সপ্তমীতে মন খারাপঃ অ.না.ক. ১৬/১০/২০১৮
উৎসবের সুর আজ সপ্তমে। আমার মন খারাপের সুরও ক্রমশ চড়া হ’তে
শুরু করেছে। সপ্তমীতে কথা দিয়েছিলাম পরিবারের লোকেদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরোব।
সুতরাং নতুন জামা-জুতো পড়ে বেরিয়ে পড়লাম সদলবলে। প্রতিবারের মত এবারও পূজোয় আমার
নতুন জামা প্যান্ট কেনা হয়েছে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এবং আমার অজান্তে। বিশেষ ক’রে
পুজোর সময় নতুন জামা-প্যান্ট পড়তে আমার ভালো লাগে না। কিন্তু নিরুপায়। এক্ষেত্রে প্রচলিত
বাংলা বাগধারার সামান্য পরিবর্তন ‘কর্ত্রীর ইচ্ছেয় কর্ম’। এখানে কর্তার ভূমিকা
মূল্যহীন। পূজোয় নতুন জামা কাপড় উপহার দিতে আমার কার্পন্য নেই। কিন্তু সবাইকে দিই
না। দিই বাচ্চাদের। আর আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়
তাদেরকে। যেহেতু উপহার প্রদানের পুরো নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ আমার হাতে থাকে না, তাই
মাঝে মাঝে ব্যতিক্রমও ঘটে। আজ দুপুরে দেখছিলাম এবার পুজোয় আমার ছেলের পাওয়া জামা-প্যান্ট-জুতোর
পসরা। অনেকগুলো। আমার এবং বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া। দেখছিলাম কিন্তু
মন চলে গিয়েছিল আমার ছোটোবেলায়। বেশ মনে পড়ছে, পুজোর সময় আমাদের পাশের বাড়ির
ছেলেদের সুন্দর ইস্ত্রী করা টেরিকটের ফুলপ্যান্ট দেখে আমার খুব ইচ্ছে হ’ত ওরকম
প্যান্ট পড়তে। কিন্তু বাবার দেওয়া হাফ প্যান্ট ছাড়া কিছু জুটত না। আরোও একটা
ব্যাপার আজও পর্যন্ত আমাকে অবাক করে। সত্যি বলতে কি আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে আমি
কোনদিন পুজোয় জামা-প্যান্ট উপহার পেয়েছি কি না মনে করতে পারি না। এমনকি আজও
পর্যন্ত সেই ট্র্যাডিশন চলছে। বলতে বাধা নেই, অর্থবান অনেক আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেও
পাইনি। আমার ঘনিষ্ট সহপাঠী দু’একজন জানে, আমি স্কুলে জামা ইন করে যেতাম না, কারন
কোনোরকমে স্কুলের ইউনিফর্ম জোগাড় হলেও বেল্ট ছিল না ব’লে প্যান্টে দড়ি বেঁধে
যেতাম। না, এসব আমার মন খারাপের আদৌ কোন কারন নয়। বরং এই কথা গুলো ভেবে আমি আনন্দ
পাই, কারন এগুলো জীবনের ব্যতিক্রমী দিক যা সবার জীবনে আসে না। এখন সত্যিকারের অসহায়কে সাহায্য করার খুব ইচ্ছে
হয়, কিন্তু আর্থিক সামর্থ ততটা নেই ব’লে সাহস পাই না। পুজোর সময় এলে রাস্তা দিয়ে
চলার সময় মানুষের পোশাকআশাকের বৈচিত্র আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখি, দেখতে ইচ্ছে হয়।
আর মনে মনে মানুষের আর্থিক বৈষম্যের চিত্র কল্পনা করি। বাজারে চায়ের দোকানের
হারুকে প্রতিদিন দেখি একটা ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে দিয়ে চা বানাতে, আজ সপ্তমীর সন্ধ্যায়
ওর গায়ে যে নতুন জামাটা দেখলাম, আর পাশের বাড়ির ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ঈমনের গায়ের
নতুন জামার মধ্যে পার্থক্য করতে গিয়ে বুঝতে অসুবিধা হ’ল না ঈমনের গায়ের জামার মূল্য আর হারুর জামার দামের
বিস্তর ফারাক – প্রায় আকাশ পাতাল। কিন্ত হারুর মুখ থেকে ঠিকরে বেরনো আনন্দ ঈমনের
চেয়ে ঢের বেশি। এত কিছু ভাবছি, দেখছি অথচ আমার মন খারাপের সঙ্গে এসব দৃশ্যের কোন
প্রভাবই নেই। প্যান্ডেলের কারুকাজ দেখছি, অবাক হচ্ছি অথচ মন খারাপ কিছুতেই পিছু
ছাড়ছে না। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাঝে মাঝে মন খারাপ করে দেয় স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু তাতো যে কোন সময়ই হতে পারে। কিন্তু ঠিক
পুজো এলেই অবধারিতভাবে মন খারাপ যে কেন হয় সেটাই আমাকে ভাবিয়ে তোলে। আজ বিকেলের
দিকে রাস্তার ধারে এক বৃদ্ধাকে দেখলাম বাটি হাতে বসে ভিক্ষা চাইতে চাইতে পড়ে
যাচ্ছেন, আবার সোজা হয়ে বসে ভিক্ষা চাইছেন। ওনাকে প্রায়ই ওখানে দেখি। কিন্তু এরকম
অসংলগ্ন দেখিনি। কৌতুহলে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম তিনি ভিক্ষা চাইতে চাইতে
ঘুমিয়ে পড়ছেন – আবার জেগে উঠছেন। হাতে পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে বললাম বাড়ি চলে যান, আজ আর
ভিক্ষা করতে হবে না। আমি ওনাকে চিনি, ছেলে বড়লোক অথচ মাকে দেখে না। তাই বাধ্য হয়েই
ভিক্ষা করেন। ইচ্ছে থাকলেও মানুষকে সাহায্য করাও আজকাল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারন
প্রায়শই ভিক্ষাবৃত্তির নামে অনেকক্ষেত্রে ভন্ডামি চলে। তাই সহজে কেউ সাহায্যের হাত
বাড়ায় না। ফলে সত্যিকারের অসহায়রা ভিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। এই ঘটনা দেখে মন খারাপ
হওয়ারই কথা। হয়েওছিল। কিন্তু তার সঙ্গে উৎসবের তো কোন সম্পর্ক নেই ! ঠাকুর দেখে
ফেরার সময় সর্টকাট করার জন্য একটা গলির পথ ধরেছিলাম। হঠাৎ পাশের বাগান থেকে শিউলি
ফুলের সুগন্ধ ভেসে এল। মন ভ’রে গেল। আর ঠিক সেই সুগন্ধ পাওয়ার সাথে সাথে মনটা আরোও
বিষণ্ণ হয়ে উঠল। কেন ? জানি না। নাগরিক জনারণ্যে থেকে এখন আর শরতের কাশফুল দেখা
হয়ে ওঠে না। আগের মত শরতে আর শিউলির সুবাস নেওয়া হয় না। তাই আচমকা এই সৌরভ মনটাকে
টাইম মেশিনে পৌঁছে দিল আমার শৈশবে – শিউলি ঝরা শরতের প্রভাতে। এমনিতেই মন খারাপ
তার ওপর শিউলির ঘ্রান – দুয়ে মিলে চরম বিষন্নতা। কাল অষ্টমী। জানিনা কাল মনখারাপের
পারদ কতটা চড়বে। শুভরাত্রি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন