন্ডপে দেখলাম শিশুদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। দেখার জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। কবিতা, গানে শিশুরা বেশ মাতিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বাদ সাধল কবিতা আবৃত্তি করতে ওঠা এক শিশু। মুখে তার মাস্ক। সে সেই অবস্থাতেই আবৃত্তি শুরু করতে উদ্যত। কারো অনুরোধই সে শুনতে চাইছে না। শেষ পর্যন্ত তার বাবার ধমকানিতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাস্ক খুলল - তবে আবৃত্তির সঙ্গে স্পষ্ট শোনা গেল মৃদু কান্নার শব্দ। মন খারাপ হ'ল। না, শুধু ঐ শিশুটির জন্য নয় - সব শিশুর জন্য। সদ্য পৃথিবীতে এসেই এরা মাতৃভাষার মত শিখছে মুখোশ পরা জীবন যাপন। মন খারাপ না হয়ে পারে, বলুনতো ?  করোনা ভাইরাস যে কত মানুষের মনস্তত্বে আঘাত হেনেছে তার ইয়ত্তা নেই। প্রসঙ্গত, একটা ঘটনার কথা মনে প'ড়ে গেল। সে ঘটনার কথা ভাবলে মন খারাপের মাত্রা তীব্রতর হয়ে ওঠে। কয়েক মাস আগে লকডাউনে গরীব মানুষদের যখন চরম দুরবস্থা তখন খাদ্য সামগ্রি বিতরণের এক অনুষ্ঠানে আমি হাজির ছিলাম। আমার এক পরিচিত শিক্ষক এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা। সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে খাদ্য সামগ্রি বিতরণ চলছে। প্রচুর হতদরিদ্র মানুষ সাহায্য পেয়ে তৃপ্তির হাসি নিয়ে বাড়ি ফিরছে। হঠাৎ সেই শিক্ষক উঠে এসে আমাকে  'এবার আপনি দিন' বলেই সেখান থেকে দ্রুত পায়ে গ্রামের ভেতরে চ'লে গেলেন এবং ফিরে এলেন সব শেষ হয়ে যাবার পর। প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি একদা এই গ্রামেই থাকতেন , তাই হয়ত পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। কিন্তু আসল সত্যটা ওনার মুখ থেকে যখন শুনলাম তখন তার চোখে জল দেখে আমিও কান্না চাপতে পারিনি। আসলে খাদ্যসামগ্রি বিতরণ করতে এক সময় খেয়াল করলেন তার স্কুলের তার সময়ের হেডমাস্টার লাইনে অপেক্ষা করছেন। জীবনে তিনি আথা নত করেননি এবং ছাত্রদের সবসময় মাথা উঁচু ক'রে বাঁচার উপদেশ দিয়ে গিয়েছেন। তার সেই হেডমাস্টারকে লাইনে দেখে তিনি একটা আদর্শের এমন পরাজয় সহ্য করতে পারবেন না বলেই দ্রুত চ'লে গিয়েছেন। গ্রামের মধ্যে গিয়ে সত্যটাও জেনে এসেছেন। হেডমাস্টারমশায়ের একমাত্র ছেলে মুম্বাই-এ ছোটখাটো একটা কাজ করত। লক ডাউনে সেই কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আত্মঘাতি হয়েছে। এখন তাই বৃদ্ধ মাস্টারমশায়ের সংসার অচল। পরিস্থিতির কাছে নীতি, আদর্শের এই অভাবনীয় পরাজয় মেনে নেওয়া কঠিন। তবুও এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতি আমাদের এমন কিছু শিক্ষা দিল যে শিক্ষা হয়ত আগামী দিনের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে। নবমী যাক। দুর্গোৎসব এবছর তাড়াতাড়ি বিদায় নিক - কোন আক্ষেপ থাকবে না। কিন্তু আগামী বছর এতদিনের আনন্দঘন ঐতিহ্য নিয়ে আসুক এই নিশ্চয়তা পেলেই আমরা খুশি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?