সোমবার, ৩ জুলাই, ২০২৩

সবজি যখন মহার্ঘ

 

                                                            সবজি যখন মহার্ঘ

                                                                                                               অমরনাথ কর্মকার

গুরুপূর্ণিমার আগের দিন শুনলাম আসানসোল থেকে মায়ের এক গুরুভাই আসবেন আমাদের বাড়ি। সঙ্গী আরোও তিনজিন। আমাদের বাড়িতেই গুরুপূর্ণিমা পালিত হবে ঘটা ক’রে। স্বাভাবতই মা আহ্লাদিত। মা সন্ধ্যে বেলা এক বিশাল ফর্দ ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। গুরুভাই নিরামিষাশী। সুতরাং সেই তালিকায় খাসি বা মুরগীর মাংস অনুপস্থিত থাকলেও যে সমস্ত সবজির নাম ও পরিমাণ লেখা আছে তাতে আমার প্রায় ভিমরি খাবার উপক্রম। শুধু গুরুভাই ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গই নন, আশপাশের বেশ কয়েকজন প্রবীন প্রতিবেশীও ইতিমধ্যে মায়ের আমন্ত্রিত। ফর্দ মিলিয়ে বিরাট ব্যাগ ভর্তি মালপত্র নিয়ে গলদঘর্ম হয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন শারীরিক ক্লান্তির থেকেও মানসিক বিপর্যয়ের মাত্রা অনেক বেশী। বলা বাহুল্য, মানসিক বিপর্যয়ের কারন সবজির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারনে অকল্পনীয় ব্যয়।  

কিছুদিন আগে একবার আলুর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল, তখন দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠেছিল। পেঁয়াজ বা মুরগীর ক্ষেত্রেও এরকম লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির খপ্পরে পড়ে আমাদের ভুগতে হয়েছে। তারপর আবার ছন্দে ফিরেছে বাঙালীর আলুলায়িত জীবন। মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তদের নিয়মিত খাদ্যতালিকায় মাছ-মাংস ক্রমশ বিদায় নিচ্ছে মূলত মাছ মাংসের উচ্চ মূল্যের কারনে। খাসি বা পাঁঠা নাগালের বাইরে। মাছ,মুরগী তারাও ক্রমশ নাগালের বাইরে যেতে শুরু করেছে। সম্প্রতি শাকসবজিও সেই পথ অনুসরণ করছে।  কাঁচা লঙ্কা অকস্মাৎ মহার্ঘ্য হয়ে উঠেছে। সেই ঝাঁঝ লেগেছে অন্যান্য সবজিতেও। বেগুন বেপাত্তা বাজার থেকে। খুঁজে পেলে প্রায় সোনার দাম। বাদবাকিদের অবস্থাও তথৈ বচ।

বড়রা একসময় অর্থনীতি পর্যবেক্ষণ ক’রে বলতেন একটা সময় আসবে যখন ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে পকেটভর্তি বাজার করতে হবে। তাঁদের সেই ভবিষ্যৎবাণীর সত্যতা আজ হারে হারে টের পাচ্ছি। এখন ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে বড়জোর পকেটভর্তি বাজার করতে পারি। কিন্তু যে হারে সবজির দাম বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে দেখা যেতে পারে বাটখারার বদলে টাকার ব্যবহার। অর্থাৎ (সর্বোচ্চ নোটের) টাকার ওজনের বিনিময়ে আপনি পাবেন আপনার অতি আকাঙ্ক্ষিত সবজি।  সবজির মূল্যবৃদ্ধির এই ধারা অব্যহত থাকলে ব্যাঙ্কগুলিও হয়ত গ্রাহকের বাড়ি জমি বন্ধক রেখে সীমিত সুদে সবজী কেনার জন্য ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা নেবে। ইএমআই-এর প্রতি আকৃষ্টরা এই ফাঁদে পা দিতে এগিয়ে আসবে। আর কেউ কেউ হাজার হাজার কোটি ঋণ নিয়ে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।  

আমাদের দেশে সর্বক্ষেত্রে চলে সুবিধাবাদের নীতি। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে বোকা বানানোর সব রকম নীতি নির্ধারিত হয়। এতদিন আমরা শুনে এসেছি সবজি খাওয়া মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ভালো। সবজির এই মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম টানতে না পেরে হয়ত একদিন ঘোষিত হবে নতুন তত্ত্ব ‘সবজির চেয়ে বেশী ক’রে হাওয়া খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী’। অতএব অর্থাভাবে সবজির পরিবর্তে হাওয়া খেয়েই বেঁচে থাকার কথা ভাবতে হবে এবং সরকারী পরিসংখানে উন্নয়নের ঘোড়া ছুটবে টগবগিয়ে।

বইপত্তরে ভূতের গল্পে যে ভূতগুলো মাছপিপাসু ছিল, রাতের বেলায় পথিকের হাত থেকে বিশাল লম্বা হাতওয়ালা ভয়ঙ্কর ভূতগুলো মাছ ছিনিয়ে নিয়ে খেত, অচিরেই হয়ত তারা নিরামিষাশী হয়ে উঠবে। হয়ত তারা গাছের ওপর থেকে লম্বা হাত বাড়িয়ে ছিনিয়ে নেবে পথিকের অনেক মূল্যে কেনা  এক আটি লাউশাক কিংবা মহার্ঘ্য বেগুন।

হয়ত অদূর ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে যখন দেখা যাবে সবজী বাগান পাহাড়ার জন্য মোতায়েন করা হয়েছে সসস্ত্র পুলিশ। এক্ষেত্রে বাগান মালিক যে কেন্দ্রীয় বাহিনী দাবি করবেন না তা হলফ ক’রে বলা কঠিন।  

অনেকদিন আগে থেকেই আমাদের দেশে অনেক দেশি-বিদেশী সংস্থা শপিং মলে মাছ মাংস সহ বিভিন্ন সবজি বিক্রির ব্যবসা শুরু করেছে। সবজির ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি যেদিন আকাশ ছোঁবে, সেদিন হয়ত হাটে বাজারে সবজি মিলবে না, মিলবে সেই সমস্ত মলে এবং যথারীতি কান ম’লে দাম নেবে ।  এখন জিনিসপত্র কেনার ক্ষেত্রে নানা রকম উপহার মেলে। যেমন দুটো প্যান্ট কিনলে একটা টিশার্ট ফ্রি ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর হয়ত দেখা যাবে দুটো প্যান্ট কিনলে মিলবে পাঁচশো গ্রাম ঝিঙে ফ্রি।

এখন মেয়ের বিয়ে দিতে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সিএ, শিক্ষক এরকম উচ্চ আয়ের পাত্রের চাহিদা বেশী। কিন্তু ভবিষ্যতে বিয়ের বাজারে সবজি ব্যবসায়ী পাত্ররা অন্য পেশার পাত্রদের ল্যাং মেরে ফেলে দেবেন বলে ধারণা করা যায়। তখন পাত্র চাই বিজ্ঞাপন ঈষৎ পরিমার্জিত হয়ে ছাপা হবে এভাবে:

সুন্দরী, সামাজিক মাধ্যমে কম আসক্ত প্রতিষ্ঠিত সবজি ব্যবসায়ী পাত্র চাই। পাত্রকে পাত্রীর পরিবারকে সারাজীবন বিনামূল্যে সবজি সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।

উন্নয়নের অদৃশ্য ঘোড়া রাজনৈতিক নেতাদের মুখে যতই টগবগিয়ে ছুটুক, সবজি সহ খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনার আশু ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে উঠবে।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?