নবমীতে মন খারাপ –
অ.না.ক. ০৭/১০/২০১৯
'যেও
না নবমী নিশি' হাজার আকুতি সত্ত্বেও নবমীর নিশাবসান হবেই। আসলে এই আকুতির মূল
বক্তব্য উৎসবের আনন্দের
স্থায়ীত্ব আর একটু দীর্ঘ
হ'লে ভাল হ'ত। আমার যেহেতু
পুজো এলেই মন খারাপের রোগ
আছে, অতএব সে আকুতি প্রকাশের
আগ্রহ আমার নেই। তবে নবমীতে আর সকলের ভারাক্রান্ত
মুখের দিকে চেয়ে আমার মন খারাপ হয়।
এ মন খারাপ মূলত
সমবেদনা প্রকাশ। অনেক প্রতিমা দেখেছি এবার। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিমার আদলের পরিবর্তন নিয়ে কেউ খুব একটা মাথা ঘামায় না, বরং থিম নিয়েই সবাই যেন বেশি ভাবিত। রবীন্দ্র সঙ্গীতের
সুর পালটে যাচ্ছে কপি রাইট উঠিয়ে নেওয়ার পর থেকে। পুরোনো
গান রিমেক করা হচ্ছে নতুন আঙ্গীকে। এ সবই আধুনিকতাকে জানান দিতে। আমরা ছোট বেলায় খুব উৎসাহ নিয়ে প্রতিটা প্যান্ডেলের দুর্গা প্রতিমার মুখ-চোখের আদল দেখতাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। বিশেষ ক'রে অসুর
আর কার্তিকের চেহারা নিয়ে আমাদের মধ্যে সমালোচনার ধুম পড়ে যেত। এখন দুর্গা প্রতিমাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট বিরল
ঘটনা। দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরের হরিশ মুখার্জী রোডের দে বাড়ির পুজোতে কিন্তু গত দেড়শ
বছর ধরে অসুরকে দেখা যায় কোট-টাই পড়া ইংরেজের বেশে। এর ব্যাখ্যা স্পষ্ট। অসুররূপী ইংরেজদের
নিধন করেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এসেছিল। বাংলা ও বাঙালির চিরাচরিত জীবনধারাতে বিশেষ
করে প্রাচীন সমাজের গতানুগতিক রীতিনীতি বদলের ক্ষেত্রে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি অগ্রণী
ভূমিকা পালন করেছিল। প্রিন্স দ্বারকানাথের
স্ত্রী দিগম্বরীদেবী ছিলেন অসামান্যা সুন্দরী এক নারী, কথিত আছে তাঁর আমলে ঠাকুরবাড়ির
দুর্গাপুজোর মূর্তি দিগম্বরীদেবীর মুখের আদলে তৈরি করা হত। যদিও পরবর্তীকালে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারনে ঠাকুর পরিবারে দুর্গাপুজো সম্পূর্ণ
বন্ধ হয়ে যায়। খারাপ লাগে, যে দেবীকে ঘিরে এই উৎসব, তাঁর প্রতি মনোনিবেশ না ক’রে
অন্যান্য বিষয়ের প্রতিই উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বেশী। এক সময় পুজোর গান নিয়ে মাতামাতি
হ’ত। এখন আর আলাদা ক’রে পুজোর গান তৈরি হয় না। শিল্পীদের মধ্যেও এই আক্ষেপ শোনা
যায়। তবে, আমাদের একটাই সান্ত্বনা, ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ বাঙালী ছিলেন আর তিনি
অফুরন্ত গান লিখেছিলেন। আজ নবমী – অর্থাৎ দুর্গোৎসবের অন্তিম দিন। আগামীকালই মাটির
প্রতিমা জলে গুলে যাবে। প্রতিমা মাটির। মৃৎশিল্পীর বছরভর অক্লান্ত পরিশ্রম আর তাঁর
শৈল্পিক কুশলতায় তিল তিল ক’রে গড়ে তোলা শিল্প কর্মের সলিল সমাধি হবে দশমীতে। যেহেতু
মৃৎশিল্প তাই বিসর্জনে দুঃখ নেই। আগামী বছর আবার
শিল্পীর কুশলতা প্রকাশ পাবে, তৈরি হবে আর্থিক আনুকূল্য। কিন্তু এই যে থিম-এর
পেছনে বিপুল অর্থ-ব্যয় তার দায়-ভার কিন্তু নিতে হবে আমাদের সকলকেই, ধনী দরিদ্র
নির্বিশেষে । এখানেই আমার আপত্তি। যা হোক, গত কয়েকদিনের রঙিন জীবনের শেষে আবার
ফিরে আসবে সাদা-কালো প্রাত্যহিক জীবন যাপন। এটা মন খারাপের কারন হলেও এটাকে বাস্তব
ধ’রে সারা বছর আনন্দমুখর থাকাটাই হয়ত যুক্তিসঙ্গত। শুভ রাত্রি। কাল দশমীতে আবার
লেখার চেষ্টা করব – এবারের দুর্গাপুজোয় শেষ লেখা। শুভ রাত্রি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন