ষষ্ঠীতে মনখারাপ
আবার পূজো এল । আবার মন খারাপের পালা । কি অদ্ভুত ! চারিদিকে আনন্দের প্লাবন দেখলেই আমার মনে বিষণ্ণতার শুষ্কতা জেগে ওঠে । না, পরশ্রীকাতরতা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ । যারা আনন্দের বন্যায় ভেসে উৎসব উপভোগ করে প্রাণ ভ’রে, তাদের দেখে আনন্দ হয় ভীষণ । কিন্তু আমার মন খারাপের কারন সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং একদম অন্য রকম । পুজো এলেই পরিবেশ রৌদ্রজ্জ্বল, আমার মন কিন্তু মেঘলা । পাড়ার এক রিক্সা চালকের ছেলেটা অংকে এম.এস.সি. করেছে । মাঝে মাঝেই আসেন আমার কাছে পরামর্শ করতে ছেলেটার চাকরি পাবার ব্যাপারে । এমনকি তাঁর রিক্সাতে উঠলেও তিনি ছেলের প্রসঙ্গ তোলেন । এর আগে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর শংসাপত্র পাবার ব্যাপারে তাঁর ছেলেকে সাহায্য করেছিলাম । সেই সূত্র ধরেই তিনি আমাকে যথেষ্ট সমীহ করেন । মাঝে মাঝে রিক্সার ভাড়া না নিয়ে লজ্জায় ফেলে দেন আমাকে । গতকাল পঞ্চমীর দিনে তাঁর রিক্সায় চেপে বাড়ি ফিরছি । কথাবার্তায় মনে হ’ল বেশ আনন্দে আছেন । অবশ্য আমি বুঝলেও তাঁর মুখ দিয়ে কখনোও শুনিনি তাঁর দারিদ্রের কথা – শুধু একথা বলতে শুনেছি ছেলের পড়াশুনার খরচ চালানো বড্ড দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছে তাঁর পক্ষে । জিজ্ঞেস করলাম – কি ব্যাপার বেশ খুশি খুশি লাগছে যে । পরক্ষণেই জানালেন ছেলে আপার প্রাইমারী পরীক্ষায় পাশ করেছে । নম্বর ভালই পেয়েছে । ইন্টার্ভিউ ওৎরাতে পারলেই চাকরিটা নিশ্চিত একথা ভেবেই হয়ত আনন্দে আছেন । জানি, এই দুর্নীতির বাজারে চাকরিটা আদৌ হবে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় আছে, তবুও আমি আশ্বস্ত করলাম – নিশ্চয়ই হয়ে যাবে । দেখলাম রিক্সাচালকের মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল । তাঁর মনখারাপের কারন খোঁজার বৃথা চেষ্টা করলাম না, কারন আমারও তো মাঝে মাঝেই মন খারাপ হয় অজ্ঞাত কারনে । রিক্সা থেকে নেমে প্রায় জোর ক’রে পয়সা দিতে হ’ল। আজ ষষ্ঠী, সকালে মাছের বাজারে একটু ভালো মাছ কেনার ইচ্ছেয় একটা বড় দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি – এক কোনায় একটা ব্যাগ হাতে লুঙ্গি পরিহিত ওই রিক্সাওয়ালাকে দেখলাম একা একা দাঁড়িয়ে আছেন । এর আগেও ওনাকে বাজারে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে দেখেছি অনেকদিন । আসলে বাজার শেষ হওয়ার মুখে দোকানিরা যখন কম দামে জিনিস বিক্রি করে চলে যান, তিনি সেই অপেক্ষায় থাকেন । আমি আজ মাছ না কিনেই বাড়ি ফিরেছি । ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি দুর্গা নাকি সবার মা । তাহলে যে বাচ্চা ছেলেটা তার শৈশব বিসর্জন দিয়ে পুজোর দিনে বেলুন বেচে উপার্জনে ব্যস্ত তার মা কে ? আজ সকালে ঘুরতে বেড়িয়ে বেশ কয়েকটি পুজো প্যান্ডেলের সামনে দেখলাম কিছু মানুষের জটলা – নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা । দৃশ্যতই তারা দারিদ্রপীড়িত । বোঝা গেল বস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন । মঞ্চে সুবেশ নেতা, ক্লাবের সম্পাদক থেকে শুরু করে নানা উচ্চতার মানুষজন – যেন নিজেদের দানশীলতাকে জাহির করার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে । মনে মনে ভাবলাম সারা বছর যাদের অন্ন-বস্ত্র জোটানোর চেষ্টার নামে যেখানে রাজনীতি চলে, পূজোর আনন্দঘন পরিবেশে তাদের দাঁড় করিয়ে দানশীলতা প্রদর্শনের মাধ্যমে ঐ সমস্ত অসহায় মানুষদের বেঁচে থাকার অধিকারকে কি অপমান করা হয় না ? তাঁদেরকে কি বুঝিয়ে দেওয়া হয় না তোমরা আনন্দ করো আমাদের দয়ায় – তোমাদের আনন্দে স্বতঃস্ফূর্ততা নেই ? ওরাও বোঝে কিন্তু মুখের ভাষা মূক ক’রে দেয় দারিদ্র । একটু আগেই পাড়ার পূজো প্যান্ডেলের সামনে ১২-১৩ বছরের এক কিশোরকে দেখলাম বেলুন বিক্রি করছে । এই বয়সের ছেলেদের হাতে এখন দামী অ্যানড্রয়েড ফোন । ভাবলাম ওর একটা ছবি তুলি । ফোকাসও করলাম – দেখলাম একরাশ বিষণ্ণতা নিয়ে আমার ক্যামেরার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে । মন খারাপ হ’ল । শেষপর্যন্ত ক্লিক করলাম না । জানি ওর ছবিটা এরপর আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে । বিকেলে রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে দেখলাম একটা বাচ্চা মেয়ের কান্না থামাতে তার মা মেয়েটাকে রাস্তায় এনে অনেক ক’রে বোঝাচ্ছেন । বুঝতে অসুবিধা হ’ল না – তার বাবা ড্রাইভার – ভাড়া নিয়ে গেছে সারারাত কোলকাতায় ঠাকুর দেখতে । মেয়েটাও চেয়েছিল বাবার সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাবে । কিন্তু বাবা রাতে বাড়ি ফিরবে না জেনেই মেয়ের এই করুন কান্না । এরকম টুকরো টূকরো দৃশ্য চোখে পড়ার ভয়ে পূজোর সময় রাস্তায় বেরোতে সাহস হয় না । সন্ধের পরে চারিদিকে যখন আলোর রোশনাই – মাইকের আওয়াজ – বাড়ির পাশে রাস্তা দিয়ে আনন্দ-মুখরিত মানুষজনের উচ্ছ্বসিত পদচারনা – আমি তখন ঘরের কোনে একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর শুনে চলেছি বাঁশিতে – আজ ভাষার চেয়ে সুরই বেশি ভালো লাগছে – হয়ত মন খারাপ বলেই ।অ.না.ক. ষষ্ঠী, ৮ অক্টোবর, ২০১৬
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন