বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

নবমীতে মন খারাপঃ অ.না.ক. ১৮/১০/২০১৮

আজ সারাদিন সর্বত্র যেন মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়ির পরিবেশ। বরং বলা ভাল, পাত্রীপক্ষের বাড়ির পরিবেশ ব’লে মনে হ’ল। কারন মাইকে বাজতে শুরু করেছে সানাই-এর সুর। কারনটা সহজেই অনুমেয়। আজ নবমী। আমার মন খারাপের মাত্রা ক্রম হ্রাসমান। সুর ব্যপারটা আজ সকাল থেকেই আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। সুর কখনো মন ভালো করছে, কখনো কাঁদাচ্ছে, হাসাচ্ছে। কি অদ্ভুত! আরও অদ্ভুত সানাই নামক সঙ্গীতের যন্ত্রটা। কে জানে কার মাথা থেকে কিভাবে বেরিয়েছিল এই যন্ত্র সৃষ্টির ভাবনাটা। মন অবশ করা আওয়াজ। পূজোর আনন্দ অবসানের প্রাকমুহূর্তে, নবমী নিশি অতিক্রান্ত না হওয়ার আকুতি জানিয়ে সকলেরই বাসনা উৎসবের আনন্দ আরও একটু স্থায়ী হোক । আজ তাই সবার মন খারাপ । আর আমার তো এমনিতেই মন খারাপ হয়েই আছে । মন খারাপ দিয়ে শুরু করেছিলাম ষষ্ঠী থেকে – সেই মনখারাপ প্রবহমান নবমীর রাত পর্যন্তও । আজ বোধ হয় সকলেরই মন খারাপ । তাদের মন খারাপের নির্দিষ্ট কারন আছে – দেবী দুর্গার ‘অদ্য শেষ রজনী’র বিহ্বলতা । ওসবে আমার মন নেই । আমার মন খারাপের কারন হয়ত আছে কিন্তু শত অনুসন্ধানেও তার হদিশ পাচ্ছি না ।আজ নবমী – বাতাসে বিষাদ – সবার মন খারাপ । জীবনের উৎসবে যারা ব্রাত্য তাদের কথা ভেবে আজ সারাদিন মনের মধ্যে কেমন যেন লাগছে। অবশ্য এই ভাবনার আকষ্মিক উদয় হয়নি। এমনিতেই অকারন মন খারাপের বিষণ্ণতা, তার ওপর সকালে ঘটে গেল একটা ঘটনা। আসলে বিপদ আর বিভ্রান্তি পাশাপাশি চলে। পূজোর ছুটিতে সকালে ঘুম থেকে দেরি করে উঠি। কিন্তু আজ সকালে এক ব্যক্তি এসে হাজির বাড়ির চারদিকে গজিয়ে ওঠা জঙ্গল পরিস্কার করার কাজ করবে ব’লে। পূজোর মধ্যে এসব কাজ করানোর ইচ্ছে নেই। তবুও সে নাছোরবান্দা। অনেক অনুনয়, বিনয়। পূজোর মধ্যে সবাই যখন ছুটির আনন্দ উপভোগ করতে চায়, তখন ওর এই আবেদনে নিশ্চয়ই কোন কারন আছে। কথায় কথায় জানালো ‘পূজোর ক’দিন কাজ নেই ব’লে সংসারে বড্ড টানাটানি, তাই কাজ চাইছি। তাছাড়া মেয়েটার খুব অসুখ’। সামান্য সময় কাজ করিয়ে পুরো দিনের পারিশ্রমিক দিয়ে ওকে ছেড়ে দিলাম পূজোর পরে আবার কাজ করানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে। সত্যিই তো এরকম দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমিকদের কাছে পূজোর দীর্ঘ ছুটি আনন্দের চেয়ে বেশি দুঃখ বয়ে নিয়ে আসে। মন খারাপ হ’ল। তার চেয়েও বেশি রাগ হ’ল সামাজিক উন্নয়নের নামে সরকারী আষ্ফালনের বিজ্ঞাপনের ওপর। গণতন্ত্রের এই বেহাল দশার কথা বেশি না বলাই ভাল। এতে বিড়ম্বনা বাড়ার আশঙ্কা। আজকের মন খারাপের তীব্রতা কম ব’লে অনভ্যাস সত্ত্বেও দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নিয়েছি। ঘুমানোর আগে ছোটোবেলার পূজোর দিনগুলোর স্মৃতি উঁকি মারছিল মনে। বোধ হয় তখন ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। তিনজন বন্ধু মিলে ঠিক করেছিলাম সিগারেট খাব। সকাল থেকেই বুক দুরু দুরু। সিগারেট কিনে প্যান্টের পকেটে কাগজে মুড়ে রাখা আছে। পাছে কেউ দেখে ফেলে সেই আতঙ্কে ছিলাম। বিকেল হতেই বন্ধুর ডাক। বাবার পকেট থেকে দেশলাই-এর প্যাকেটটা নিয়ে চললাম নদীর ধারের এক নির্জন রাস্তায়। চারিদিকে দেখে শুনে ধরিয়ে ফেললাম সিগারেট তিনজনেই। একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা – এক অদ্ভুত শিহরন। সাথে কারো দেখে ফেলার ভয়। এবং ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়’ এই প্রবাদকে সত্যি প্রমাণ ক’রে সেখানে অকস্মাৎ হাজির আমার বাবার অতি পরিচিত এক ভদ্রলোক এবং আমাকে সিগারেট মুখে দেখেই থমকে দাঁড়ালেন আমার সামনে। আমার তো তখন ভয়ে প্রায় জ্ঞান হারানোর মত অবস্থা। মুখ থেকে সিগারেট ফেলে ফ্যাল ফ্যাল ক’রে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ভদ্রলোকের দিকে। আমাদের কান ধরিয়ে উঠবোস করিয়ে ছেড়ে দিলেন। সে যাত্রায় মুক্তি পেলাম বটে কিন্তু বাবা জেনে গেলে কি হবে তার পরিণাম চিন্তা ক’রে হৃৎপিন্ডের স্পন্দন বেড়ে গেল। পরে বুঝেছি ভদ্রলোক বাবাকে জানাননি। তবে অনেক বড় হয়েও আমি সেই ভদ্রলোকের মুখোমুখি হবার সাহস পায়নি। আমি কিন্তু ধূমপানে আসক্ত নই। জানিনা সেই ঘটনার কোন প্রভাব এর মধ্যে আছে কি না। ঘুমের আগে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম বাবা-কাকার মুখগুলো যাঁদের হাত ধ’রে ছোটোবেলায় যেতাম পূজো দেখতে। একেই বোধ হয় বলে স্মৃতিবিলাস। এই বিলাসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল সন্ধের সময়। মন খারাপটা অনুভূত হ’ল কিন্তু তীব্রতা কম। তবে সন্ধের পরে যে ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি তা হ্রাসমান অকারন মনখারাপকে টেক্কা দিয়ে গেছে। রাত্রে রাস্তায় বেরিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হতে ও আর আমি একসঙ্গে হাটতে বেরোলাম। উদ্দেশ্য একটু মনের কথা আদান-প্রদান। নবমীর ভিড়ে তখন রাস্তাঘাট সরগরম। একসময় বন্ধু বলল ‘চল আইসক্রীম খাই’। আমি সাধারণত আইসক্রীম খাই না। কিন্তু বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে না করলাম না। ওখানে অনেকগুলো আইসক্রীমের দোকান। কিন্তু বন্ধুকে দেখলাম অনেকটা ভেতরে গিয়ে একটি ছেলের কাছ থেকে আইসক্রীম নিল। জিজ্ঞেস করলাম ‘অত দূরে যাওয়ার দরকার কি ছিল ? সামনেই তো দোকান আছে অনেক’। বন্ধু বলল ‘খা। পরে বলছি’। গল্প করতে করতে আইসক্রীম শেষ করলাম। তারপর বন্ধুটি আমার প্রশ্নের জবাব দিতে শুরু করল বেশ গুরুত্ব সহকারে। আসলে ঐ আইসক্রীম বিক্রেতা ছেলেটি ওর পরিচিত। তার থেকেও বড় কথা ও নিজে উদ্যোগী হয়ে ওদের ক্লাব থেকে ওকে ওখানে বসার ব্যবস্থা ক’রে দিয়েছে। কারন ছেলেটি ক্যান্সারে আক্রান্ত। চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্য ও ছেলেটাকে ক্লাবের সাহায্য নিয়ে সবরকম সহযোগিতা করে। শুনে ভীষণ খুশী হলাম। পিঠ চাপড়ে ধন্যবাদ জানালাম অজস্র। ছেলেটার কথা ভেবে মনটা খারাপ হ’ল খুব। রাত্রে বাড়ি ফিরে বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ক্যান্সার আক্রান্ত সেই আইসক্রীম বিক্রেতার মুখ। নবমীর নিশাবসান আসন্ন ব’লে চারিদিকে মানুষের উদ্দীপনার মধ্যেও একটা বিষাদের মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রতি বছর নবমীতে ‘যেওনা নবমী নিশি’র আকুতি দেখতে দেখতে চুলে শুভ্রতা আসতে শুরু ক’রে দিল। আজ আমার মনে যে বিষন্নতা তা নবমীর রাতের জন্য নয়, ছুটি শেষ হয়ে আসছে ব’লে। এবার বোধ হয় অকারন মন খারাপের দিন ফুরিয়ে আসছে। এবার যে মন খারাপ হবে তার মধ্যে কারন থাকবে। হ্যাঁ, সেই আইসক্রীম বিক্রেতা ছেলেটার মুখ এখনোও আমার সামনে ভাসছে। কিন্তু এইমাত্র একটা মস্ত ভুলের জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে। যে বন্ধুর সঙ্গে এত গল্প হ’ল, যার মহানুভবতা নিয়ে এত কথা লিখলাম এতক্ষণ, তার নিজের কথা তো জানা হ’ল না। বন্ধুটির নাম নিশিকান্ত। খুব ভাল ছিল পড়াশুনায়। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং করেছিল। এইমাত্র মনে পড়ল ক’দিন আগেই আমার এক বন্ধু জানিয়েছিল নিশিকান্ত’র নাকি মানসিক চিকিৎসা চলছে। আত্মহত্যার চেষ্টাও নাকি করেছিল কিছুদিন আগে – চাকরিটাও নেই। খুব খারাপ লাগছে, এত খবর নিলাম অথচ ওর দুর্দশার খবরটাই নিতে ভুলে গেলাম। এবার যে তীব্র মন খারাপ হতে শুরু করেছে তার পেছনে যথেষ্ট ও যথার্থ কারন আছে। সত্যিই কিছু ভালো লাগছে না এবার। লেখা থামালাম। শুভরাত্রি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?