অষ্টমীতে মন খারাপঃ অ.না.ক. ১৭/১০/২০১৮
গতকাল উৎসবের সুর ছিল সপ্তমে। আজ একেবারে তুঙ্গে। কারন
অষ্টমীতে আজ উৎসব মধ্যগগনে। সুতরাং চারিদিকে চূড়ান্ত মাদকতা। আর স্বাভাবিকভাবেই
আমার মনখারাপের মাত্রাও বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই। সারাদিন যথাসম্ভব নিজেকে অন্য কাজে
ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেছি মনখারাপটাকে ভুলে থাকার জন্য। হারমোনিকায় ‘জোনাকী কি
সুখে ঐ ডানা দুটি মেলেছ...’ গানের সুরটি বাজিয়ে, রেকর্ডিং ক’রে বারবার শুনেছি।
গানটার কথা আমি ষষ্ঠীতে লিখেছিলাম। গানের কথাগুলো আমাকে নতুন ক’রে মন্ত্রণা
দিয়েছে। বলা যায় মনখারাপ থেকে মুক্তি পাবার জন্য এই গানের কথাগুলো, অন্ততঃ আমার
জন্য, একেবারে টনিকের মত। এতকিছুর পরেও মনখারাপ আবার ফিরে এসেছে। বাড়িতে বসেই কানে
আসছিল বিভিন্ন রকমের গান। লক্ষ্য করলাম আজকে প্যান্ডেল থেকে যে গানগুলো ভেসে আসছিল
তা গত দু’দিনের থেকে একটু যেন ভিন্ন। আজ সারাদিনই রাস্তায় প্রচুর লোকের আনাগোনা।
সবার মধ্যেই দুর্গোৎসবের ফুরফুরে মেজাজ। জানলা দিয়ে রাস্তা দেখছিলাম। মনে মনে ওদের
আনন্দে নিজেকে মিলিয়ে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। মনখারাপটা প্রায়
জগদ্দল পাথরের মত মনের গভীরে জেঁকে ব’সে আছে – কিছুতেই টলানো গেল না। মন খারাপ এমন
একটা ব্যাপার যে এই সময় মন খারাপ করার মত ঘটনা, স্মৃতিগুলো বেশি বেশি ক’রে ভিড়
করে। অনেকটা ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতন। আগে অষ্টমীর রাত মানে ছিল আনন্দের
নির্যাস নিংড়ে নেওয়ার সময়। তাই সারাদিনই চলত উৎসবের উন্মাদনা। এখনোও আছে। তবে হয়ত
বয়সের কারনে উচ্ছ্বাসের ডানা মেলা সাজে না বলেই আমার মধ্যে পুজোর উচ্ছ্বাস থাকে
না। কিন্তু মনখারাপ হবার কারন? আমি বলছি আমার মনখারাপের নির্দিষ্ট কারন খুঁজে পাই
না অথচ মনস্তত্ত্ব বলছে মনখারাপের পেছনে অবধারিতভাবে কোন না কোন কারন বিদ্যমান।
কেউ যদি সেটাকে অকারন ব’লে চালাতে চায়, তাহলে বুঝে নিতে হবে সে কারন বলতে নারাজ।
আমার মনখারাপের পেছনে তাহলে নিশ্চয় কোন কারন আছে। মুশকিল হচ্ছে কারনটা আমি নিজেই
বুঝতে পারি না। সন্ধ্যেবেলা আজ এসেছিলাম জয়নগরে। স্ত্রীর অনুরোধে (আদেশ বলাটাই বোধ
হয় এক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত) একটা ভ্যান রিক্সা ভাড়া ক’রে বেরিয়েছিলাম ঠাকুর দেখতে।
মানুষের ঠাসাঠাসি ভিড়ে পাঁচ মিনিটের পথ যেতে সময় লাগছিল এক ঘন্টা। পুজোমন্ডপে
ঢোকার আগে শম্বুক গতির বিরক্তিকর দীর্ঘ লাইন। প্রতিমা দর্শনের জন্য এতটা ধৈর্য
আমার নেই, কিন্তু অধৈর্য প্রকাশের সাহসও আমার নেই। অতএব, মনপ্রাণ দিয়ে ঠাকুর ‘দেখলাম’।
অষ্টমীর সন্ধ্যায় মানুষের ভিড়ে রাস্তা প্রায় স্তব্ধ। এর মধ্যেই পেছন থেকে শুনতে
পেলাম অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ। অবাক হলাম অ্যাম্বুলেন্স কে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়ার
জন্য অধিকাংশের মধ্যেই কোন তৎপরতা নেই। পূজো কমিটির সহৃদয় এক স্বেচ্ছাসেবককে
দেখলাম আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন অ্যাম্বুলেন্সটাকে দ্রুত পার করিয়ে দেওয়ার জন্য।
জানিনা কোন দুর্ভাগা এই অষ্টমীর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হ’ল! সেই দুর্ভাগার কথা ভেবে
কষ্ট লাগল। মনখারাপ তো আছেই। এই দৃশ্য ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে’র মত মনে হ’ল। জয়নগর
বহু প্রাচিন এবং ঐতিহ্যশালী শহর । ব্রিটিশ আমলে তৈরি বাড়িঘরের মধ্যে প্রাচীনের গন্ধ। এখানে অনেক বিপ্লবীর
জন্ম হয়েছে। সুতরাং এখানকার পুজোর মধ্যে বনেদিয়ানার লক্ষণ বেশ স্পষ্ট। তাই আগ্রহ
নিয়ে এগুলো দেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওই। মনের মধ্যে উৎফুল্লতা নেই। পুজোয় ঘুরতে
বেরিয়ে আমার চোখ চলে যায় ছোট ছোট দৃশ্যের দিকে যার মধ্যে থাকে এক অদ্ভুত বৈপরিত্য।
আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সঙ্গের বাচ্চাটার
জন্য বেলুন কিনতে গিয়ে যে দোকানীকে পেলাম সে আট ন’ বছরের একটি মেয়ে। প্রথমে
ভেবেছিলাম তাকে বসিয়ে রেখে তার বাবা হয়ত কোথাও অন্য কাজে গেছে। কিন্তু দেখলাম তার
বাবা অন্য দোকান দিয়েছে মেয়েকে বেলুন বিক্রির ভার দিয়ে। যার জন্য বেলুন কিনছি
মেয়েটি তার থেকে হয়ত সামান্য কয়েক বছরের বড়। বেলুন বিক্রিতে তার মন নেই। চোখ পড়ে
আছে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া সুবেশী ছেলেমেয়েদের দিকে যারা মেতেছে পুজোর আনন্দে। মনে
মনে কষ্ট হ’ল খুব। বেলুন কিনলাম। দামটা মিটিয়ে দিয়ে তার বাবাকে ডেকে অতিরিক্ত বেশ
কিছু টাকা হাতে দিয়ে বললাম ‘এটা দিয়ে মেয়ের জন্য কিছু কিনে দেবেন’। আমার স্ত্রীর
মানসিক কষ্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটে গেল চোখের জলে। আমরা কষ্ট পেলাম বটে, কিন্তু কে জানে
হয়ত ওদের দারিদ্র্যের কষ্ট, আমরা যা ভাবছি, তার থেকেও অনেক বেশি। মেয়েটির নাম
দিয়েছি অষ্টমী। ওর একটা ছবিও তুলেছি যেখানে ওর মুখ আড়াল করা। এখন অনেক রাত। তবুও
লিখছি। মন খারাপ তাতে কি। মন খারাপ মনে মনে রাখতে চাই না। তাই লিখছি। এবার বোধ হয়
মনখারাপ ক্রমশ কমবে। কাল তো নবমী। প্যান্ডেলের দুর্গার বিদায় ক্রমশ কাছে আসছে। আর
আমাদের দুর্গারা তো থাকবেই। শুভরাত্রি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন