অষ্টমীতে মন খারাপ
নৈমিত্তিক
মুখোশপরা জীবন । অনেক ব্যস্ত মানুষের বিচিত্র বর্ণিল ভিড়ে খুঁজে ফিরি বিষণ্ণ আড়াল
। এমন কাউকে খুঁজে পাইনা যার প্রসস্থ কাঁধে হাত রেখে আকাশ দেখা যায় । আমি আমার কথা
বলছি না, তাদের কথা বলছি উৎসবের জীবনে প্রবেশের সামর্থ্য যাদের নেই – জীবনের উৎসবে
যারা ব্রাত্য । আজ অষ্টমী – আনন্দ-মুখরতায় সবচেয়ে চড়া । বর্ষণমুখর দিন । কেউ
ব্যস্ত ঘরের ফুটো ছাদ মেরামত ক’রে মাথা বাঁচাতে, কেউ ব্যস্ত হাজার হাতের দুর্গা দেখার
কিংবা হোটেলে ডিনার সারার পরিকল্পনায় । কেউ বলছে ‘আকাশটা আজ বেশ সেজেছে’ কারও আবার
মাথায় হাত । কি অদ্ভুত বৈপরীত্য ! আমার কিন্তু হেলদোল নেই । খারাপ মন ভালো হবার
এতটুকু সম্ভাবনা নেই । আজ আবার খবরের কাগজও বন্ধ । মন খারাপের এও এক অন্যতম কারন হ’তে
পারে । আজ পূজো প্যান্ডেলের পাশে চেয়ারে বসা বাবলুকে দেখে ট্র্যাজিক উপন্যাসের
চরিত্র ব’লে মনে হ’ল । প্রেম আর চাকরীর পারীক্ষা পাশাপাশি চলেছিল বহুদিন ওর জীবনে
। শেষমেশ চাকরীর পরীক্ষা দেবার বয়স অতিক্রান্ত হ’ল । পরিণতি বুঝে প্রেমিকা
সু-চাকুরের স্ত্রী । অবিবাহিত বেকার বাবলু তাই পূজোর ক’টা দিন প্যান্ডেলে ঠাঁই ব’সে
থাকে প্রাক্তন প্রেমিকাকে দেখার জন্য । না, বাবলুর জন্য মন খারাপ লাগে না, ওরকম
বাবলু এদেশে প্রচুর আছে, খারাপ লাগে যখন
দেখি ওর প্রাক্তন প্রেমিকা একবারের জন্যও বাবলুর দিকে ফিরে তাকায় না । নাকি আমারই
ভুল, হয়ত সে আজও বাবলুকে ভালবাসে মনে মনে – আজও নির্জন একাকীত্বে বাবলুর কথা ভেবে
বালিশ ভেজায় চোখের জলে ! এই দ্বন্দ্বগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় – মন খারাপ হয় –
মন খারাপের সঠিক কারন খুঁজতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে যাই । আসলে আমি যে মন খারাপের
গাড়িতে চড়ে বসে আছি, তার কোন নির্দিষ্ট গতি নেই, স্থির গন্তব্য নেই, এ গাড়ির ভেঁপু
বাজে না । আমি দিন রাত মন খারাপের সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধ ক’রে চলেছি । এটুকু বুঝেছি, মন খারাপের
সঙ্গে সংঘাতের প্রাপ্তিটা কিন্তু বেশ আনন্দদায়ক । অষ্টমীর রাতে পরিবেশে যখন উৎসবের
ভরপুর আমেজ তখন আমি ঘরে ব’সে মন খারাপের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতে উঠে লিখে চলেছি – পরে এই লেখাগুলোই আমার মন ভালো ক’রে
দেবে, এই প্রাপ্তিটা কম কিসের । সে লেখা যতই নিম্ন মানের হোক নে কেন, সৃষ্টি তো
আমারই । আজ সকালে আমেরিকা প্রবাসী আমার এক বন্ধুর ফোন এসেছিল বিস্ময়কে ছাপিয়ে । ও
ছিল ধনী পরিবারের ছেলে । ক্লাসে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তেমন গাঢ় কিংবা আন্তরিক
ছিল না । বাবার অর্থের মহিমায় ও আমেরিকায় পাড়ি দিল ভালো চাকরী নিয়ে, বিদেশিনী বউ হ’ল
। ওর ফোন পেয়ে কেরানীগিরি করা মানসিকতায় কেমন যেন সঙ্কোচ জাগল । কুশল জিজ্ঞাসা করার পরই জানতে চাইল – তোদের ওখানে
পূজোর আনন্দ কেমন ? বললাম এখানে কোনদিনই পূজোর আনন্দে ঘাটতি নেই । জিজ্ঞাসা করলাম,
“ওখানে?” বলল, আজ মনটা খুব খারাপ লাগছে, ছোটবেলার দিনগুলোর কথা ভেবে, দেশের পূজোর
কথা ভেবে মন খারাপ লাগছে খুব । এখানে পূজো আছে, সেই আনন্দ নেই । আমি বললাম, এখানে
পুজোতে আনন্দ করে সবাই – এখানে পূজোতে বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য – মানে পূজোর ক’টা দিন সবাই
আনন্দে থাকে । এটুকু বলার পরেই আচমকা ফোনটা কেটে গেল । জানিনা, ওপার থেকে কেটে
দেওয়া হ’ল নাকি যান্ত্রিক ত্রুটি । নাকি উত্তর মনঃপুত হ‘ল না । কে জানে ! মনটা যে
আমারও খারাপ ও কি সেটা বুঝে ফেলেছে ?
অ.না.ক. অষ্টমী, ৯ অক্টোবর, ২০১৬