শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৬
শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৬
আলো ছাড়া অস্তিত্বহীন অন্ধকার
আলো ছাড়া অস্তিত্বহীন অন্ধকার
অন্ধকারকে দেখতে লাগে দৃষ্টি ক্ষুরধার
দৃষ্টি মানেই আলো, শুধু আলো ।
অ.না.ক. ২৮/১০/'১৬
অন্ধকারকে দেখতে লাগে দৃষ্টি ক্ষুরধার
দৃষ্টি মানেই আলো, শুধু আলো ।
অ.না.ক. ২৮/১০/'১৬
রবিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৬
একটা কবিতার গল্প
একটা
কবিতার গল্প
অমরনাথ
কর্মকার ২২/১০/২০১৬
বলা নেই
কওয়া নেই হঠাৎ আজ বিকেলে সস্ত্রীক পঙ্কজ আমাদের বাড়িতে হাজির । সকালে অচেনা নম্বর
থেকে আমার কাছে ফোন এসেছিল একটা – বলল দুটো মাল আপনার বাড়িতে আসছে আপনার বাড়ির
সঠিক ঠিকানাটা জানা জরুরী । আমার বাড়ি থেকে মাঝে মাঝেই অনলাইনে জিনিসপত্রের অর্ডার
দেয় আমার ছেলে বা স্ত্রী । ভেবেছিলাম এরকমই কোন ব্যাপার হবে নিশ্চয়ই । তাই অবলীলায়
ঠিকানাটা ব’লে দিয়েছিলাম । বিকেলে কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খোলার আগে জিজ্ঞাসা
করলাম, “কে ?” ওপার থেকে উত্তর এল, “মাল দুটো এসে গেছে – দয়া ক’রে দরজা খুলুন ।“
দরজা খুলে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে কাউকেই চিনতে পারছি না । আজকাল প্রতারণা চক্র
যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সে কথা ভেবে, সত্যি বলতে কি, বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম ।
আমার সন্দিহান মুখ দেখে আগন্তুক ভদ্রলোকই নিজেই ভয় ভাঙিয়ে বলল, “আমাকে চিনতে পারলি
না ? ক্লাস ইলেভেনের কবিতার কথা মনে পড়ছে তোর ?” কবিতার কথা বলাতেই স্মৃতির
এ্যালবামটা কে যেন চোখের সামনে মেলে ধরল । মনে পড়ে গেল সব । হো হো ক’রে হেসে
উচ্চস্বরে ব’লে উঠলাম আরে পঙ্কজ না ? এতবছর পর হঠাৎ আমার বাড়িতে ? সাদর অভ্যর্থনায়
ঘরে নিয়ে বসালাম । আজ বিজয়া দশমী । পারস্পরিক সৌহার্দ বিনিময়ের উৎসব । দীর্ঘ পঁচিশ
বছর বাদে এক সতীর্থের সঙ্গে সাক্ষাৎ উৎসবের আনন্দকে কোন মাত্রা দিতে পারে তা বলাই
বাহুল্য । ওর
স্ত্রীকে নীরব দেখে সহাস্যে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি ম্যডাম অত চুপচাপ কেন ?” শুধু
শব্দহীন একগাল হাসি দিয়েই জবাব এল । পাশ থেকে পঙ্কজ ব’লে উঠল, “আদতে এরা প্রবাসী
বাঙালী । ওর জন্ম, বড় হওয়া, শিক্ষা সবই আমেরিকার নিউ জারসিতে । বাবা-মা বাংলা
জানার সুবাদে ও বাংলাটা বোঝে বটে, বলতে প্রায় পারে না বললেই চলে ।“ ইতিমধ্যে ঘরে
হাজির হয়ে গেছে আমার স্ত্রী আর ছেলে । আমার স্ত্রী আর পুত্রের সাথে পঙ্কজের পরিচয়
করিয়ে দিয়ে ওদের যাবতীয় আপ্যায়নের ভার স্ত্রীর ওপর সঁপে দিয়ে আমি পঙ্কজকে নিয়ে
চললাম ওপরের ঘরে ।
পঙ্কজ
আর আমি সেই নার্সারি থেকে সহপাঠী । একই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ ক’রে দুজনে আবার
একই স্কুলে সায়েন্স নিয়ে ইলেভেনে ভর্তি হলাম । ইলেভেন-টুয়েলভ আমাদের ছিল কো-এড । আমরা
যেমন মেয়েদের সঙ্গে হই-হুল্লোর, হাসিঠাট্টা করতে অভ্যস্ত ছিলাম, পঙ্কজ ছিল ঠিক তার
বিপরীত । ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে ও রীতিমত লজ্জা পেত । পঙ্কজের সঙ্গে আমার
আন্তরিকতা ছিল বেশ গাঢ় । ও ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পেত বটে, তবে কোন
সহপাঠিনী ওর পছন্দসই হ’লে আমাকে বলত । আমাদের স্কুলের ঠিক আগেই একটা মেয়েদের স্কুল
ছিল । আমাদের ফিজিক্স ল্যাবের জানলা দিয়ে ক্লাস নাইনের ক্লাসরুম দেখা যেত । লক্ষ্য
করতাম যেদিন আমাদের ফিজিক্স ল্যাবে প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস থাকত সেদিন পঙ্কজকে খুব
খুশি খুশি লাগত । একদিন আমার চোখে প’ড়ে গেল একটা মেয়ে আমাদের ল্যাবের দিকে তাকিয়ে হাত
মুখের অঙ্গভঙ্গিমায় কাকে যেন ইশারা করছে । বৃষ্টি ব’লে সেদিন আমাদের হাতেগোনা
মাত্র কয়েকজন হাজির । স্পষ্ট দেখলাম পঙ্কজ জানলায় দাঁড়িয়ে । সেই মুহূর্তে পঙ্কজকে
কিছু বলিনি । ভেবেছিলাম সুযোগ বুঝে ওর ডুবে ডুবে জল খাওয়ার প্রসঙ্গটা তুলব ।
ছোট
বেলা থেকেই আমার লেখালেখির প্রতি আগ্রহ ছিল । মাঝে মাঝে কবিতা লিখতাম । পড়তাম বিজ্ঞান অথচ সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রবল
। আমার এহেন লেখালেখির কথা অনেকেই জানত । পঙ্কজ প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসত । পঙ্কজ মাধ্যমিক পরীক্ষায় একটু
ভালই নম্বর পেয়েছিল ব’লে ও সায়েন্স নিয়েছিল তাও আবার পিওর সায়েন্স । কিন্তু কিছুদিন
যেতে না যেতেই ওর অবস্থা ঢিলে হতে শুরু করল । আসলে আমরা সবাই জানতাম মাধ্যমিকে ভাল
নম্বর পেলেও বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা ওর ছিল না । বাবা মায়ের ইচ্ছে
পূরণের তাগিদেই ও এইচ এসে বিজ্ঞান নিয়েছিল । অদ্ভুত ব্যাপার ও আমাদের বাড়িতে আসলে
কোনোদিন ক্লাসের পড়াশুনা নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করত না । ওর আগ্রহ ছিল আমার লেখার
প্রতি । নতুন কিছু লিখলেই ওকে তার একটা কপি দিতে হ’ত । হাবাগোবা গোবেচারা টাইপের
ছেলে পঙ্কজ । আমার লেখার খুব প্রশংসা করত । স্বভাবতই আমার লেখার গুণমুগ্ধ হওয়াতে
পঙ্কজকে আমার লেখার কপিগুলো ওকে পড়তে দিয়ে নিজেকে লেখক ভাবার আনন্দ পেতাম মনে মনে
। কিন্তু একদিন হঠাতই আমার বিশ্বাসভঙ্গ হল পঙ্কজের প্রতি । সেদিন ক্লাসে লক্ষ্য
করলাম আমার কয়েকজন সহপাঠী একটা গল্প নিয়ে আলোচনায় মশগুল । আমি কাছে যেতেই আমাদের
স্কুলের পাশের মেয়েদের স্কুলের একটা ম্যাগাজিন থেকে একটা গল্প বের করে শোনাল এবং
গল্পটার প্রশংসায় ওরা পঞ্চমুখ । লেখিকার নাম লেখা আছে শর্বাণী পুরকায়স্থ, ওই
স্কুলেরই ক্লাস নাইনের ছাত্রী । আমার তখন চক্ষু চরখগাছ । আরে এতো কিছুদিন আগে লেখা
আমারই গল্প । সেই মুহূর্তে কাউকে কিচ্ছু বললাম না । মনে মনে শুধু একটা
প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করতে লাগল । পঙ্কজ রইল আমার সন্দেহের তালিকার শীর্ষে । আমার
সন্দেহকে যথার্থ প্রমাণ করার জন্য কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা করলাম ।
ঘটনার কয়েকদিন বাদে আমাদের ফিজিক্স ল্যাবে আবার পঙ্কজকে দেখলাম জানলায় দাঁড়িয়ে
পাশের স্কুলের ওই মেয়েটার সঙ্গে ইশারায়
কথা বলছে । আমি যে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করছি পঙ্কজ সেটা বুঝতে
পা্রেনি । পেছন ফিরে আমাকে দেখেই একটু অপ্রস্তুত বোধ করল । আমি বললা্ম – মেয়েটার
নাম কি রে ? কোন ক্লাসে পড়ে ? লজ্জা পেলেও
নামটা ব’লে দিল – ওর নাম শর্বাণী পুরকায়স্ত, ক্লাস নাইনে পড়ে । এবারে প্রায় নয়
পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম – একাজ নির্ঘাত পঙ্কজের । সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম শুধু ।
পঙ্কজের কাছ থেকেই জানতে পারলাম শর্বাণীর প্রতি ওর ভালোবাসা জন্ম নিচ্ছে ক্রমশ
। পঙ্কজ আমার কাছে এলেই ওর মুখে সর্বক্ষণ শর্বাণীর গল্প, ওর প্রশংসা, ওর লেখার
তারিফ । একদিন বললাম, ‘ও যে ভালো লেখে সে তো স্কুল ম্যাগাজিনে ওর লেখা দেখেই
বুঝেছি।‘ কথাটা বলার পর ওর মুখের গতিক বোঝার চেষ্টা করলাম । ওর মাথা নাড়ার ভঙ্গিমা
দেখেই বুঝতে অসুবিধা হ’ল না যে শর্বাণীকে লেখাটা ওই সাপ্লাই করেছিল আমার কাছ থেকে
। বললাম, শর্বাণীর লেখা তো মাঝে মাঝে আমাকে দিতে পারিস – ভালো লেখা পড়তে আমার খুব
ভালো লাগে – তা ছাড়া অনেক সমৃদ্ধ হওয়া যায় । পঙ্কজ সোৎসাহে রাজিও হয়েছিল । কিন্তু
কোনোদিন শর্বাণীর একটি লেখাও আমাকে দেয়নি – বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়েছে
। তবে আমার লেখা পঙ্কজ নিয়মিত নিয়ে যেত পড়ার জন্য – আমি অবশ্য নির্দ্বিধায় ওকে
দিয়ে দিতাম । এমনকি ঘটনাটা জানার পরেও । শুনলাম পঙ্কজের সঙ্গে শর্বাণীর প্রেম বেশ
জমে উঠেছে ।
সেদিন কি যেন একটা কারনে আমি স্কুলে যাইনি । দুপুর বেলা শুয়ে শুয়ে অংক করছিলাম
। হঠাৎ স্কুলের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় হাঁপাতে হাঁপাতে পঙ্কজ এসে হাজির । দর দর
করে ঘামছে । ‘সুদেব প্লিজ একটা উপকার কর, নইলে আমার সব মাটি হয়ে যাবে’। ওর উদ্বেগ
দেখে বললাম ‘কি হয়েছে একটু খুলে বল তো’। আসল ঘটনাটা হ’ল আগামী কাল শর্বাণীর
স্বরচিত কবিতার একটা কম্পিটিশন আছে কোলকাতায় । তাই তোর লেখা একটা ভাল কবিতা দিতেই
হবে । ‘আরে ও নিজেই তো ভাল লেখে, নিজের কবিতাই তো দিতে পারে’, আমি পাল্টা প্রশ্ন
করলাম । ‘সে জানিনা’, পঙ্কজের গলায় কেমন যেন হতাশার সুর । আর একটি প্রশ্ন না ক’রে
পারলাম না । ‘কবিতার জন্য তোকেই বা বলল কেন, তুই যে কবিতা লিখিস না সেতো শর্বাণী
জানেই’। কোন প্রত্যুত্তর পেলাম না পঙ্কজের কাছ থেকে । শুধু এমনভাবে কাকুতি-মিনতি
করতে থাকল যেন মনে হ’ল কবিতাটা না পেলে শর্বাণীর সঙ্গে ওর সম্পর্কটা বিচ্ছিন্ন হয়ে
