মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২০

বিষয় আলু-পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি

 

বিষয় আলু-পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি : অমরনাথ কর্মকার

সম্প্রতি আলু ও পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে রাজ্য তোলপাড় ।প্রতিকেজি আলুর মুল্য ইতিমধ্যেই অর্ধশত ছুঁই ছুঁই,পেঁয়াজ শতকের পথে।এবং আরোও মূল্যবৃদ্ধির অশনি সংকেত শোনা যাচ্ছে । ইতিপূর্বে আলু বা পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে বেশ কয়েকবার কিন্তু এতটা বাড়েনি। সবচেয়ে বড়কথা হ'ল মূল্যবৃদ্ধির এই দীর্ঘ স্থায়ীত্ব চোখে পড়েনি এবং আরও বিষ্ময়কর ব্যাপার হ'ল এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকার,বিরোধীপক্ষ সকলের মধ্যেই কেমন যেন আলুথালু ভাব - এর প্রতিকার নিয়ে কেমন যেন আলস্য - তৎপরতার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০১৪ সালে আলুর দাম বেড়েছিল যখন তখন তার কারন অনুসন্ধানে জরুরী ভিত্তিতে টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছিল সরকারীভাবে এবং কালোবাজারীর সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের জব্দ করতে সরকারী কর্মীরা বাজারে রীতিমত অভিযান চালিয়েছিলেন। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে আলুর অহেতুক মজুতদারী এবং উচ্চমূল্যে আলু বিক্রি বন্ধ করার কড়া সরকারী পদক্ষেপ নেওয়ার সাথে সাথেই পড়ে গেল আলুর আকাল । ইতিপূর্বে মুরগীর লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরাতে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মুরগীর মূল্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। বিগত বছরে আলু-পেঁয়াজের দামে নিয়ন্ত্রণ আনতে সরকারী তরফে নির্দিষ্ট মূল্যে আলু ও পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়েছিল। এবারও আলু-পেঁয়াজ মহার্ঘ্য বটে, তবে অন্যান্যবারের মত এবারে এরা বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়নি। অতএব, বুঝতে অসুবিধা নেই যে আলু-পেঁয়াজের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক কোন কড়া পদক্ষেপ নেই। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভীতির লেশমাত্র নেই । করোনার অতিমারীর প্রভাবে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দুর্বলতার মধ্যে তাদের সহজ উদর পূর্তির মুখ্য উপকরণের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে তাদের যে কি করুন অবস্থা সেকথা বলাই বাহুল্য। বাঙালীর আলুবিহীন জীবন অকল্পনীয় । আলুময় ব্যঞ্জন বাঙালীর রান্নার বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্য – ঝালে ঝোলে অম্বলে সর্বত্র আলুর অবধারিত উপস্থিতি । পেঁয়াজও বাঙালীর রান্নায় অপরিহার্য, বাঙালীর আমিষ মানেই পেঁয়াজের সাহচর্য । আলুর দোষ কী সে সম্বন্ধে ধারণা থাক বা না থাক আলুর গুনাগুণ যে কি বাঙালী মাত্রেই সে সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল । আলু-পেঁয়াজের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং তার এই দীর্ঘ স্থায়ীত্বে বাঙালীর মাথায় হাত । আলুহীন বাঙালীর চোখের সামনে এখন আলোহীন অন্ধকার । একসময় মহার্ঘ্য  পেঁয়াজের পরিবর্তে স্যলাডে আপেল ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে । এবারের অবস্থাও সেই একই পথে। বাস্তবে বর্তমানে আলু আর আপেলের মূল্যে ফারাক নেই। কিন্তু আলুর বিকল্প ? আলুবখরা নিশ্চয়ই নয় । মন্বন্তরের সময় দেখা গেছে মানুষকে শাক-পাতা, মেটে আলু খেয়ে বেঁচে থাকতে । এখন বাজারে গিয়ে দেখবেন সব্জির উচ্চমূল্যের কারনে বাজারে প্রচুর বিকোচ্ছে মেটে আলু, মান-কচু । মনে পড়ে যাচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’-এর কথা । কেন্দ্রীয় সরকার আলু ও পেঁয়াজকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মজুতদাররা নিজেদের ভাঁড়ার ভরাচ্ছে, যার মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, বিশেষ ক’রে করোনার ক্রান্তিকালে অসহায় মানুষদের কাছে এই মূল্যবৃদ্ধি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতই যন্ত্রনাদায়ক।

 

আলু-পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি এর আগে অনেকবারই ঘটেছে। কিন্তু সেই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাজ্য সরকারের নিজস্ব ক্ষমতা ছিল কারন তখন অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে আলু পেঁয়াজের মত অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাজ্য সরকারের নিজস্ব আইনগত ভূমিকা ছিল। আলু ও পেঁয়াজকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পরে মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাজ্য সরকারের ক্ষমতা খর্ব হয়। সম্ভবত সেই কারনেই আলু পেঁয়াজের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরাতে রাজ্য সরকারের ভূমিকা স্বাভাবিকভাবেই চোখে পড়ছে না । আর কেন্দ্রীয় সরকারের এ ব্যাপারে মাথাব্যথা আদৌ আছে ব’লে মনে হয় না। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়ে এই সমস্যার আশু সমাধান করতে বলেছেন। এদিকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের সংশোধন নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত লেগেই আছে।

 

আলু-পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যে রাজনৈতিক খেলা চলছে তার কতটা মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে আর কতটা আসন্ন নির্বাচনে জনসমর্থন পাওয়ার কৌশল তা ঈশ্বরই জানেন। তবে এইসব দ্বন্দ্বের যাঁতাকলে পিষে মরা মানুষগুলোর দিকে মানবিকতার দৃষ্টি নিয়ে না তাকালে করোনার অতিমারী, লকডাউনে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষগুলোর পরিণতি সত্যিই করুন হয়ে উঠবে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ চিরকাল হয়ে এসেছে, চলবেও। কিন্তু উলুখাগড়ার মত সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করাটা বন্ধ হওয়া উচিৎ।

 

আলুর এহেন আলুলায়িত পরিস্থিতিতে সবচেয়ে আনন্দে আছেন বোধহয় রক্তে শর্করা-সমৃদ্ধ মানুষজন। বাঙালীর পাতে আলুবিহীন ব্যঞ্জন কল্পনাতীত। আর বাঙালীর আমিষ মানে অবধারিতভাবে পেঁয়াজ। দিন আনা দিন খাওয়া হতদরিদ্র বাঙালীর সবচেয়ে সস্তার খাবার ‘আলুভাতে ভাত’ কিংবা ‘কাঁচা পেঁয়াজ সহযোগে পান্তাভাত’ও কি তবে জুটবে না ? না হয় বাঙালীর একটু বেশিই আলুপ্রীতি আছে – এব্যাপারে আলুর দোষ নেই – হ’লই বা দোষটা আমাদের রসনার – তাই ব’লে এই বঞ্চনা ! 

 

এই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন আবশ্যক। একটা গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে এই পরিস্থিতি কখনোই মানানসই নয়।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?