রবিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৮

চেয়ারহীন শ্রেণিকক্ষের প্রাসঙ্গিকতা



চেয়ারহীন শ্রেণিকক্ষের প্রাসঙ্গিকতা 

                                                                            অ.না.ক. ২৮/১০/২০১৮



ক্লাসরুমে এখন থেকে শিক্ষকের জন্য কোন চেয়ার থাকবে না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা দপ্তরের সাম্প্রতিক এই নির্দেশিকাকে কেন্দ্র ক’রে শিক্ষা মহলে নানান বিতর্ক শুরু হয়েছে। শিক্ষকের দাঁড়িয়ে পড়ানোর স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তির ঝড় উঠতে শুরু করেছে শিক্ষক মহলে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ক্লাসে শিক্ষকের জন্য চেয়ার না রাখার পেছনে কি যুক্তি আছে আবার এর বিপক্ষের যুক্তিই বা কি।
প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা হয়ত জানেন চেয়ারে ব’সে পড়ানোর সময় ক্লাসের বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষকের পড়ানোর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের কৌশল।  কিন্তু একথা ঠিক যে চেয়ারে ব’সে পড়ানোর সময় পেছনের দিকের বা কোন এক বা একাধিক বিশেষ অঞ্চলে উপবিষ্ট ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষকের দৃষ্টিগোচর না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বলতে বাধা নেই, পড়া না করা, ফাঁকিবাজ, দুষ্টুমিতে সিদ্ধহস্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যেই পেছনের বেঞ্চে বা শিক্ষকের দৃষ্টির আড়ালে বসার প্রবণতার সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলেছে। উদ্দেশ্য অবশ্যই শিক্ষকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে শিক্ষকের পড়ানোকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দুষ্টুমি করা বা পড়ায় ফাঁকি দেওয়া। সুতরাং ক্লাসে শিক্ষকের বসার জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা না থাকলে পড়ানোর সময় শিক্ষকের দৃষ্টি সমস্ত ক্লাসের ওপর নিবদ্ধ থাকতে বাধ্য এবং হাঁটা-চলার মাধ্যমে শিক্ষক প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর একেবারে কাছে পৌঁছে যেতে পারেন যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষকের পড়ানোর প্রতি ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণ করানোর সুযোগ বাড়ে।  আরোও বড় ব্যাপার হ’ল মনস্তত্বের বিচারে, দাঁড়িয়ে কথা বললে শরীরী ভাষার সঙ্গে বক্তব্যের সাবলীলতা বাড়ে যা শ্রোতার দৃষ্টি আকর্ষণ করার কাজে বেশি কার্যকরি হয়। সম্ভবত সেই কারনেই কোন আলোচনা সভায়, বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখার রীতি প্রচলিত। এমনিতেই অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা পড়ানোর সময় ক্লাসে একটুও বসেন না, দাঁড়িয়ে বা ধীর পদক্ষেপে ক্লাসময় পায়চারী করতে করতে শিক্ষাদানে অভ্যস্ত। আমাদের সময় কোন কোন শিক্ষককে দেখেছি ক্লাসে এসে পড়ানো বাদ দিয়ে চেয়ারে ব’সে আরাম ক’রে ঘুমিয়ে নিতেন। এমনকি কাউকে দিয়ে ঘাড় মাথা টিপিয়ে নিতেন। ততক্ষণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চলত নিচু স্বরে গল্প, আড্ডা, দুষ্টুমি। এখনকার স্কুলগুলিতে এরকম শিক্ষক থাকাটাও অসম্ভব নয়। ক্লাসে চেয়ার না থাকলে শিক্ষকের এই ধরনের প্রবনতা থেকে ১০০ শতাংশ মুক্তি মিলবে।
দাঁড়িয়ে পড়ানোর যথেষ্ট সঙ্গত বিপক্ষ যুক্তিও রয়েছে। শিক্ষক দির্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়ানোর পর ক্লান্ত বোধ করতেই পারেন, বিশেষ ক’রে বয়স্ক শিক্ষক বা গর্ভবতী শিক্ষিকার ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। কিংবা কিছুক্ষণ পড়ানোর পরে শিক্ষক ছাত্রদেরকে কিছু কাজ দিলেন ক্লাসে করার জন্য। সেই সময়টুকু শিক্ষক সম্পূর্ণ দাঁড়িয়ে বা চলালচল ক’রে কাটাবেন তার যৌক্তিকতা কোথায় ? সে্ক্ষেত্রে শিক্ষক তাঁর চেয়ার সরিয়ে সুবিধামত জায়গায় ব’সে নজরদারী করতেই পারেন। কিন্তু ক্লাসে যদি চেয়ারই না থাকে তাহলে শিক্ষকের কাছে এ এক বড় বিপদের কারন। তাহলে কি হাঁটুর সমস্যা আছে বা বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে শারীরিক অসুবিধা বোধ করেন এমন শিক্ষকদের শিক্ষকতা ছেড়ে দেওয়ার দিন আসন্ন ? আমাদের রাজ্যে একজন শিক্ষককে প্রতিদিন গড়ে ৫-৬ টি ক্লাস নিতে হয় এবং বিরতিহীন ভাবে ৩-৪টি ক্লাস অনেক শিক্ষককেই নিতে হয়। সুতরাং এতটা দীর্ঘ সময় একটানা দাঁড়িয়ে পড়ানো একজন সুস্থ শিক্ষকের পক্ষেও কতটা সম্ভবপর তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্নচিহ্ন আছে। আরোও একটি আপাত গুরুত্বহীন কথাও বলা জরুরী। একজন পুরুষ শিক্ষক পড়ানোর সময় যদি ক্রমাগত ছাত্রীদের কাছে দাঁড়ান তাহলে ছাত্রীদের কাছে তা অস্বস্তির কারন হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয় মোটেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রবহমান প্রথাকে রাতারাতি পাল্টে ফেলার আকষ্মিক নির্দেশে শিক্ষক মহলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠাটা স্বাভাবিক। নিঃসন্দেহে শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিকতা এসেছে, এসেছে শিক্ষণের বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি, অনেক প্রগতিশীল দেশে তার প্রয়োগও হচ্ছে। ক্লাসে শিক্ষকের জন্য চেয়ার না রাখার যৌক্তিকতা হয়ত এই কারনেই প্রাসঙ্গিক। কিন্ত আমাদের দেশে তা প্রয়োগের হটকারী সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
ক্লাস থেকে শিক্ষকের চেয়ারকে রাতারাতি নির্বাসনে না পাঠিয়ে চেয়ার রেখেই শিক্ষককে দাঁড়িয়ে পড়ানোর নির্দেশ জারি করলে হয়ত সাপও মরে লাঠিও ভাঙে না। প্রয়োজনে শিক্ষক বসবেন, কিন্তু সাধারণভাবে তাকে দাঁড়িয়েই পড়াতে হবে এবং তা নজরদারী করবেন প্রধান শিক্ষক বা ভারপ্রাপ্ত কেউ, প্রাথমিকভাবে এমন নিয়ম চালু করলে হয়ত পদক্ষেপটা হবে অনেকটা মসৃণ।    

অমরনাথ কর্মকার

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?