যাবে । আমার মনে সেই প্রতিশোধস্পৃহা ভীষণভাবে জেগে উঠল এবার । ‘দাঁড়া দিচ্ছি’ বলে
পঙ্কজকে আশ্বস্ত ক’রে ঘরে গিয়ে একটা কবিতা কাগজে লিখে এনে পঙ্কজকে দিলাম । কাগজটা
হাতে পেয়ে পঙ্কজ ভীষণ খুশী – যেন হাতে স্বর্গ পেয়েছে । এক মুহূর্ত দেরি না ক’রে
পঙ্কজ উধাও হ’ল ।
তার ঠিক একদিন পরের ঘটনা । অত্যন্ত মর্মান্তিক, অত্যন্ত ট্র্যাজিক । স্কুলের
টিফিন পিরিয়ড চলছে তখন । আমরা কয়েকজন সহপাঠী মিলে স্কুলের মাঠে ব’সে টিফিন খাচ্ছি
। পঙ্কজটা স্কুলের বাইরে বেরিয়ে গেছে কিছু না ব’লে । আমরা গল্প করতে করতে খাচ্ছি ।
হঠাৎ প্রায় ছুটতে ছুটতে পঙ্কজ এসে হাজির । এসেই মাথা নিচু ক’রে ব’সে পড়ল । সমস্বরে
জিজ্ঞাসা করলাম – কি রে কি হয়েছে ? পঙ্কজ প্রায় ডুকরে কেঁদে ব’লে উঠল, ‘শর্বাণী
আমাকে চড় মেরেছে’। বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’ পঙ্কজকে শান্ত ক’রে ওর কাছ থেকে
যা জানা গেল তা হ’ল গতকাল শর্বাণী স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় যে কবিতাটা পাঠ
করেছে সেটি আসলে কোন বিখ্যাত আধুনিক কবির কবিতা । এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর
শর্বাণীকে সর্বসমক্ষে অপমানিত হ’তে হয়েছে এবং তারই বদলা হিসাবে পঙ্কজকে শর্বাণীর
হাতে চড় খেতে হয়েছে । আমি বাদে বাকীরা পঙ্কজের চড় খাওয়ার কারন জানতে যখন উৎসুক তখন
আমিই সবিস্তারে প্রকৃত সত্যটা প্রকাশ করলাম এবং এই ঘটনার নেপথ্য নায়ক হিসাবে
নিজেকে দোষী সাব্যস্ত ক’রে পঙ্কজের কাছে করজোড়ে ক্ষমাও চেয়ে নিলাম । আমি সেদিন
ইচ্ছে করেই ঘরে গিয়ে বই ঘেঁটে বিখ্যাত এক কবির অপিরিচিত একটা কবিতা টুকে এনে আমার
লেখা হিসাবে পঙ্কজের হাতে তুলে দিয়েছিলাম । স্বভাবতই বিচারকদের তা নজর এড়ায়নি এবং
তার পরিণাম শর্বাণীকে ভোগ করতে হয়েছে ।
সেদিনই কথা প্রসঙ্গে পঙ্কজ স্বীকার করল যে স্কুল ম্যাগাজিনে যে গল্পটা
শর্বাণীর নামে ছাপা হয়েছিল সেটা আসলে আমারই লেখা এবং শর্বাণী সেটা নিজের নামে
চালিয়েছে । আমি ব্যঙ্গ ক’রে বললাম, ‘তুই তো ওকে আমার অনেক লেখাই দিয়েছিস, সেগুলো আবার অন্য কোথাও শর্বাণীর নামে
ছাপা হয়নি তো?’ পঙ্কজ একথা স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হ’ল না যে লেখালেখির ব্যাপারে
শর্বাণীর কোন আগ্রহ নেই – নাম কেনার জন্যই এত কান্ড । সেই শেষ – সেদিন থেকে
পঙ্কজের মুখে আর কোনোদিন শর্বাণীর নাম উচ্চারিত হ’তে শুনিনি ।
হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর বাংলা অনার্স, তারপর যাদবপুর থেকে মাস্টার্স, পি
এইচ ডি ক’রে পঙ্কজ ইতালিতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি দপ্তরে উঁচু পদের চাকরি করতে চলে
গেল, সেই সাথে বিভিন্ন লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে বেশ পরিচিত
নাম হয়ে উঠল । মাঝে মাঝেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ওর নামে লেখা দেখি কিন্তু জানা ছিলনা
এই সেই আমার সহপাঠী পঙ্কজ । উপরের ঘরে আমি আর পঙ্কজ এতক্ষণ গল্প করছিলাম । এখনই
পঙ্কজের এই পরিচয় জানতে পারলাম । কারন হায়ার সেকেন্ডারির পর থেকে পঙ্কজের সঙ্গে এই
আমার প্রথম দেখা । আমার পড়াশোনা সেভাবে হয়নি । সরকারী অফিসে কেরানীর কাজ ক’রে জীবিকা
নিরবাহ নির্বাহ করি । তবে শখের লেখায়
খামতি নেই । নিয়মিত লেখার চেষ্টা করি, কখনো সখনো কেউ কেউ পড়ে, নতুবা খাতার পাতায়
ঘুমিয়ে থাকে মুক হয়ে ।
স্কুল জীবনের গল্প, নস্টালজিয়া এসবের মাঝে নিচ থেকে স্ত্রীর ডাক শুনতে পেলাম,
‘চা রেডি, নিচে এস’। সবাই মিলে অনেকক্ষণ খাওয়া-দাওয়া আড্ডা, হই-হুল্লোড় হ’ল । ফেলে
আসা ইতিহাসগুলো আমার স্ত্রীকে শোনালাম । পঙ্কজের স্ত্রীর মুখে অবিচ্ছিন্ন হাসি ।
বাংলাটা ও ভালই বোঝে – হয়ত সেভাবে বলতে পারে না বলেই নীরব শ্রোতা হয়ে আছে । ওরা
বেরিয়ে যাবার ঠিক প্রাক মুহূর্তে পঙ্কজ আমার স্ত্রীকে একটা কথাই ব’লে গেল – আপনার
স্বামীর মত সহপাঠী ছিল ব’লেই আমি আজ ইতালিতে – ওর জন্যই ছুটে এসেছি এই কোলকাতায়
দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর । দেখলাম আমার স্ত্রীর চোখে জল । যেতে যেতে পেছন ফিরে আমাকে
উদ্দেশ্য ক’রে বলল, ‘শর্বাণীর অবদানও কম নয় রে’ ।
রাতে স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতে করতে জানলাম ওর স্ত্রী পঙ্কজের জীবনে তোমার
অবদানের সবটাই জানে – ভাঙা বাংলায় সবটাই সে বলেছে আমার স্ত্রীকে । এবারও দেখলাম
স্ত্রীর চোখে জল । বলল, ‘তুমি এত লেখ অথচ কোথাও ছাপা হয়না । এনিয়ে তোমাকে অনেক
বলেছি । মনে কিছু করোনা । পঙ্কজদা তো তোমারই সৃষ্ট চরিত্র – এবং বাস্তব’।
মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৬
সোমবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৬
নবমীতে মন খারাপ
নবমীতে মন খারাপ
পূজোর আনন্দ অবসানের প্রাকমুহূর্তে, নবমী নিশি অতিক্রান্ত
না হওয়ার আকুতি জানিয়ে সকলেরই বাসনা উৎসবের আনন্দ আরও একটু স্থায়ী হোক । আজ তাই
সবার মন খারাপ । আর আমার তো এমনিতেই মন খারাপ হয়েই আছে । মন খারাপ দিয়ে শুরু করেছিলাম ষষ্ঠী থেকে – সেই মনখারাপ প্রবহমান নবমীর রাত পর্যন্তও । বাইরে বৃষ্টি, উৎসবের
আনন্দে ভাঁটা । আজ বোধ হয় সকলেরই মন খারাপ । তাদের মন খারাপের নির্দিষ্ট কারন আছে – উৎসবের
আনন্দে বৃষ্টির
অনুপ্রবেশ আর দেবী দুর্গার ‘অদ্য শেষ রজনী’র
বিহ্বলতা । ওসবে আমার মন
নেই । আমার মন খারাপের কারন হয়ত আছে কিন্তু শত অনুসন্ধানেও তার হদিশ পাচ্ছি না ।আজ নবমী – বাতাসে বিষাদ – সবার মন খারাপ । আমি ছবি তুলতে
খুব একটা পছন্দ করি না । বিশেষ ক’রে সেই ছোট্ট বেলা থেকেই নিজেকে ক্যামেরার সামনে
দাঁড় করানোর ব্যাপারে আমার ভীষণ আপত্তি ছিল এবং আজও নিজেকে ক্যামেরার সামনে থেকে
দূরে রাখার চেষ্টা করি । সবসময় কেন যেন মনে হয় ছবিতে অন্যদের সঙ্গে আমাকে বেমানান
লাগবে । তাই চারিদিকে কত দর্শনীয় প্যান্ডেল, প্রতিমা থাকা সত্ত্বেও একটিও
ক্যামেরাবন্দি করিনি । আমার ফেসবুকে সাধারণত আমি খুব কমই ছবি আপলোড করি । সবাই
জানেন আমার প্রোফাইল পিকচার-এ অনামি অথচ প্রতিভাবান শিল্পীর আঁকা আমার একটা
পেন্সিল স্কেচ আছে – ক্যামেরাবন্দি ছবি নেই । মন খারাপের প্রসঙ্গ বলেই ছবির কথাটা
তুললাম । ছবি তুললেই আমার মন খারাপ হয়, শুধু ভাবি আজকের ছবিটা ক্রমশ পাল্টাতে শুরু
করবে – একসময় হয়ত কোন মিলই থাকবে না আজকের
সঙ্গে । স্মৃতির সরণি বেয়ে অনেকটা এগিয়ে এসে পেছন ফিরে যখন দেখব সেখানে সব
অস্তিত্বহীন তখন কষ্ট হবে । আজ একটা ব্যাপারে আমি সবার সঙ্গে এক পঙক্তিতে – সবার
মতই আমারও মন খারাপ যদিও আমার মনখারাপের কারন অজ্ঞাত । স্বয়ং দেবী দুর্গার মুখেও
নাকি আজ মন খারাপের স্পষ্ট প্রকাশ ।
আজ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার উদ্ধৃতি
দিয়ে শুরু করে আমার একটা
কবিতা দিতে নবমী শেষ করছি -“মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায় ......
অ.না.ক.নবমী,১০ অক্টোবর,২০১৬
রবিবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৬
অষ্টমীতে মন খারাপ
অষ্টমীতে মন খারাপ
নৈমিত্তিক
মুখোশপরা জীবন । অনেক ব্যস্ত মানুষের বিচিত্র বর্ণিল ভিড়ে খুঁজে ফিরি বিষণ্ণ আড়াল
। এমন কাউকে খুঁজে পাইনা যার প্রসস্থ কাঁধে হাত রেখে আকাশ দেখা যায় । আমি আমার কথা
বলছি না, তাদের কথা বলছি উৎসবের জীবনে প্রবেশের সামর্থ্য যাদের নেই – জীবনের উৎসবে
যারা ব্রাত্য । আজ অষ্টমী – আনন্দ-মুখরতায় সবচেয়ে চড়া । বর্ষণমুখর দিন । কেউ
ব্যস্ত ঘরের ফুটো ছাদ মেরামত ক’রে মাথা বাঁচাতে, কেউ ব্যস্ত হাজার হাতের দুর্গা দেখার
কিংবা হোটেলে ডিনার সারার পরিকল্পনায় । কেউ বলছে ‘আকাশটা আজ বেশ সেজেছে’ কারও আবার
মাথায় হাত । কি অদ্ভুত বৈপরীত্য ! আমার কিন্তু হেলদোল নেই । খারাপ মন ভালো হবার
এতটুকু সম্ভাবনা নেই । আজ আবার খবরের কাগজও বন্ধ । মন খারাপের এও এক অন্যতম কারন হ’তে
পারে । আজ পূজো প্যান্ডেলের পাশে চেয়ারে বসা বাবলুকে দেখে ট্র্যাজিক উপন্যাসের
চরিত্র ব’লে মনে হ’ল । প্রেম আর চাকরীর পারীক্ষা পাশাপাশি চলেছিল বহুদিন ওর জীবনে
। শেষমেশ চাকরীর পরীক্ষা দেবার বয়স অতিক্রান্ত হ’ল । পরিণতি বুঝে প্রেমিকা
সু-চাকুরের স্ত্রী । অবিবাহিত বেকার বাবলু তাই পূজোর ক’টা দিন প্যান্ডেলে ঠাঁই ব’সে
থাকে প্রাক্তন প্রেমিকাকে দেখার জন্য । না, বাবলুর জন্য মন খারাপ লাগে না, ওরকম
বাবলু এদেশে প্রচুর আছে, খারাপ লাগে যখন
দেখি ওর প্রাক্তন প্রেমিকা একবারের জন্যও বাবলুর দিকে ফিরে তাকায় না । নাকি আমারই
ভুল, হয়ত সে আজও বাবলুকে ভালবাসে মনে মনে – আজও নির্জন একাকীত্বে বাবলুর কথা ভেবে
বালিশ ভেজায় চোখের জলে ! এই দ্বন্দ্বগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় – মন খারাপ হয় –
মন খারাপের সঠিক কারন খুঁজতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে যাই । আসলে আমি যে মন খারাপের
গাড়িতে চড়ে বসে আছি, তার কোন নির্দিষ্ট গতি নেই, স্থির গন্তব্য নেই, এ গাড়ির ভেঁপু
বাজে না । আমি দিন রাত মন খারাপের সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধ ক’রে চলেছি । এটুকু বুঝেছি, মন খারাপের
সঙ্গে সংঘাতের প্রাপ্তিটা কিন্তু বেশ আনন্দদায়ক । অষ্টমীর রাতে পরিবেশে যখন উৎসবের
ভরপুর আমেজ তখন আমি ঘরে ব’সে মন খারাপের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতে উঠে লিখে চলেছি – পরে এই লেখাগুলোই আমার মন ভালো ক’রে
দেবে, এই প্রাপ্তিটা কম কিসের । সে লেখা যতই নিম্ন মানের হোক নে কেন, সৃষ্টি তো
আমারই । আজ সকালে আমেরিকা প্রবাসী আমার এক বন্ধুর ফোন এসেছিল বিস্ময়কে ছাপিয়ে । ও
ছিল ধনী পরিবারের ছেলে । ক্লাসে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তেমন গাঢ় কিংবা আন্তরিক
ছিল না । বাবার অর্থের মহিমায় ও আমেরিকায় পাড়ি দিল ভালো চাকরী নিয়ে, বিদেশিনী বউ হ’ল
। ওর ফোন পেয়ে কেরানীগিরি করা মানসিকতায় কেমন যেন সঙ্কোচ জাগল । কুশল জিজ্ঞাসা করার পরই জানতে চাইল – তোদের ওখানে
পূজোর আনন্দ কেমন ? বললাম এখানে কোনদিনই পূজোর আনন্দে ঘাটতি নেই । জিজ্ঞাসা করলাম,
“ওখানে?” বলল, আজ মনটা খুব খারাপ লাগছে, ছোটবেলার দিনগুলোর কথা ভেবে, দেশের পূজোর
কথা ভেবে মন খারাপ লাগছে খুব । এখানে পূজো আছে, সেই আনন্দ নেই । আমি বললাম, এখানে
পুজোতে আনন্দ করে সবাই – এখানে পূজোতে বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য – মানে পূজোর ক’টা দিন সবাই
আনন্দে থাকে । এটুকু বলার পরেই আচমকা ফোনটা কেটে গেল । জানিনা, ওপার থেকে কেটে
দেওয়া হ’ল নাকি যান্ত্রিক ত্রুটি । নাকি উত্তর মনঃপুত হ‘ল না । কে জানে ! মনটা যে
আমারও খারাপ ও কি সেটা বুঝে ফেলেছে ?
অ.না.ক. অষ্টমী, ৯ অক্টোবর, ২০১৬
শনিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৬
সপ্তমীতে মন খারাপ
সপ্তমীতে মন খারাপ
সপ্তমী আজ । গতবছর যে
ছেলেটাকে যেখানে দেখেছিলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বুদবুদ তৈরির যন্ত্র বিক্রি করতে,
ঘটনাচক্রে তাকে আজও দেখলাম সপ্তমীর সন্ধ্যায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ফুঁ দিয়ে বুদবুদ
তৈরি করছে আর অজস্র বুদবুদ ঝাঁকে ঝাঁকে আনন্দ-উচ্ছ্বল মানুষের ভিড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে
একের পর এক । গত একবছরে নিশ্চিত তার মানসিক বিকাশ বিকাশ ঘটেছে কিন্তু সংসার
চালানোর জন্য আর্থিক বিকাশ বিন্দুমাত্র যে ঘটেনি তা বলাই বাহুল্য । কাছে ডেকে
জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিরে পড়াশুনা করছিস ? পুলকিত হলাম জেনে যে সে এবার এইটে পড়ছে ।
গত বছর ও কথা দিয়েছিল সে পড়াশুনা ছাড়বে না । ‘কি রে ঠাকুর দেখতে যাবি না ?’
প্রত্যুত্তরে ও জানালো অষ্টমীতে যাবে – কারন মা অষ্টমী, নবমী ও দশমীতে বাবুদের
বাড়িতে কাজে যাবে না । বাবার কথা জিজ্ঞেস করাতে বলল বাবা একই রকম শয্যাশায়ী, তবে
আগের চেয়ে ভালো । মনটা একটু ভালো হ’ল বটে তবে ছেলেটার ভবিষ্যৎ কল্পনা ক’রে কিছুটা
বিমর্ষ লাগল । পারবে তো ও পড়াশুনা চালিয়ে যেতে ? পুজোর আনন্দ উপভোগ করা না হ’লে
ক্ষতি নেই কিন্তু জীবনের আনন্দ উপলব্ধি করার জন্য পড়াশুনা ক’রে, মানুষ হয়ে
প্রতিষ্ঠা লাভের স্বপ্ন বুদবুদের মত একদিন মিলিয়ে যাবে না তো ? রাস্তায় হাজার
মানুষের ভিড় । পাশের পূজো প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসছে ‘আলোকের এই ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে
দাও ......’ আমার মনে তখন মন খারাপের নিকষ কালো অন্ধকার একটা ঘটনা দেখে । রেলওয়ে
প্লাটফর্ম দিয়ে হাঁটছি অষ্টমী পূজোর ফল কিনবো বলে । আমাদের পাড়ার ছেলেটাকে চোখে
পড়ল । ওকে সামনে দেখলে আমার ভীষণ কষ্ট হয় । আজও যে চোখে পড়ে যাবে ভাবিনি । ওর
প্যান্টের অনেকটাই ছেঁড়া । দীর্ঘদিন স্নান না করায় চুলে জট । গায়ে নোংরা । ছোটবেলায়
ওকে দেখতাম স্কুলে যেতে মায়ের সঙ্গে । সাউথ পয়েন্ট স্কুলে পড়ত । খুব ভাল ছাত্র ছিল
। ওর মা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা । হায়ার সেকেন্ডারীতে খুব ভাল ফল করেছিল । তারপর
মাঝে মাঝেই ওদের বাড়ি থেকে ভেসে আসত চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ । এটা প্রায়
নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল । একদিন শুনলাম ওর বাবা অন্য এক মহিলাকে বিয়ে ক'রে
চ’লে গেছে অন্যত্র । নিত্য ঝগড়ার মূল কারন ছিল এটিই । তারপরও বাড়ি থেকে যখন তখন,
এমনকি মাঝ রাতেও ওর মায়ের চিৎকার শুনতে পেতাম – ওর বাবার উদ্দেশ্যে যাচ্ছেতাই
ভাষায় গালাগাল করতে । কিছুদিন বাদে দেখলাম ওর মা বদ্ধ পাগল হয়ে গেছে । ছেলেটাও
ক্রমশ মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়ল । আজ ছেলেটাকে দেখার পর যতটা মন খারাপ হ’ল তার
পর আরও বেশি খারাপ লাগল যখন রাস্তায় ওর বাবাকে দেখলাম দ্বিতীয়বার বিয়ে করা বউটাকে
নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে । ওর বাবাকে দেখে রাগে শরীর জ্বলতে লাগল । বৈপরীত্যের এমন
নিষ্ঠুরতা দেখে মন ভালো থাকে ?
অ.না.ক. সপ্তমী, ৯
অক্টোবর, ২০১৬
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)
মুখ চাপা সত্য
মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু নাকি সত্যের চির সমাধি? নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?
-
এক লাইনের কাব্যঃ অ.না.ক. ২১/০৩/২০১৭ এক লাইনেও কাব্য হয় দু'লাইনে ছন্দময় ।