ভার্চুয়াল জগত – অমরনাথ কর্মকার
কোভিড-১৯
অতিমারীর প্রভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে আমাদের মত
দেশের মানুষদের মানসিকতারও যথেষ্ট পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। বিশেষ ক’রে ‘ভার্চুয়াল’ শব্দটি অধিকাংশের
মধ্যেই একটা অপরিচিত জগতের মত মনে হচ্ছে যা খুবই স্বাভাবিক। ক্লাসরুমে ছাত্র-শিক্ষক
নেই,অথচ ঘরে বসেই বৈদ্যুতিন পর্দায় ক্লাস করতে হচ্ছে। অফিসের
মিটিং চলছে অনলাইনে। সামাজিক দূরত্ববিধি মানতে গিয়ে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই
বিশ্বকে হাজির করছি। পারস্পরিক দৈহিক সাক্ষাতে অভ্যস্ত জীবন থেকে আকষ্মিক
একাকীত্বের পরিবেশে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে,মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে – এ সবই ঠিক।
কিন্তু সত্যি বলতে কি আমাদের চাহিদা তো এ রকমই ছিল। প্রথম দিকে আমরাও কম্পিউটারের ‘অনুপ্রবেশ’মেনে নিতে পারিনি
অথচ আজ কম্পিউটার ছাড়া জীবন অচল। যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে
আমাদের অন্য জগতে পা রাখা শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। বাস্তব জীবনের সঙ্গে
অবিচ্ছিন্ন সংযোগের মধ্যে দিয়ে প্রযুক্তির উন্নতির হাত ধ’রে প্রতিনিয়ত আমাদের জগত সমৃদ্ধ ও গতিময় হচ্ছে। এই সুবাদেই
একটা ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ করার চেষ্টা বহুদিন থেকেই চলে আসছে। সুতরাং ‘ভার্চুয়াল’শব্দটি কোভিডের
কারনে জন্ম নেয়নি,অনেক আগে থেকেই
এর বাস্তবায়ন একটু একটু ক’রে হতে শুরু
করেছিল।
আচ্ছা
ভেবে দেখুন,টেলিফোন আবিষ্কার হওয়ার পর দৈহিক
সাক্ষাৎ ছাড়াই আমরা দূর-দূরান্তের মানুষের সঙ্গে অতি সহজেই এবং নিমেষে যোগাযোগ
রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছি। তখন থেকেই বোধ হয় আমাদের ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশের শুরু।
তখন থেকেই চিঠি লেখার অভ্যেস হ্রাস পেয়েছে এবং ডাক পরিষেবার গুরুত্ত্ব ক্রমশ কমতে
শুরু করেছে। আর আজ ইমেল আসার কারনে টিম টিম ক'রে জ্বলা ডাক ব্যবস্থা প্রায় নিভু নিভু। ঐতিহ্যের ডাক ব্যবস্থার এই করুন
পরিণতিতে দুঃখ পেলেও সেই দুঃখ পুষে রাখার মানসিকতাকে বোধহয় আমরা অনেকটা অতিক্রমও ক'রে ফেলেছি ইতিমধ্যে। রেডিও,টেলিভিশনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা কি আমাদের ভার্চুয়াল জগতের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ
করে না ?
আসলে এই যে ভার্চুয়াল জগতে আমাদের প্রবেশ (অনেকের কাছে তা ‘অনুপ্রবেশ’ও বটে) তা ঘটেছে
আমাদের অগোচরে এবং অত্যন্ত ধীরে ধীরে,যার ফলে আমাদের মানিয়ে নিতেও অসুবিধা হয়নি। এইভাবে আমরা যোগাযোগ প্রযুক্তির
একটা চরম পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি ইন্টারনেটের হাত ধ’রে।
ইন্টারনেট
কেন্দ্রিক পৃথিবীতে সময়ের সীমাবদ্ধতা নেই,নেই রাত-দিনের বিভাজন । প্রচলিত ধারণাকে পালটে দিয়ে মানবজাতির কল্যাণে কল্পনাতীতভাবে বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তের
সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে নিমেষেই। অর্থাৎ আমাদের ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশের সম্ভাবনা
ত্বরান্বিত করেছে ইন্টারনেট। একথা অনস্বীকার্য যে নানা সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টির
পাশাপাশি এই জগত অনেক সংকটেরও জন্ম
দিয়েছে। যোগাযোগের ধরন ও বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো
মানুষের বাস্তব জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরতার
কারণে মানুষের আচার-আচরণেও পরিবর্তন আসছে। এ পরিবর্তন কখনো ইতিবাচক কখনো আবার তা নেতিবাচক।
সহজে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পথও খুলে গেছে। যন্ত্রকেন্দ্রিক যোগাযোগের কারনে মাধ্যমহীন
যোগাযোগ ও সম্পর্ক ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। বিদেশে থাকা ছেলে বা মেয়ের জন্মদিন পালনের
অনুষ্ঠান বাবা-মা উপভোগ করছেন বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সরাসরি, অথচ বাবা-মায়ের আশির্বাদের হাত সন্তানের মাথায়
পড়ছে না। ভার্চুয়াল জগতে সবকিছুই আছে অথচ কোথাও যেন বাস্তবতার সঙ্গে অনেকটা ফারাক,মনস্তত্বের ওপর যার প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু অভিযোজন
শব্দের বাস্তব ভিত্তিকে মান্যতা দিলে,হয়ত অনেক বছর বাদে এই মনস্তাত্বিক প্রভাব কেটে যেতে বাধ্য।
কল্পবিজ্ঞানের
বিখ্যাত লেখক উইলিয়াম গিবসনের স্বকপোলকল্পিত 'ভার্চুয়াল জগত' আজ কল্পবিজ্ঞানের
গণ্ডী ছাড়িয়ে সটান হাজির আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। মানুষে মানুষে যে যোগাযোগ ও
লেনদেন তা বাস্তব জীবনের বিপরীতে
বিশ্বজনীন করার স্বপ্ন সত্যি সত্যিই আজ সফল হতে চলেছে এবং কোভিড-১৯ নামক
অপ্রত্যাশিত অতিমারীর প্রভাব নিঃসন্দেহে একে ত্বরান্বিত করেছে। কিন্তু প্রশ্ন
হচ্ছে আমাদের মত অনুন্নত দেশে ভার্চুয়াল পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা কতটা? যে দেশে অধিকাংশ মানুষ কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন ব্যবহার তো
দূরের কথা,বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহের জন্যে
হিমশিম খায় সেখানে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে পড়াশুনা চালানো বা নানাবিধ কাজ সম্পন্ন করা
সত্যি দুরুহ। আর শিক্ষার হার কম হবার কারনে অত্যাধুনিক এই ভার্চুয়াল ব্যবস্থার
ইতিবাচক দিক নিয়েও অনেকে সন্দিহান। ফলে উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মত আমাদের
দেশে ভার্চুয়াল যোগাযোগ দ্রুত সর্বজনীন হওয়া সম্ভব নয়।
তবে ধীরে
হলেও ভার্চুয়াল ব্যবস্থার প্রতি নির্ভরশীলতা যে ক্রমশ বাড়ছে তা বলাই বাহুল্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন