বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২০

ইতিহাস ঐতিহ্যে ক্যানিং

 

ইতিহাস-ঐতিহ্যে ক্যানিং : অমরনাথ কর্মকার

 

ক্যানিং – সুন্দরবনের কথা উঠলেই এই জায়গাটির নাম সবার আগে উঠে আসে মুখে।কারন এই শহরটি মূলত সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার হিসাবেই বেশি পরিচিত। কিন্তু এই শহরের যে এক বিশাল ঐতিহাসিক গুরুত্ত্ব রয়েছে সে সম্পর্কে জানার আগ্রহ খুব কম মানুষের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। আর সেই অনাগ্রহের যুক্তিসঙ্গত কারনও রয়েছে যথেষ্ট। কারন ক্যানিং-এর ঐতিহ্য রক্ষায় সরকার,স্থানীয় প্রসাশনের ভূমিকা সেভাবে চোখে পড়ে না। নইলে ক্যানিং এতদিনে হয়ে উঠতে পারত ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান হিসাবে দর্শনীয়।

১৮৫৬ থেকে ১৮৬২এই সময় কালের প্রথম দুবছর ভারতের গভর্নর জেনারেল এবং পরের চার বছর ভাইসরয় ছিলেন চার্লস যোহান আর্ল (লর্ড) ক্যানিং। তাঁর আমলে গঠিত হওয়া পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি’র সুবাদে মাতলা নদীর ধারে তৈরি হয় স্ট্র্যান্ড, হোটেল,কিছু বাড়ি। সুপরিণামদর্শী লর্ড ক্যানিং-এর উদ্দেশ্য ছিল সিঙ্গাপুর বন্দরকে টেক্কা দেওয়া। কিন্তু ১৮৬৭ সাল নাগাদ নদীপথ পরিবর্তনের ফলে সে সব ভেঙে যায়। ইতিমধ্যে ১৮৬২-তে শিয়ালদহ দক্ষিণ (তত্কালীন বেলেঘাটা স্টেশন) থেকে ক্যানিং পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন করে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেল কোম্পানি।  ১৮৮৭-তে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেল কোম্পানি রাষ্ট্রায়ত্ত হয়। আজ ক্যানিং স্টেশন থেকে মিনিট কুড়ির হাঁটা পথে হাইস্কুল পাড়ায় যে জীর্ন ইমারতটি লর্ড ক্যানিং-এর স্মৃতি বিজড়িত হয়ে ইতিহাসের সাক্ষ বহন করছে আসলে সেটি ছিল পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি’-র সদর দফতর।  ১৮৭২-এ সংস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নামমাত্র টাকায় ওই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় দুতিনজন ওই বাড়ি ও সংলগ্ন জমি কিনে নেন। তবে তিনি এবং লেডি ক্যানিং ওখানে গেলে যে বাড়িটিতে থাকতেন,সেটির অস্তিত্বের বেশির ভাগটাই লোপ পেয়েছে। প্রাচিন ভবনটির অবস্থা জীর্ণ, ভবনে ঢোকার মুখে যে বিশাল লোহার গেট ছিল সেটিও উধাও। পুরু দেওয়ালের বিভিন্ন অংশে ফাটল। বাড়ির তিন দিকে বিভিন্ন জায়গায় বটবৃক্ষ বাড়িয়ে চলেছে এই ফাটলের মাত্রা। উঁচু স্তম্ভগুলোর ইট খসে পড়ছে। বাড়ির দুটি তল মিলিয়ে অন্তত পনেরোটি ঘর। কড়িকাঠের ছাদের উচ্চতা অন্তত ১৫ ফুট। ভূগর্ভেও একটি তল আছে। একসময়ে সেটি ব্যবহৃত হত। বহুকাল ব্যবহৃত হয় না। বন্ধ করে রাখা হয়েছে একতলার বেশির ভাগ অংশ। বাড়ির আইনি মালিকানা নিয়ে ধন্দ ও সংশয়ের  নিয়মিতকরণ আজও হয়নি। একদা ব্রিটিশ আমলে পৌরসভার কৌলিন্য মর্যাদা পেয়েছিল ক্যানিং। পরাধীন ভারতবর্ষের তথা বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ সুন্দরবনের উন্নয়নকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বন্দর। তৈরী হয়েছিল চালকল,নুনের গোলা। নানান কারনে ক্যানিং তার পৌরসভার অস্তিত্ব হারায়।

ভৌগলিক কারণে বিদ্যাধরী নদীর একটি শাখা বাঁক নিয়ে মিশেছিল আঠারোবাঁকি ও করাতী নদীতে। তিনটি নদীর সংযোগস্থলে সৃষ্টি হয়েছিল পর্বল একটি ঘুর্ণী। যা কিনা পরে মাতলা নদীর জন্ম দেয়। আর এই নদীর পাড়েই তৈরী হয় মাতলা গঞ্জ। বিভিন্ন সরকারি নথীতে যা মাতলা মৌজা নামে উল্লেখ করা হয়েছে। অতীতের তথ্য অনুযায়ী সে সময় মাতলা নদী এতই খরস্রোতা ছিল যে ভাটার সময় বড় বড় জাহাজ অনায়াসেই নোঙর করতে পারতো মাতলা নদীর পাড়ে। লর্ড ডালহৌসির আমলে ক্যানিং এ বন্দর তৈরীর কাজ শুরু হয়।

ডালহৌসির পরে গভর্ণর হয়ে আসেন লর্ড ক্যানিং। তাঁর আমলে কলকাতার সাথে রেলপথের মাধ্যমে যুক্ত হয় মাতলা এলাকা। অন্যদিকে নদীপথে হলদিয়ার সাথে ও যোগাযোগের কাজ শুরু হয়। লর্ড ক্যানিং এর নাম অনুসারে মাতলা গঞ্জবা মাতলা মৌজারনামকরণ হয় ক্যানিং টাউন। ১৮৬২-৬৩ সালে সর্বপ্রথম ক্যানিং-এ রেলপথ চালু হয়। ১৯৩২ সালের ২৯ ভিসেম্বর স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের আমন্ত্রণে বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর যখন গোসাবায় তাঁর পল্লীউন্নয়ন দেখতে গিয়েছিলেন, তিনি ক্যানিং পর্যন্ত গিয়েছিলেন এই রেলপথেই। ১৮৬২ সালে ক্যানিং কে পৌরসভা করে উন্নয়নের তোড়জোড় শুরু হয়। একদা পৌর শহর হিসাবে তকমা পাওয়া ক্যানিং আজ পঞ্চায়েত এলাকাভুক্ত। ১৯৬৭-৬৮ সালে এক মারাত্মক ঘুর্ণিঝড়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সুন্দরবনে। ফলে ক্যানিং বন্দরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং সব জাহাজ ক্যানিং বন্দর ত্যাগ করে। ফলে ১৮৭২ সালে  লর্ড ক্যানিং-এর স্বপ্নের বন্দরের যবনিকাপাত হয়। সেই সূত্রেই পৌরসভার কাজ ও থমকে যায়। বর্তমান সরকার এই শহরকে পৃথক পৌরসভার মার্যাদা দানের চেষ্টা চালালেও নানান প্রশাসনিক জটিলতায় ক্যানিংবাসীর স্বপ্নের বাস্তবায়ন আজও সম্ভব হয়নি। লর্ড ক্যানিং-এর ঐতিহাসিক বাড়িটি 'হেরিটেজ বিল্ডিং' হিসাবে সরকারীভাবে ঘোষিত হলেও বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষনের সেভাবে হয় না। যার ফলে ইংরেজ আমলের ব্যবহৃত বহু জিনিসপত্র ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে বা বিক্রি হয়ে গেছে প্রশাসনের অজান্তেই।এছাড়াও আরও একটি ইতিহাস জড়িয়ে আছে ক্যানিংকে নিয়ে যা নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।রসগোল্লার পেটেন্ট নিয়ে এত সমালোচনা হয়, অথচ লেডিকেনি নামক জনপ্রিয় মিষ্টান্ন আবিষ্কারের সঙ্গে লেডি ক্যানিং-এর (লর্ড ক্যানিং-এর স্ত্রী,লর্ড ক্যানিং-এর স্ত্রী শার্লট লেডি ক্যানিং)যে নিবিড় সম্পর্ক আছে সে ইতিহাস অধিকাংশেরই অজানা। জানা যায়,লেডি ক্যানিং-এর জন্মদিনের উপহার হিসাবে ভীম নাগ এই মিষ্টি প্রস্তুত করেন যা আজও  বাঙালীর রসনা তৃপ্ত ক’রে চলেছে।     

অতীত ইতিহাসের ঐতিহ্যমন্ডিত ক্যানিং ঐতিহাসিক শহর হিসাবে জনপ্রিয় হোউক,সযত্নে রক্ষিত হোউক যাবতীয় ঐতিহাসিক স্মৃতি, ক্যানিং শহর তাঁর হৃত গৌরব ফিরে পেয়ে উন্নত পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে উজ্জ্বল হয়ে উঠুক এই প্রত্যাশা পূরণের স্বপ্ন সফল করার জন্য সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন দ্রুততার সঙ্গে কাজ করুক এই আন্তরিক ইচ্ছা বোধ হয় সকল ক্যানিংবাসীরই। প্রত্যন্ত সুন্দরবনের মানুষের কাছে ক্যানিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর। এই ক্যানিং শহরে রয়েছে ক্যানিং মহকুমা দপ্তর, রয়েছে মহকুমা হাসপাতাল, জমজমাট মাছের বাজার, বিস্তীর্ণ ফলের বাজার, উন্নত বানিজ্য কেন্দ্র, ডেভিড সাশুন-এর মত উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলেজ, থানা, আধুনিক স্টেডিয়াম,ব্লক অফিস, নামী ক্লাব, সুন্দর রাস্তা-ঘাট সহ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা অর্থাৎ একটি পৌর শহরের যাবতীয় উপাদান এখানে উপস্থিত। ক্যানিং থেকে ঝড়খালী পর্যন্ত সম্প্রসারিত রেলপথ তৈরির অনুমোদন মেলার পর ২০০৯ সালে উদ্বোধন হওয়া রেলপথের কাজ নানান প্রশাসনিক জটিলতায় থমকে আছে। সেই কাজ দ্রুত সম্পন্ন হ’লে সুন্দরবনবাসীর যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নততর হবে তা বলাই বাহুল্য। এই সমস্ত প্রত্যাশা পূরণের আশায় অপেক্ষমান ক্যানিং তথা সমস্ত সুন্দরবাসী। সুতরাং সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকরী উদ্যোগে ক্যানিং তার ঐতিহাসিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পৌর শহরের মর্যাদা পাক এবং অসমাপ্ত রেলপথের কাজ দ্রুত শেষ হোউক এই কামনা সকলেরই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?