রবিবার, ৫ এপ্রিল, ২০২০

করোনার লকডাউনে মানসিক উদ্বেগ


করোনার লকডাউনে মানসিক উদ্বেগঃ অমরনাথ কর্মকার ০৫/০৪/২০২০
৭০ বছরের বৃদ্ধা ভিক্ষে ক’রে পাওয়া অতিরিক্ত ভাত শুকিয়ে রাখছেন পরে ফুটিয়ে ভাত রান্না করবেন ব’লে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আমরা যখন গৃহবন্দী সেই সময়ের অতি সাম্প্রতিক চিত্র এটা। ইতিহাসে আমরা অনেক মন্বন্তর, মহামারীর কথা পড়েছি। বাবা-ঠাকুরদার মুখেও এইসব অভিজ্ঞতার গল্প শুনেছি। আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে জঙ্গলে ঘেরা বিশাল একটা জায়গা ছিল। চারপাশে ঘনবসতি অথচ  ওখানে জঙ্গল। ঠাকুরদার কাছে শুনেছিলাম ঐ জায়গায় নাকি একদা চল্লিশ-পঞ্চাশটি পরিবারের বাস ছিল। একবার কলেরা মহামারীর আকার নিয়েছিল। ওখানে কোন এক পরিবারে কলেরা সংক্রমিত হবার পর তা আশপাশের পরিবারগুলোতে ছড়াতে থাকে, যার ফলে ওই এলাকার প্রায় সবকটি পরিবারের অধিকাংশ মানুষই মারা যায়। ঠাকুরদা গল্প করতেন, পাড়ার লোকের তখন বিরামহীনভাবে মৃতদেহ সৎকার করেছেন। ঠাকুরদা নিজেও ছিলেন সেই কাজে। চার-পাঁচ রাত জেগে একের পর এক মৃতদেহ পুড়িয়েছেন। কারন একটি চিতা জ্বলতে জ্বলতেই খবর আসছে এক বা একাধিক মৃত্যুর। একটু বড় হয়ে আমরা কৌতুহলে ঐ জঙ্গলে ঢুকেছি অনেকবার। ভেতরে বিশাল একটা পুকুর ছিল। শুনেছিলাম ওই পুকুরের জল থেকেই নাকি কলেরার সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। এখন অবশ্য সে জঙ্গল উধাও, তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আবাসন।
বিজ্ঞানের এই চরম উন্নতির দিনেও করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) বিশ্বময় যে মহামারীর ত্রাস সৃষ্টি করেছে তা ইতিহাসে কোনদিন ঘটেনি।প্রকৃতির কাছে মানুষকে এতটা অসহায় হ’তে মানব সভ্যতা বোধ হয় কখনো দেখেনি, বিজ্ঞান যখন সবেমাত্র হামাগুড়ি দিতে শিখেছে, এমনকি তখনোও না।  প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়ত্ব আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু বিজ্ঞানের চূড়ান্ত অগ্রগতির দিনে মানুষ প্রকৃতির খামখেয়ালীপনাকে যে ভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে বর্তমান পরিস্থিতি কিন্তু মানুষের মনে অন্য শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। কোথাও যেন সন্দেহ থেকে যাচ্ছে বিজ্ঞান পারবে তো এই পরিস্থিতিকে জয় করতে ? আর মন্বন্তর ! করোনা ভাইরাসের এই মহামারী ঠেকাতে মানুষকে যেভাবে গৃহবন্দী থাকতে হচ্ছে তাতে খাদ্য সঙ্কট যে কি ভয়ানক বিপদ বয়ে আনবে তার ‘অশনি সংকেত’এখনই আন্দাজ করা যাচ্ছে। শুনেছি ইতালিতে মৃত্যু-মিছিল এমনভাবে ক্রমবর্দ্ধমান যে মানুষের কাছে অর্থ অর্থহীন হয়ে পড়ছে – সেখানে নাকি মানুষ উপার্জিত অর্থ নর্দমায় ফেলে দিচ্ছে। জীবনের জন্য এই লড়াই লড়তে গিয়ে বেঁচে থাকার রসদে টান পড়তে বাধ্য। তখন মন্বন্তরের ঠেলা সামলাতে গিয়ে তৈরি হবে আর এক ভয়ানক পরিস্থিতি। এক মাসের গৃহবন্দী দশায় প্রচুর মানুষ কর্মহীন। সরকারী সহায়তায় এখন হয়ত চ’লে যাচ্ছে। যাদের অর্থ আছে তারা এখনও অর্থের বিনিময়ে রসদ যোগাড় করছেন। কিন্তু এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহ’লে খাদ্যের মজুত শেষ হ’তে বাধ্য। তখন অর্থহীন হয়ে পড়বে নোটের বান্ডিল। সে দিন পাশের বাড়ির প্রায় শ’ ছুঁই ছুঁই এক বৃদ্ধের মুখে তাঁর দুর্ভিক্ষ দেখার অভিজ্ঞতা শুনছিলাম। কোন বাড়ি থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখলেই অভুক্ত মানুষ হামলা করত সেই বাড়িতে।
লকডাউনে ঘরে ব’সে টেলিভিশনে বা ইন্টারনেটে চীন, ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, জার্মানীর মত চিকিৎসাবিজ্ঞানে উন্নত দেশগুলিতে কাতারে কাতারে মানুষের মৃত্যুর খবর পাচ্ছি আর ক্রমেই উদ্বেগের মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে মনে। প্রথমত, বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তা। উদ্বেগ বাড়ছে নিজের দেশকে নিয়ে। উন্নত দেশগুলোর দশা যদি এই রকম করুণ হয়, তাহলে আমাদের দেশে এরকম ব্যাপক সংক্রমণ শুরু হ’লে কি হাহাকার পড়বে সেই পরিণাম চিন্তা ক’রে শিউরে উঠছি। প্রায় দু’সপ্তাহ হ’ল সরকারী নির্দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে সবাই ঘরবন্দী থাকছি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনে। কর্মক্ষেত্রে যাওয়া নেই, অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোনো নেই। রাস্তায় গাড়ী নেই, ট্রেন বন্ধ, সবাই বিচ্ছিন্ন। ভাগ্যিস মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, টেলিভিশন চ্যানেল চালু আছে ! নইলে মানসিক অবসাদেই ইতিমধ্যে অনেক মানুষ পটল তুলতেন। দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষদের উপার্জন বন্ধ, ব্যবসা লাটে। এর মধ্যে যদি মহামারী আর দুর্ভিক্ষের সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু হয় তাহলে পরিস্থিতি কোনদিকে গড়াবে সেই ভেবে মানসিকভাবে আধমরা অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন আমার মত হয়ত অনেকেই।
আমাদের ভারতবর্ষ ইতিমধ্যে অনেকগুলো দুর্ভিক্ষ দেখে ফেলেছে। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে ঘটে যাওয়া ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ হয়েছিল মূলত অতিবৃষ্টি ও বন্যার করাল গ্রাসে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারনে। দুর্ভিক্ষের কবলে পড়া বাংলার অভিজ্ঞতাও কম নয়। ১৯৪৩ সালে ঘটা পঞ্চাশের মন্বন্তরে প্রায় ৩০ লাখ বঙ্গবাসী অনাহারে মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান বার্মা (বর্তমান মায়ানমার)দখল ক’রে নেওয়ার পর এদেশে বার্মা থেকে চাল আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ভারতে জেঁকে বসা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক সেনা ও যুদ্ধ কর্মীদের জন্য বিপুল খাদ্য মজুত ক’রে রাখে। এছাড়া জাপান ভারত আক্রমণ করতে পারে এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে ব্রিটিশ সরকার নৌকা, গোরুর গাড়ী প্রভৃতি পরিবহণ বন্ধ ক’রে দেয়। ফলে দেখা দেয় খাদ্যের হাহাকার। দরিদ্র জনসাধারণ অভুক্ত থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরে। সে ইতিহাস বড় করুণ। বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশ যেমন চীন, রাশিয়া, ভিয়েতনামও ইতিপূর্বে দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছে। কিন্তু বর্তমানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে যে মহামারী শুরু হয়ে গেছে বিশ্বময় দ্রুত তা থেকে মুক্তি না মিললে বিশ্বব্যাপী যে দুর্ভিক্ষ নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে তা হবে ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম। এমনকি দেখা দিতে পারে সভ্যতার সঙ্কট।
পৃথিবীতে সংক্রামক রোগের কারনে সৃষ্ট মহামারীর অনেক ইতিহাস আছে। ৪৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এথেন্সে টাইফয়েডের মত মহামারীতে মৃত্যু হয়েছিল সে দেশের দুই তৃতীয়াংশ মানুষের। ৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে জাস্টিনিয়ান প্লেগ, একাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে কুষ্ঠ রোগের মহামারী, ১৩৫০ সালের ‘দ্য ব্ল্যাক ডেথ’ বুবোনিক প্লেগ (ব্যাকটিরিয়া), ১৬৬৫ সালের ‘দ্য গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন’, ১৮১৭ সালে ঘটা রাশিয়ার কলেরা মহামারী, ১৮৫৫ সালের তৃতীয় প্লেগ মহামারী, ১৮৮৯ সালের রাশিয়ান ফ্লু, ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু, ১৯৫৭ সালের এশিয়ান ফ্লু, ১৯৮১ সালের এইচ আই  ভি/এইডস এই সব মহামারীতে বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি ঘটেছিল ঠিকই কিন্তু সংক্রমণের পরিধি এতটা ব্যাপক ছিল না। পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশেই করোনা ভাইরাস মারণ থাবা বসিয়েছে। এর আগে ঘটা মহামারীগুলিকে সময়ের নিরিখে বিচার করলে দেখা যাবে তখন জনসংখ্যার অনুপাতে খাদ্যের যোগান যথেষ্ট ছিল। বর্তমান সময়ে বিশ্বময় যে বিপুল জনসংখ্যা তাতে মহামারীর নিকৃষ্ট রুপ দেখা দিলে দুর্ভিক্ষের আকারও হবে ভয়ঙ্করতম।
প্রশ্ন অন্যত্র। বিজ্ঞানের অগ্রগতির বেগ যে ভাবে ত্বরান্বিত হয়ে চলেছে, মাঝপথে কোন কারনে তার গতি ব্যহত হ’লে আমরা এক ধাক্কায় পিছিয়ে পড়ব অনেকটাই। শুধু বিজ্ঞান নয়, অর্থনীতি, রাজনীতি সব পিছিয়ে যাবে। অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হবে, যেমনটি আগে হয়েছে, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুও থেমে যাবে দ্রুত, হাহাকার থেমে যাবে, কিন্তু ততদিনে ক্ষতি হয়ে যাবে অনেকখানি।
বিজ্ঞান মানব সভ্যতায় উন্নতির বেগ দিয়েছে কিন্তু মানুষকে যান্ত্রিকতায় অভিযোজিত ক’রে আবেগহীন ক’রে দিয়েছে। আজ  আমরা পরস্পরের মধ্যে আবেগহীন সামাজিক দূরত্ব তৈরি ক’রে ঘরবন্দী আছি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে। কতদিন এভাবে চলবে তাও নির্দিষ্ট ক’রে বলা কঠিন। পিছিয়ে পড়েও যদি জীবন বাঁচে, তবে নিয়ম না ভেঙে নিয়ম মেনে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারন বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি এদের অনেক ঊর্ধে জীবনের মূল্য।
তবে বিজ্ঞানের ওপর বিশ্বাসে ভর ক’রে আশায় আছি। খুব শীঘ্রই সঙ্কট মোচনের উপায় আবিষ্কৃত হবে এই আশা আমার মত সকলেই করুন আর মেনে চলুন সরকারী নির্দেশ।     


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?