ষষ্ঠীতে মন খারাপঃ অ.না.ক. ১৫/১০/২০১৮
একটা জরুরী দরকারে আজ ষষ্ঠীর সকালে বাজারে যেতে হয়েছিল। সাইকেলে যেতে যেতে রাস্তার ধারে লাগানো পূজো মন্ডপের মাইকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসছিল। বরাবরই পূজো প্যান্ডেলের বিচিত্র গান শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। বিশেষ ক’রে যখন আবেগভরা রবীন্দ্রনাথের গান ভেসে আসে আমি আপ্লুত হয়তে যাই। অজ্ঞাত কারনে হওয়া মন খারাপের সঙ্গে এ যেন ঘৃতাহুতি। গানগুলো শুনতে শুনতে কখনো কখনো চোখ ভিজে গিয়ে চশমার কাচ বাষ্পায়িত হয়ে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। এই সময় রবীন্দ্রনাথকে যেন আরোও বিষ্ময়কর লাগে। বাজার থেকে ফেরার পথে একটা গান মনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। গানটি ইতিপূর্বে বহুবার শুনেছি অথচ আজ এই গানের কথাগুলো শুনে মনে মনে রবীন্দ্রনাথকে প্রনাম জানালাম – জোনাকি কি সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ/ও জোনাকি কী সুখে ওই আঁধার সাঁঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ/ তুমি নও তো সূর্য নওতো চন্দ্র/ তোমার তাই বলে কি কম আনন্দ ... শুনতে শুনতে ভুলেই গেলাম আমার মন খারাপের কথা। একটু আগেই একটা পূজো প্যান্ডেলের উদ্বোধন মঞ্চে দেখলাম আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধু প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত ক’রে বসে আছে। সে এখন স্কুলের হেডমাস্টার। চারদিক থেকে ‘মাননীয়’, ‘মহাশয়’ ইত্যাদি সম্বোধন ভেসে আসছে। বেশ ভালই লাগছিল বন্ধুর সামাজিক মর্যাদার রমরমা দেখতে। কিন্তু গানটা শোনার পর আমার আর এক সহপাঠী বন্ধুর মুখ বার বার ভেসে উঠতে লাগল। গানের কথাগুলোর সঙ্গে আমি কোথায় যেন অম্লানের মিল পেলাম। ও থাকে ব্যারাকপুরে। ফোনে মাঝে মাঝে কথা হয়। ওর অ্যান্ড্রয়েড ফোন নেই ব’লে ফেসবুক/হোয়াটসঅ্যাপের মত সামাজিক মাধ্যমে ও অনুপস্থিত। অম্লান একটা প্রাইমারী স্কুলের সামান্য বেতনের পার্শ্বশিক্ষক। বহুদিন ওর সঙ্গে দেখা ছিল না। দু’দিন আগে অফিস ছুটি ছিল ব’লে দেখা করতে গিয়েছিলাম ওর সঙ্গে। গিয়ে দেখলাম ছোট্ট একটা ঘরে ও একাই থাকে। অকৃতদার । বাবা-মা অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। অগোছালো ঘরে শুধু বই আর বই। অনেক গল্প হ’ল। পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের সম্বন্ধে কথা হ’ল। আমি একটা কথাই বলেছিলাম ‘তোর মত ছেলে আজ প্রাইমারী স্কুলের পার্শ্বশিক্ষক একথা মেনে নিতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে’। প্রশ্নটা শুনে অম্লানের এতটুকু প্রতিক্রিয়া পেলাম না – একেবারে নির্বিকার। গতকাল, পঞ্চমীর দিনে, আমার অনুরোধ রাখতে অম্লান আমাদের বাড়িতে এসেছিল। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে বাইরে অবাকই হলাম। অম্লান এসেছে। পড়নে পুরোনো পাজামা, পায়ে প্রায় ছেঁড়া চপ্পল। বেশ অবাকই হলাম। অবশ্য বন্ধুবান্ধবদের মুখে আগেই শুনেছি ও নাকি এভাবেই চলাফেরা করে। যথারীতি আপ্যায়ন, গল্পগুজব। এসবের পরে একবার লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি রে পোশাক আসাক পালটা। পূজোর সময় এই পোশাকে রাস্তা ঘাটে চললে লোকে কি বলবে!’ অম্লান বদনে অম্লান আমায় পাল্টা প্রশ্ন করেছিল ‘পূজোতে অর্থাভাবে যারা নতুন জামাকাপড় কিনতে পারে না তাদের দেখে তোর কষ্ট হয় না ?’ আমি বলেছিলাম, ‘তা তো হয়, ভীষণ মন খারাপ হয়’। অম্লান অদ্ভুত ভাবে বলেছিল ‘আমাকে দেখে তুই কষ্ট পাচ্ছিস, কিন্তু ওরা আমাকে দেখে সান্ত্বনা পায়’। একথা শোনার পর আর কিছু বলতে পারিনি। অম্লান আমাদের ব্যাচের তুখোর ছাত্র ছিল। আজ যে বন্ধুকে পূজোর উদ্বোধন করতে দেখেছি অম্লানের কাছে সে ছিল নিতান্তই তুচ্ছ। অথচ অম্লান তার কেরিয়ার নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবেনি – এখনোও ভাবে না। শুধু পড়াশোনা করেছে, করেই চলেছে। পত্র-পত্রিকায় মাঝে মাঝেই লেখা বেরোয়। নিজেকে আড়াল করে রেখেছে অন্ধকারে। অথচ আমি, আমার মত ওর পরিচিতরা জানে অম্লান কি অসম্ভব প্রতিভাধারী। গানটা শুনে অম্লানকে মনে হল ও ‘জোনাকি’। গতকাল ফেসবুকে আমার এক সহকর্মী লিখেছিল পূজো এলে আমার মত তারও মন খারাপ হয়। এর কারন জানতে চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, পুরোনো সুপ্ত দুঃখ, ক্ষোভ, ব্যথা এগুলো হয়ত এই উৎসবের আলোতে প্রাণ ফিরে পায়। তাই এই মন খারাপ। অবশ্য এর সঠিক ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই কারন আমার ক্ষেত্রে এই মন খারাপের কারন আজও পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারিনি। তবে একথা ঠিক যে উৎসবের এই আনন্দযজ্ঞে যখন চারদিক আলোকময় হয়ে ওঠে তহন অমলকান্তিদের কথা খুব মনে পড়ে যারা অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের পথ খুঁজে পায়নি। জানিনা সেই কারনেই মন খারাপ হয় কি না। আবার অম্লানের ক্ষেত্রে ‘তুমি নও তো সুর্য নও তো চন্দ্র/ তোমার তাই বলে কি কম আনন্দ...... তোমার যা আছে তা তোমার আছে/ তুমি নও তো ঋণী কারো কাছে’ এই লাইনগুলো ভেবে আনন্দও পাই। ষষ্ঠীতে আজ বাড়িতেই ছিলাম। সপ্তমীতে একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছে আছে। মন সত্যিই খারাপ। সে তো নিজের জন্য, নিজের মধ্যে। আনন্দের ভাগীদার যারা তাদের তো সঙ্গ দিতেই হবে। শুভ রাত্রি।
একটা জরুরী দরকারে আজ ষষ্ঠীর সকালে বাজারে যেতে হয়েছিল। সাইকেলে যেতে যেতে রাস্তার ধারে লাগানো পূজো মন্ডপের মাইকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসছিল। বরাবরই পূজো প্যান্ডেলের বিচিত্র গান শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। বিশেষ ক’রে যখন আবেগভরা রবীন্দ্রনাথের গান ভেসে আসে আমি আপ্লুত হয়তে যাই। অজ্ঞাত কারনে হওয়া মন খারাপের সঙ্গে এ যেন ঘৃতাহুতি। গানগুলো শুনতে শুনতে কখনো কখনো চোখ ভিজে গিয়ে চশমার কাচ বাষ্পায়িত হয়ে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। এই সময় রবীন্দ্রনাথকে যেন আরোও বিষ্ময়কর লাগে। বাজার থেকে ফেরার পথে একটা গান মনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। গানটি ইতিপূর্বে বহুবার শুনেছি অথচ আজ এই গানের কথাগুলো শুনে মনে মনে রবীন্দ্রনাথকে প্রনাম জানালাম – জোনাকি কি সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ/ও জোনাকি কী সুখে ওই আঁধার সাঁঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ/ তুমি নও তো সূর্য নওতো চন্দ্র/ তোমার তাই বলে কি কম আনন্দ ... শুনতে শুনতে ভুলেই গেলাম আমার মন খারাপের কথা। একটু আগেই একটা পূজো প্যান্ডেলের উদ্বোধন মঞ্চে দেখলাম আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধু প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত ক’রে বসে আছে। সে এখন স্কুলের হেডমাস্টার। চারদিক থেকে ‘মাননীয়’, ‘মহাশয়’ ইত্যাদি সম্বোধন ভেসে আসছে। বেশ ভালই লাগছিল বন্ধুর সামাজিক মর্যাদার রমরমা দেখতে। কিন্তু গানটা শোনার পর আমার আর এক সহপাঠী বন্ধুর মুখ বার বার ভেসে উঠতে লাগল। গানের কথাগুলোর সঙ্গে আমি কোথায় যেন অম্লানের মিল পেলাম। ও থাকে ব্যারাকপুরে। ফোনে মাঝে মাঝে কথা হয়। ওর অ্যান্ড্রয়েড ফোন নেই ব’লে ফেসবুক/হোয়াটসঅ্যাপের মত সামাজিক মাধ্যমে ও অনুপস্থিত। অম্লান একটা প্রাইমারী স্কুলের সামান্য বেতনের পার্শ্বশিক্ষক। বহুদিন ওর সঙ্গে দেখা ছিল না। দু’দিন আগে অফিস ছুটি ছিল ব’লে দেখা করতে গিয়েছিলাম ওর সঙ্গে। গিয়ে দেখলাম ছোট্ট একটা ঘরে ও একাই থাকে। অকৃতদার । বাবা-মা অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। অগোছালো ঘরে শুধু বই আর বই। অনেক গল্প হ’ল। পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের সম্বন্ধে কথা হ’ল। আমি একটা কথাই বলেছিলাম ‘তোর মত ছেলে আজ প্রাইমারী স্কুলের পার্শ্বশিক্ষক একথা মেনে নিতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে’। প্রশ্নটা শুনে অম্লানের এতটুকু প্রতিক্রিয়া পেলাম না – একেবারে নির্বিকার। গতকাল, পঞ্চমীর দিনে, আমার অনুরোধ রাখতে অম্লান আমাদের বাড়িতে এসেছিল। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে বাইরে অবাকই হলাম। অম্লান এসেছে। পড়নে পুরোনো পাজামা, পায়ে প্রায় ছেঁড়া চপ্পল। বেশ অবাকই হলাম। অবশ্য বন্ধুবান্ধবদের মুখে আগেই শুনেছি ও নাকি এভাবেই চলাফেরা করে। যথারীতি আপ্যায়ন, গল্পগুজব। এসবের পরে একবার লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি রে পোশাক আসাক পালটা। পূজোর সময় এই পোশাকে রাস্তা ঘাটে চললে লোকে কি বলবে!’ অম্লান বদনে অম্লান আমায় পাল্টা প্রশ্ন করেছিল ‘পূজোতে অর্থাভাবে যারা নতুন জামাকাপড় কিনতে পারে না তাদের দেখে তোর কষ্ট হয় না ?’ আমি বলেছিলাম, ‘তা তো হয়, ভীষণ মন খারাপ হয়’। অম্লান অদ্ভুত ভাবে বলেছিল ‘আমাকে দেখে তুই কষ্ট পাচ্ছিস, কিন্তু ওরা আমাকে দেখে সান্ত্বনা পায়’। একথা শোনার পর আর কিছু বলতে পারিনি। অম্লান আমাদের ব্যাচের তুখোর ছাত্র ছিল। আজ যে বন্ধুকে পূজোর উদ্বোধন করতে দেখেছি অম্লানের কাছে সে ছিল নিতান্তই তুচ্ছ। অথচ অম্লান তার কেরিয়ার নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবেনি – এখনোও ভাবে না। শুধু পড়াশোনা করেছে, করেই চলেছে। পত্র-পত্রিকায় মাঝে মাঝেই লেখা বেরোয়। নিজেকে আড়াল করে রেখেছে অন্ধকারে। অথচ আমি, আমার মত ওর পরিচিতরা জানে অম্লান কি অসম্ভব প্রতিভাধারী। গানটা শুনে অম্লানকে মনে হল ও ‘জোনাকি’। গতকাল ফেসবুকে আমার এক সহকর্মী লিখেছিল পূজো এলে আমার মত তারও মন খারাপ হয়। এর কারন জানতে চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, পুরোনো সুপ্ত দুঃখ, ক্ষোভ, ব্যথা এগুলো হয়ত এই উৎসবের আলোতে প্রাণ ফিরে পায়। তাই এই মন খারাপ। অবশ্য এর সঠিক ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই কারন আমার ক্ষেত্রে এই মন খারাপের কারন আজও পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারিনি। তবে একথা ঠিক যে উৎসবের এই আনন্দযজ্ঞে যখন চারদিক আলোকময় হয়ে ওঠে তহন অমলকান্তিদের কথা খুব মনে পড়ে যারা অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের পথ খুঁজে পায়নি। জানিনা সেই কারনেই মন খারাপ হয় কি না। আবার অম্লানের ক্ষেত্রে ‘তুমি নও তো সুর্য নও তো চন্দ্র/ তোমার তাই বলে কি কম আনন্দ...... তোমার যা আছে তা তোমার আছে/ তুমি নও তো ঋণী কারো কাছে’ এই লাইনগুলো ভেবে আনন্দও পাই। ষষ্ঠীতে আজ বাড়িতেই ছিলাম। সপ্তমীতে একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছে আছে। মন সত্যিই খারাপ। সে তো নিজের জন্য, নিজের মধ্যে। আনন্দের ভাগীদার যারা তাদের তো সঙ্গ দিতেই হবে। শুভ রাত্রি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন