রবিবার, ৫ এপ্রিল, ২০২০

করোনার লকডাউনে মানসিক উদ্বেগ


করোনার লকডাউনে মানসিক উদ্বেগঃ অমরনাথ কর্মকার ০৫/০৪/২০২০
৭০ বছরের বৃদ্ধা ভিক্ষে ক’রে পাওয়া অতিরিক্ত ভাত শুকিয়ে রাখছেন পরে ফুটিয়ে ভাত রান্না করবেন ব’লে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আমরা যখন গৃহবন্দী সেই সময়ের অতি সাম্প্রতিক চিত্র এটা। ইতিহাসে আমরা অনেক মন্বন্তর, মহামারীর কথা পড়েছি। বাবা-ঠাকুরদার মুখেও এইসব অভিজ্ঞতার গল্প শুনেছি। আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে জঙ্গলে ঘেরা বিশাল একটা জায়গা ছিল। চারপাশে ঘনবসতি অথচ  ওখানে জঙ্গল। ঠাকুরদার কাছে শুনেছিলাম ঐ জায়গায় নাকি একদা চল্লিশ-পঞ্চাশটি পরিবারের বাস ছিল। একবার কলেরা মহামারীর আকার নিয়েছিল। ওখানে কোন এক পরিবারে কলেরা সংক্রমিত হবার পর তা আশপাশের পরিবারগুলোতে ছড়াতে থাকে, যার ফলে ওই এলাকার প্রায় সবকটি পরিবারের অধিকাংশ মানুষই মারা যায়। ঠাকুরদা গল্প করতেন, পাড়ার লোকের তখন বিরামহীনভাবে মৃতদেহ সৎকার করেছেন। ঠাকুরদা নিজেও ছিলেন সেই কাজে। চার-পাঁচ রাত জেগে একের পর এক মৃতদেহ পুড়িয়েছেন। কারন একটি চিতা জ্বলতে জ্বলতেই খবর আসছে এক বা একাধিক মৃত্যুর। একটু বড় হয়ে আমরা কৌতুহলে ঐ জঙ্গলে ঢুকেছি অনেকবার। ভেতরে বিশাল একটা পুকুর ছিল। শুনেছিলাম ওই পুকুরের জল থেকেই নাকি কলেরার সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। এখন অবশ্য সে জঙ্গল উধাও, তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আবাসন।
বিজ্ঞানের এই চরম উন্নতির দিনেও করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) বিশ্বময় যে মহামারীর ত্রাস সৃষ্টি করেছে তা ইতিহাসে কোনদিন ঘটেনি।প্রকৃতির কাছে মানুষকে এতটা অসহায় হ’তে মানব সভ্যতা বোধ হয় কখনো দেখেনি, বিজ্ঞান যখন সবেমাত্র হামাগুড়ি দিতে শিখেছে, এমনকি তখনোও না।  প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়ত্ব আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু বিজ্ঞানের চূড়ান্ত অগ্রগতির দিনে মানুষ প্রকৃতির খামখেয়ালীপনাকে যে ভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে বর্তমান পরিস্থিতি কিন্তু মানুষের মনে অন্য শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। কোথাও যেন সন্দেহ থেকে যাচ্ছে বিজ্ঞান পারবে তো এই পরিস্থিতিকে জয় করতে ? আর মন্বন্তর ! করোনা ভাইরাসের এই মহামারী ঠেকাতে মানুষকে যেভাবে গৃহবন্দী থাকতে হচ্ছে তাতে খাদ্য সঙ্কট যে কি ভয়ানক বিপদ বয়ে আনবে তার ‘অশনি সংকেত’এখনই আন্দাজ করা যাচ্ছে। শুনেছি ইতালিতে মৃত্যু-মিছিল এমনভাবে ক্রমবর্দ্ধমান যে মানুষের কাছে অর্থ অর্থহীন হয়ে পড়ছে – সেখানে নাকি মানুষ উপার্জিত অর্থ নর্দমায় ফেলে দিচ্ছে। জীবনের জন্য এই লড়াই লড়তে গিয়ে বেঁচে থাকার রসদে টান পড়তে বাধ্য। তখন মন্বন্তরের ঠেলা সামলাতে গিয়ে তৈরি হবে আর এক ভয়ানক পরিস্থিতি। এক মাসের গৃহবন্দী দশায় প্রচুর মানুষ কর্মহীন। সরকারী সহায়তায় এখন হয়ত চ’লে যাচ্ছে। যাদের অর্থ আছে তারা এখনও অর্থের বিনিময়ে রসদ যোগাড় করছেন। কিন্তু এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহ’লে খাদ্যের মজুত শেষ হ’তে বাধ্য। তখন অর্থহীন হয়ে পড়বে নোটের বান্ডিল। সে দিন পাশের বাড়ির প্রায় শ’ ছুঁই ছুঁই এক বৃদ্ধের মুখে তাঁর দুর্ভিক্ষ দেখার অভিজ্ঞতা শুনছিলাম। কোন বাড়ি থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখলেই অভুক্ত মানুষ হামলা করত সেই বাড়িতে।
লকডাউনে ঘরে ব’সে টেলিভিশনে বা ইন্টারনেটে চীন, ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, জার্মানীর মত চিকিৎসাবিজ্ঞানে উন্নত দেশগুলিতে কাতারে কাতারে মানুষের মৃত্যুর খবর পাচ্ছি আর ক্রমেই উদ্বেগের মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে মনে। প্রথমত, বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তা। উদ্বেগ বাড়ছে নিজের দেশকে নিয়ে। উন্নত দেশগুলোর দশা যদি এই রকম করুণ হয়, তাহলে আমাদের দেশে এরকম ব্যাপক সংক্রমণ শুরু হ’লে কি হাহাকার পড়বে সেই পরিণাম চিন্তা ক’রে শিউরে উঠছি। প্রায় দু’সপ্তাহ হ’ল সরকারী নির্দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে সবাই ঘরবন্দী থাকছি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনে। কর্মক্ষেত্রে যাওয়া নেই, অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোনো নেই। রাস্তায় গাড়ী নেই, ট্রেন বন্ধ, সবাই বিচ্ছিন্ন। ভাগ্যিস মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, টেলিভিশন চ্যানেল চালু আছে ! নইলে মানসিক অবসাদেই ইতিমধ্যে অনেক মানুষ পটল তুলতেন। দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষদের উপার্জন বন্ধ, ব্যবসা লাটে। এর মধ্যে যদি মহামারী আর দুর্ভিক্ষের সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু হয় তাহলে পরিস্থিতি কোনদিকে গড়াবে সেই ভেবে মানসিকভাবে আধমরা অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন আমার মত হয়ত অনেকেই।
আমাদের ভারতবর্ষ ইতিমধ্যে অনেকগুলো দুর্ভিক্ষ দেখে ফেলেছে। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে ঘটে যাওয়া ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ হয়েছিল মূলত অতিবৃষ্টি ও বন্যার করাল গ্রাসে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারনে। দুর্ভিক্ষের কবলে পড়া বাংলার অভিজ্ঞতাও কম নয়। ১৯৪৩ সালে ঘটা পঞ্চাশের মন্বন্তরে প্রায় ৩০ লাখ বঙ্গবাসী অনাহারে মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান বার্মা (বর্তমান মায়ানমার)দখল ক’রে নেওয়ার পর এদেশে বার্মা থেকে চাল আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ভারতে জেঁকে বসা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক সেনা ও যুদ্ধ কর্মীদের জন্য বিপুল খাদ্য মজুত ক’রে রাখে। এছাড়া জাপান ভারত আক্রমণ করতে পারে এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে ব্রিটিশ সরকার নৌকা, গোরুর গাড়ী প্রভৃতি পরিবহণ বন্ধ ক’রে দেয়। ফলে দেখা দেয় খাদ্যের হাহাকার। দরিদ্র জনসাধারণ অভুক্ত থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরে। সে ইতিহাস বড় করুণ। বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশ যেমন চীন, রাশিয়া, ভিয়েতনামও ইতিপূর্বে দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে। কিন্তু বর্তমানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে যে মহামারী শুরু হয়ে গেছে বিশ্বময় দ্রুত তা থেকে মুক্তি না মিললে বিশ্বব্যাপী যে দুর্ভিক্ষ নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে তা হবে ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম। এমনকি দেখা দিতে পারে সভ্যতার সঙ্কট।
পৃথিবীতে সংক্রামক রোগের কারনে সৃষ্ট মহামারীর অনেক ইতিহাস আছে। ৪৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এথেন্সে টাইফয়েডের মত মহামারীতে মৃত্যু হয়েছিল সে দেশের দুই তৃতীয়াংশ মানুষের। ৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে জাস্টিনিয়ান প্লেগ, একাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে কুষ্ঠ রোগের মহামারী, ১৩৫০ সালের ‘দ্য ব্ল্যাক ডেথ’ বুবোনিক প্লেগ (ব্যাকটিরিয়া), ১৬৬৫ সালের ‘দ্য গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন’, ১৮১৭ সালে ঘটা রাশিয়ার কলেরা মহামারী, ১৮৫৫ সালের তৃতীয় প্লেগ মহামারী, ১৮৮৯ সালের রাশিয়ান ফ্লু, ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু, ১৯৫৭ সালের এশিয়ান ফ্লু, ১৯৮১ সালের এইচ আই  ভি/এইডস এই সব মহামারীতে বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি ঘটেছিল ঠিকই কিন্তু সংক্রমণের পরিধি এতটা ব্যাপক ছিল না। পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশেই করোনা ভাইরাস মারণ থাবা বসিয়েছে। এর আগে ঘটা মহামারীগুলিকে সময়ের নিরিখে বিচার করলে দেখা যাবে তখন জনসংখ্যার অনুপাতে খাদ্যের যোগান যথেষ্ট ছিল। বর্তমান সময়ে বিশ্বময় যে বিপুল জনসংখ্যা তাতে মহামারীর নিকৃষ্ট রুপ দেখা দিলে দুর্ভিক্ষের আকারও হবে ভয়ঙ্করতম।
প্রশ্ন অন্যত্র। বিজ্ঞানের অগ্রগতির বেগ যে ভাবে ত্বরান্বিত হয়ে চলেছে, মাঝপথে কোন কারনে তার গতি ব্যহত হ’লে আমরা এক ধাক্কায় পিছিয়ে পড়ব অনেকটাই। শুধু বিজ্ঞান নয়, অর্থনীতি, রাজনীতি সব পিছিয়ে যাবে। অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হবে, যেমনটি আগে হয়েছে, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুও থেমে যাবে দ্রুত, হাহাকার থেমে যাবে, কিন্তু ততদিনে ক্ষতি হয়ে যাবে অনেকখানি।
বিজ্ঞান মানব সভ্যতায় উন্নতির বেগ দিয়েছে কিন্তু মানুষকে যান্ত্রিকতায় অভিযোজিত ক’রে আবেগহীন ক’রে দিয়েছে। আজ  আমরা পরস্পরের মধ্যে আবেগহীন সামাজিক দূরত্ব তৈরি ক’রে ঘরবন্দী আছি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে। কতদিন এভাবে চলবে তাও নির্দিষ্ট ক’রে বলা কঠিন। পিছিয়ে পড়েও যদি জীবন বাঁচে, তবে নিয়ম না ভেঙে নিয়ম মেনে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারন বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি এদের অনেক ঊর্ধে জীবনের মূল্য।
তবে বিজ্ঞানের ওপর বিশ্বাসে ভর ক’রে আশায় আছি। খুব শীঘ্রই সঙ্কট মোচনের উপায় আবিষ্কৃত হবে এই আশা আমার মত সকলেই করুন আর মেনে চলুন সরকারী নির্দেশ।     


বৃহস্পতিবার, ২৬ মার্চ, ২০২০

সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে

'সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে' : অ.না.ক. ২৭/০৩/২০২০

মারন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বময় যখন মৃত্যু-মিছিল, তখন আমাদের দেশকে সেই মহামারী থেকে বাঁচাতে আগামী বেশ কয়েক দিন সকলকে গৃহবন্দী থাকতে এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে সরকারী নির্দেশনামা জারি হয়েছে। কিন্তু সময়ে মানুষ অনেকেই সত্য উপলব্ধি করতে পারছেন না হয়ত।। আবার যারা পারছেন তারা সত্যকে সত্য বলে প্রকাশ করার পরিবেশ পাচ্ছেন না অনেকক্ষেত্রেই।  আমরা উপলব্ধি করি, জীবনের ছায়ায় কখনো প্রকৃতি, আবার  কখনো প্রকৃতির ছায়ায় জীবন। মূলত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই অভাবনীয় উন্নতির যুগেও এই মুহূর্তে প্রকৃতির ছায়ায় জীবন।জানিনা, জীবনের ছায়ায় প্রকৃতি যখন থাকে তখন কেন এই প্রকৃতিকেই আমরা কলুষিত করতে দ্বিধা করি না। আর আজ যখন প্রকৃতি চোখ রাঙাচ্ছে, তখন আমাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ।  এই দুঃসময়ে গৃহবন্দী থাকার প্রয়োজনীয়তা যে কি ভীষনভাবে জরুরী এই সত্যোপলব্ধি অনেকের মধ্যেই অনুপস্থিত। অনেকেই এসবের তোয়াক্কা না ক'রে অকারনে রাস্তায়  বেরোচ্ছেন। এরা একগুঁয়ে। যারা প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন তাঁদের অনেকেই প্রথম পক্ষের কারনে সত্য প্রকাশে পিছপা হচ্ছেন। সুতরাং এভাবে চললে পরিস্থিতি যে কোন দিকে গড়াবে তা ভেবে যথেষ্ট শঙ্কিত হতে শুরু করেছি। 
প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও জীবনান্দ দাশের '১৯৪৬-৪৭' কবিতার লাইনগুলো প্রাসঙ্গিকতা বয়ে নিয়ে আসছে। তখন একদিকে ব্রিটিশ শোষণের কড়াল অভিঘাতে বিপর্যস্ত বাঙালি-জীবন, অন্যদিকে বিশ্বরাজনীতির প্রতিহিংসায় দ্বিতীয় মহাসমরে ভেঙে যাওয়া অর্থনীতিতে মানুষের ওপর মানুষ যখন আস্থা হারিয়েছে তখন অযুত যন্ত্রণা-কষ্ট সত্ত্বেও বাঙালিরা মুক্তির স্বপ্ন দেখছিল। এক্ষেত্রেও একদিকে করোনা ভাইরাসের ভয়ঙ্কর সংক্রমণে বিপর্যস্ত জীবনযাত্রা, অন্যদিকে প্রবল অর্থনৈতিক মন্দা আর তারই মধ্যে আমরা মহামারীর ছোবল থেকে আগাম মুক্তি পাবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আবার মারণ সংক্রমণের আতঙ্কে পরস্পর পরস্পরের প্রতি সন্দিহান - সকলেই সকলকে আড়চোখে দেখতে শুরু করেছি। এ রোগের সংক্রমণ ঘটলে তার প্রতিষেধক নেই - এ যেন জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা।  কবির ভাষায় -

'আজকে অস্পষ্ট সব? ভালো করে কথা ভাবা এখন কঠিন;

অন্ধকারে অর্ধসত্য সকলকে জানিয়ে দেবার

নিয়ম এখন আছে; তারপর একা অন্ধকারে

বাকি সত্য আঁচ করে রেওয়াজ

রয়ে গেছে; সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে।'

এ রোগ ধর্ম মানে না, জাত মানে না, এর কাছে আকবর বাদশা আর হরিপদ কেরাণীর মধ্যে কোন  ভেদ নেই।  ধর্ম,জাত,অর্থ এ সবের চেয়ে এখন জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তাই নৈরাশ্য আর নেতিবোধকে প্রাধান্য না দিয়ে  জীবন রক্ষার চেষ্টা করাটাই আজ একমাত্র সংগ্রাম আমাদের।

বুধবার, ২৫ মার্চ, ২০২০

বই পড়ার উপকারিতা

        বই পড়ার উপকারিতাঃ অমরনাথ কর্মকার ২৫/০৩/২০২০
ছোটবেলায় বাবা-মার কাছে অনেক বকা শুনেছি বই না পড়ার কারনে। কোন বই ? ভুল ভেবে থাকতে পারেন হয়ত। বকা খেয়েছি স্কুলের পাঠ্য বই না পড়ার কারনে আদৌ নয়। স্কুলের পাঠ্য বই পড়া তো দৈনিক খাবার খাওয়ার মত। ওটা তো নিয়মমাফিক পড়তেই হ'ত। অবশ্য আমার বাবা-মা অতিরিক্ত খাওয়াতে পছন্দ করতেন না। বাবা বলতেন ক্ষিদে পেলে এমনিতেই খাবে। এখন অবশ্য বেশিরভাগ অভিভাবককে দেখি সন্তানের ভরা পেটেও জোর ক'রে গেলাতে। জানিনা, হয়ত বা জলবায়ুর পরিবর্তনের ফল। সে যা হোক, বকা খেয়েছি স্কুলের পাঠ্যের বাইরে বই না পড়ার কারনে। তার কারনও একটা ছিল। বাবা আমাদের স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরির সভ্য ছিলেন। বাড়িতে অনেক বিখ্যাত লেখকের বই আনতেন। নিজে পড়ার পর সাথে সাথে ফেরত না দিয়ে অতিরিক্ত কয়েকটা দিন বাড়িতে রেখে আমাকে পড়তে বলতেন। আমি বই পড়ছি কি না সে রিপোর্ট দেওয়ার দায়িত্ব ছিল মায়ের ওপর। আমি নিরুপায় হয়ে বই পড়ার নাম ক'রে অহেতুক পাতা উল্টে পড়ার ভান করতাম মাকে দেখানোর জন্য। বলা দরকার, আমার বাবা স্বল্পশিক্ষিত ছিলেন কিন্তু বই পড়ার অসম্ভব নেশা ছিল। মা ছিলেন অতি স্বল্পশিক্ষিতা কিন্তু আমার পড়ার নজরদারিতে শিক্ষকদেরও হার মানাতে পারতেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বই হাতে বসার অভ্যেস ক্রমশ বই-এর প্রতি আকর্ষণের জন্ম দিল। আস্তে আস্তে বিভিন্ন ধরনের বই, পত্র-পত্রিকা পড়ার প্রতি আগ্রহ এমনভাবে জন্মালো যে আজ আমার আয়ের একটা অংশ শুধু বই আর পত্র-পত্রিকা কিনতে ব্যয় হয়ে যায়। চাকরি পাবার আগে যখন কেবল টিউশানি করতাম তখন থেকেই আমার খরচে বাড়িতে নিয়মিত পত্র-পত্রিকা নিতাম। আর বই-এর একটা ছোটখাটো লাইব্রেরিই বানিয়ে ফেলেছিলাম। না, আমরা ধনী ছিলাম না, ছিলাম নিম্ন মধ্যবিত্ত। সেই অভ্যেস রক্তে মিশে গেছে ব'লে অবসর পেলেই বই পড়ি, আনন্দ পাই। বাবা আমার কেনা বই আর পত্র-পত্রিকায় মশগুল হয়ে থাকতেন অবসর সময়ে। মারা যাবার আগেও বাবাকে দেখেছি দুপুরে না ঘুমিয়ে বই পড়তে। দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে লক ডাউন - ভয়ঙ্কর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে। চলবে আরোও অন্তত ১৪ দিন। রাত দুটো নাগাদ বাড়ির বাইরের উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখলাম অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। মনে হ'ল পৃথিবী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অথচ অন্য সময় হ'লে রাত দুটোতেও পাড়া জেগে থাকে। কখনোও মাইকে গান ভেসে আসে, কখনোও পাশের বাড়ির জানলা দিয়ে ভেসে আসে শিশুর কান্না কিংবা স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার আওয়াজ। এই ভাবে দীর্ঘ দিন অলস ঘর বন্দী হয়ে থাকাটা কি সবার পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে? বিশেষ ক'রে যারা সারাদিন কাটান কর্মব্যস্ততায়? যাঁরা নাচ-গান বা অন্যান্য শৈল্পিক কাজে করেন তাঁদের সময় কাটবে শিল্প চর্চায়।কিন্তু যাঁরা এসবের মধ্যে নেই তাঁদের কি হবে? মোবাইল ঘেঁটে কতদিন চলবে? টিভিতেও চলছে সিরিয়ালের পুরোনো এপিসোডের পুনঃপ্রচার।সুতরাং এতদিন কাজের চাপ সামলে ছুটির উপভোগ্যতা যেভাবে অনুভব করেছি আজ থেকে তার বিপরীত। এখন ছুটির চাপ সামলানোই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমার বা আমার মত যাদের বই পড়ার নেশা আছে তাদের ক্ষেত্রে বোধ হয় এই দীর্ঘ সময় অলস সময় কাটানো কঠিন হবে না। 'বই পড়ে কি হবে' এই প্রশ্নের সম্মুখীন বহুবার হয়েছি। আমি ভালো চাকরি করি না, আর্থিক ভাবেও স্বচ্ছল নই, সামাজিক পরিচিতিও আমার নেই। তাই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে চলেছি কারন প্রশ্নকর্তার চাহিদামত উত্তর দেওয়ার যোগ্যতায় আমি ডাঁহা ফেল। আর যে উত্তর আমি দিতে পারি তাতে হাসির খোরাক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। তাই বই পড়ি নিভৃতে, ভালোবেসে মানসিক প্রশান্তির ছায়ায় বসে। তবে আজ সেই সমস্ত প্রশ্নকর্তাদের 'বই পড়ার উপকারিতা'র উত্তর নির্দ্বিধায় দিতে পারি। উত্তরটি হ'ল - বই পড়া সময় কাটানোর সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। এক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তা একশ তে একশ দিতে দ্বিমত করবেন না নিশ্চয়। যেহেতু আগামী বেশ কয়েকদিন আমাদের বন্দিদশা চলবে।

রবিবার, ২২ মার্চ, ২০২০

করোনা ত্রাস ও আমরা

করোনা ত্রাস ও আমরাঃ অ.না.ক. ২৩/০৩/২০২০

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বজুড়ে যে ত্রাস সৃষ্টি হয়েছে তাতে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন। চীনের পর এবার এই মারন ভাইরাসের তাণ্ডবে ইতালিতে চলছে মৃত্যু-মিছিল। এই লেখা যখন শুরু করেছি তখন ইটালিতে  মৃতের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। ভারতে ইতিমধ্যেই সংক্রমন শুরু হয়েছে। মৃত্যুও হয়েছে বেশ কয়েকজনের। এই সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার যখন ব্যবস্থা নিচ্ছে তখন আমাদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যে রাজনৈতিক তরজা শুরু ক'রে দিয়েছি। কেউ গোমুত্র সেবনে এর প্রতিকার খুঁজছে, কেউ হোমিওপ্যাথিতে। কেউ থানকুনি পাতা খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, কেউ ভরসা করছেন ঈশ্বরের ওপর। বাংলাদেশের একজন তো ইতিমধ্যে স্বপ্নে পেয়ে গেছেন করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক। অথচ এই রোগের প্রতিষেধক এখনও অনাবিষ্কৃত বলেই কিন্তু বিশ্বজুড়ে এই আতঙ্ক, এত কর্মকান্ড। আর একদল মজা দেখতে ব্যস্ত। সামাজিক মাধ্যমে তারা মশকরা ক'রে চলেছে, গুজব ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি ক'রে দেঁতো হাসি হাসছে। জানিনা হয়ত এটাই তাদের নিরুদ্বেগ থাকার কৌশল। 'জনতা কার্ফু'র জন্য আজ সারাদিন বাড়ি ব'সে সময় কাটছে। তাই লিখতে ইচ্ছে হ'ল। লিখতে বসার আর একটি কারন হ'ল আজ সারাদিন যখন 'এই বিজ্ঞানের যুগেও আমরা কেন এতটা অসহায় বোধ করছি' এই ব্যাপারটা ভেবে কুল পাচ্ছি না তখন মনে প'ড়ে গেল অনেক বছর আগে পড়া বনফুল (বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়)-এর লেখা 'মানুষের মন' গল্পটার কথা। মানুষের চরম দুঃসময়ে মানূষ কিভাবে তাঁর নীতি,আদর্শ থেকে বিচ্যুত হ'তে পারে তারই বর্ণনা রয়েছে গল্পে। নরেশ ও পরেশ দুই সহোদর। দু'জনেই অকৃতদার। প্রথম জন রসায়নে এম.এস.সি., দ্বিতীয় জন সংস্কৃতে এম.এ., দুজনেই কলেজের অধ্যাপক। নরেশ জ্ঞানমার্গে বিশ্বাসী, 'থিওরি অফ রিলেটিভিটি' নিয়ে তাঁর সর্বক্ষণের চর্চা। পরেশের বিচরণ ভক্তিমার্গে।  ছোট ভাই মারা যাবার পর তার একমাত্র ছেলে পল্টুর দেখাশোনার সমস্ত ভার নরেশ ও পরেশই নিয়েছিলেন। দু'জনের কাছেই পল্টু ছিল অতি আদরের। একবার পল্টুর অসুখ করল। নরেশ যখন ডাক্তার ডাকার প্রস্তাব দিচ্ছেন, পরেশ তা না মেনে কবিরাজ ডাকতে চাইছেন। ডাক্তারের পরামর্শে নরেশ যখন ইঞ্জেকশান দেওয়ার তোরজোড় করছেন পরেশ তখন জ্যোতিষির পরামর্শ নিতে ব্যস্ত। এদিকে অসুখ ক্রমশ বাড়ছে। নরেশ তখনও পরেশকে ডাক্তারের ইঞ্জেকশনে রাজী করানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। ওদিকে নরেশের ঘোরতর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও পরেশ ঠাকুরের চরণামৃত খাইয়ে পল্টুকে সুস্থ ক'রে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। একসময় পল্টু প্রায় মরনাপন্ন। তখন দেখা গেল পল্টুকে বাঁচিয়ে তোলার তাগিদে নরেশ ও পরেশ তাঁদের সব নীতি, বিশ্বাস বিসর্জন দিলেন। দেখা গেল নরেশ নিজ হাতে পল্টুর মুখে চরণামৃত তুলে দিচ্ছেন আর ওদিকে পরেশ ডাক্তারবাবুকে ফোন করছেন পল্টুকে ইঞ্জেকশান দেওয়ার জন্য।
গল্পটা যাঁদের পড়া আছে তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন এই গল্পের অবতারনা করার উদ্দেশ্য।
করোনা ভাইরাস যখন মহামারীর আকার ধারণ করেছে তখন চিকিতসা শাস্ত্রে অনাবিষ্কৃত থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ এই রোগের প্রতিষেধক বাতলে দিচ্ছেন অনায়াসে। আসলে এগুলো আমাদের অসহায়ত্বের প্রকাশ। তবে এটাও ঠিক একশ্রেণির মানুষ এতে অনেকটা আশ্বস্তও হন। আবার গোমুত্র পানে অসুস্থও হয়ে পড়েন। আমার বক্তব্য, এখনোও সেই অসহায়ত্ব বোধ করার মত পরিস্থিতি বোধ হয় আসেনি। সুতরাং সচেতন থেকে এই রোগ এবং তার সংক্রমণ প্রতিহত করতে হবে আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে। এখনোও বিজ্ঞান ধর্মের দ্বারস্থ হয়নি কিংবা ধর্ম বিজ্ঞানের।

রবিবার, ৮ মার্চ, ২০২০

অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চায় ?

রবীন্দ্রভারতি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাকে কেন্দ্র ক'রে আমার কবিতা

অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চায় ?
অমরনাথ কর্মকার ০৮/০৩/২০২০


একদল অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চায়
সেই তীব্র রোদ, যার তাপের জ্বালায় 
শেষমেশ সেই দহনে সে হয় আত্মঘাতী
আর চার পাশ পুড়ে খাক হয় রাতারাতি।
মাথার ওপর মুচকি হেসে বলেন রবি কর
‘আমার রোদে প্রাণদায়ী তাপ, আলো মনোহর,
যে রোদে তুই মরলি পুড়ে সে তোর অপমান
আমার রোদে বেঁচে থাকে হাজার কোটি প্রাণ ‘।

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?