বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৯

পাশ-ফেল থাক বা না থাকঃ অমরনাথ কর্মকার


কারোও মৃত্যুতে একজন নেতা-মন্ত্রী কিংবা খ্যাতনামা ব্যক্তির শোক প্রকাশের ছবি বা সাফল্যের আনন্দোচ্ছ্বাস নানাভাবে ভিস্যুয়াল মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। জীবনের সুখ-দুঃখ আজ অনেকটা বিক্রয়যোগ্য পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। আনন্দ একটি ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রশ্ন কিন্তু আজকাল তা ফলাও ক’রে টিভিতে দেখানোর বা খবরের কাগজে প্রকাশিত হবার রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেতার সম্প্রচারে তা দৃশ্যমান হয় না বলেই বেতার আজ অনেকটাই ব্রাত্য। 

একটা যুতসই উপলক্ষ পেলেই শোক প্রকাশ কিংবা আনন্দোচ্ছ্বাস প্রকাশের আনুষ্ঠানিক আয়োজন করা বাঙালীর একটা প্রবৃত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে। ইংরেজদের মূলগত উদ্দেশ্য ছিল তাদের শাসন ব্যবস্থার ভীত পাকা-পোক্ত করা। আজ অবধি মোটামুটি সেই শিক্ষা ব্যবস্থাই চালু আছে এদেশে। হয়ত মাঝে মাঝে সংস্কার করা হয়েছে কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থায় আদৌ বিপ্লব আসেনি। এই সংস্কারের ফলে কতটা উপকার বা অপকার হয়েছে সে সব বিবেচনা না করেই বলা যায় আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভাব রয়েই গেছে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বিদ্যাচর্চার পাশাপাশি পাশ-ফেলও ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিদ্যা চর্চা করার পর বিদ্যার্জনের মাপকাঠি হিসাবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বা অকৃতকার্য হওয়ার নাম যথাক্রমে পাশ ও ফেল। ফেলের কোনো ডিভিশন বা গ্রেড নেই কিন্তু পাশের তা আছে। পরীক্ষায় ভাল ফল ক’রে আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রাণ হারানোর নজির নেই কিন্তু পরীক্ষায়  ফেল ক’রে প্রতি বছর হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের বাবা-মাও আত্মহনন করে। একটা নর্দমাকে যতই সংস্কার করা হোক না কেন, পরিকল্পিত নিকাশী ব্যবস্থা না থাকলে তার আবর্জনা স্থায়ীভাবে পরিস্কার রাখা দুঃসাধ্য। মাঝখানে বেশ কয়েক বছর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছিল। ফলে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তরণের ক্ষেত্রে কোন বাধা ছিল না। এই পদ্ধতি প্রবর্তনের অন্যতম কারন হিসাবে বলা হয়েছিল এতে স্কুল-ছুট শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমবে। এই সংস্কারের সুফল না পেয়েই কি সরকার পাশ-ফেল প্রথা পুনর্বহাল করার পরিকল্পনা নিয়েছে ?
বিদ্যার্জন বিষয়ে আমাদের ধারনা বৈষয়িক। অর্থাৎ শিক্ষার্থী ভালো নম্বর নিয়ে পাশ ক’রে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, মোটা মাইনের চাকুরীজীবি হোক এটাই সকলের প্রত্যাশিত। অর্থাৎ উদ্দেশ্য মোটা অঙ্কের অর্থোপার্জন।  তাই পাশ করলে আনন্দোচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে যায় আর ফেল করলেই হতাশা, আত্মহত্যা, পড়া ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর একদিকে টিভি চ্যানেলে পাশ করা কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে অকৃতকার্যদের মুখ লুকানো, আত্মহনন। এ এক অদ্ভুত কন্ট্রাস্ট। পরীক্ষায় ভাল ফল করা নিঃসন্দেহে খুব গৌরবের, কিন্তু ফেল করলেই জীবন ব্যর্থ, এই ধারণা আমাদের মজ্জাগত। আসলে এই ধারণা সৃষ্টির উৎস কয়েক শতক ধ’রে চ’লে আসা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষা পদ্ধতি। 

বঙ্কিমচন্দ্র বাংলায় ফেল করেছিলেন।  ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বি এ পরীক্ষার প্রবর্তন করে। সে বছর মোট ১৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র দু’জন পাশ করেছিলেন, তাও টেনে টুনে দ্বিতীয় বিভাগে-  একজন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অন্যজন যদুনাথ বসু। আজ কোথায় বঙ্কিম চন্দ্র আর কোথায় যদুনাথ বসু। একথাও হয়ত জানা আছে যে বাঙালীর অন্যতম বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু প্রথমবার বিএ পরীক্ষায় ফেল করেন। পরবর্তীকালে বিএসসি, এমএসসি, ডিএসসি পরীক্ষায় তাঁর সাফল্য এবং বিজ্ঞানে তাঁর অবদান সম্পর্কে জানেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। বিশ শতকের উপমহাদেশের স্বনামধন্য চিকিৎসক নীল রতন সরকার কোন রকমে বিএ পাশ ক’রে শিক্ষকতা করতে শুরু করেন। কিন্তু ১৮৮৫ সালে তিনিই ডাক্তারিতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসক হিসাবে বিশ্ববন্দিত হন। এই উদাহরণগুলি দেওয়ার উদ্দেশ্য একটাই – পরীক্ষায় সাফল্য বা অকৃতকার্যতা কখনোই একজন মানুষের প্রতিভার মানদন্ড হতে পারে না। 

অর্ধ শতক আগেও বাঙালীর শিক্ষার মান ছিল উচ্চ। ইউরোপের মত না হলেও তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতই। তারপর আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত দেশগুলি তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এনেছে পরিবর্তন নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূল্য দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীকে মানসিক চাপ মুক্ত ক’রে তাদের কাছে শিক্ষাকে উপভোগ্য করার বিষয়ে। এছাড়াও শিক্ষার্থীর বিষয়ভিত্তিক আগ্রহকেও যথেষ্ট প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে পাশ-ফেল থাকা বা না থাকা একেবারেই গুরুত্বহীন বিষয়। রবীন্দ্রনাথও চেয়েছিলেন আমাদের দেশের এই গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষায় ভিন্ন পদ্ধতি প্রবর্তনের। পাশ-ফেল থাকা বা না থাকা এই সমস্ত সংস্কারমূলক চিন্তা ভাবনার চেয়েও আজ  বেশি জরুরী হয়ে পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থায় সামগ্রিক উন্নতি সাধন - শিক্ষাকে চাপ-মুক্ত আনন্দময় ক’রে তোলার ব্যাপারে কি পদ্ধতি অবলম্বন করা যায় সে দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। এই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সাহায্য নেওয়াটাও বোধহয় গুরুত্বপূর্ণ। শুধু প্রতিযোগিতার ইঁদুর-দৌড়ে অংশ নেওয়াই যদি শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হয় তবে তা হবে প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ গড়ে তোলার অন্তরায়। এতে হয়ত ডিগ্রিধারীর সংখ্যা বাড়বে – শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির কাজে লাগবে না।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?