শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৪

সম্পর্ক ও আত্মীয়তা


পরিবারের সদস্য যেমন বাবা, মা, ঠাকুরদা, ঠাকুমা, কাকা, কাকিমা, ভাই, বোন এদের সঙ্গে আমাদের আত্মিক সম্পর্ক । বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী, প্রতিবেশী এদের সঙ্গে জন্মের পর থেকেই আমাদের প্রকৃতিগতভাবে পরিচয় এবং স্বভাবতই গড়ে ওঠে সম্পর্কের বন্ধন । এ সম্পর্কগুলো অত্যন্ত দৃঢ় । বাড়ির কোন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিতদের তালিকা প্রস্তুত করতে গিয়ে এদের নাম এমনিতেই চলে আসে তালিকার প্রথমে – কষ্ট করে মনে করতে হয় না । সহকর্মীদের নাম গুলোও সহজেই ঢুকে পড়ে এই তালিকায় । কিন্তু কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাদের নাম পরিচিতদের তালিকায় আনতে গিয়ে একটু কিংবা বেশ অনেকখানি ভাবতে হয় – অথচ এদের অনেকের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় । আসলে পরিচয়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সম্পর্কের বিভিন্নতা আমাদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্ব পায় । যেমন আমার বা আমার পরিবারের কারও অসুস্থতার সময় একজন ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আমাদের পরিচিতি ঘটে, রোগী সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটা সম্পর্ক বজায় থাকে । রোগী সুস্থ হওয়ার পর এই সাময়িক সম্পর্কের ক্রমশ অবলুপ্তি ঘটতে থাকে । এই সম্পর্ক স্থায়ী না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারন সম্ভবত চিকিৎসাই একজন ডাক্তারের পেশা বলে । অথচ গুরুতর অসুস্থ কোন ব্যক্তিকে যখন কোন অপরিচিত মানুষ নিঃস্বার্থে সুস্থ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তার সঙ্গে ওই ব্যক্তির বা তার পরিবারের যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা কিন্তু আলাদা মাত্রা পায় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা স্থায়ী হয়ে ওঠে । রাস্তা-ঘাটে, ট্রেনে-বাসে প্রতিদিন আমাদের কত নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই পরিচয় শুধুমাত্র পরিচয়ের গণ্ডিতেই আবদ্ধ থাকে – সম্পর্কের সীমানা স্পর্শ করে না । আবার এই প্রাত্যহিক পরিচয়ের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ কিছু কিছু বিশেষ কারনে পরিচয়ের গণ্ডী পেড়িয়ে সম্পর্কের জালে বন্দী হয়ে পড়ে । একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে । আপনি সপরিবারে রাজধানী এক্সপ্রেসে চলেছেন দিল্লীর উদ্দেশ্যে । আপনার সামনের আসনেই পেয়ে গেলেন এক বাঙালী পরিবারকে । দীর্ঘ ট্রেন যাত্রায় আশপাশে ভ্রাম্যমান ভিন্নভাষী অবাঙ্গালীদের ভিড়ে একজন স্বজাতি ও স্বভাষীকে দেখে স্বভাবতই আপনি মনে মনে উল্লসিত । তারপর চলতে লাগল আলাপচারিতা, গল্প-গুজব । হঠাৎ আপনার খেয়াল হ’ল আপনার মানিব্যাগ নেই । শেষ পর্যন্ত সেই বাঙালী ভদ্রলোক আপনাকে নির্দ্বিধায় টাকা দিয়ে সাহায্য করলেন এবং সে যাত্রায় আপনি একটি কঠিন বিপদ থেকে রক্ষা পেলেন সেই ভদ্রলোকের কল্যাণে । পরে যথা সময়ে আপনি সেই ভদ্রলোকের টাকা ফেরত দিলেন । তার পর থেকে আপনার কৃতজ্ঞতা আর সেই ভদ্রলোকের সাহায্য আপনাদের মধ্যে গড়ে তুলল সম্পর্কের সেতুবন্ধন । এ রকম অনেক ছোট ছোট ঘটনা থেকে পরিচিত কিংবা সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সঙ্গেই গড়ে উঠতে পারে সম্পর্ক । আবার আপনার অফিসের বসের সঙ্গে আপনার গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠার পেছনে এক বা একাধিক কারন থাকতে পারে । হয়ত আপনার কর্মদক্ষতায় তিনি মুগ্ধ, কিংবা কিছু অনৈতিক কাজকর্মে আপনি তার সহযোগী । অথবা বস সঙ্গীতানুরাগী হওয়ায় আপনার সঙ্গীতানুরাগ তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে পরস্পরের মধ্যে একটা সুসম্পর্কের বাতাবরণ তৈরি করেছে । কিন্তু দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গড়ে ওঠা এই সমস্ত সম্পর্কগুলো স্বার্থহীন নয় – কোন না কোনভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে স্বার্থপরতা, অনেক ক্ষেত্রে তা প্রত্যক্ষ আবার অনেকক্ষেত্রে আপাত নিঃস্বার্থ । ট্রেনের সেই সহযাত্রী ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের মূলে কিন্তু আপনার বিপদে তার সাহায্য, অর্থাৎ কৃতজ্ঞতা এই পারস্পরিক সম্পর্কের সেতুবন্ধন । আবার আপনার অফিসের বসের সঙ্গে আপনার যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা আপনার পেশাগত স্বার্থ । এই ধরনের সম্পর্কগুলোর বাঁধন অত্যন্ত পলকা – যে কোন সময় এই ধরনের সম্পর্কগুলো ছিন্ন হতে পারে । আত্মীয়তার সঙ্গে সম্পর্কের পার্থক্য এখানেই । আত্মীয়তা মানে পারস্পরিক আত্মিক সম্পর্ক – সেখানে স্বার্থের উপস্থিতি অনেকক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করলেও এই সম্পর্কের শিকড় থাকে অনেকটা গভীরে । ফলত এই আত্মীয়তার বন্ধন অনেকগুন বেশি দৃঢ় । তাই এই ধরনের সম্পর্কে ইতি টানা সহজ নয় । অনেকসময় এই আত্মিক সম্পর্কের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার দেওয়াল গড়ে ওঠে কিন্তু অন্তরের অন্তঃস্থলে এই আত্মীয়তার একটা স্থায়ী আসন পাতা থাকে । ভাই-এ ভাই-এ বিবাদ থাকে, শত্রুতা থাকে কিন্তু তা সত্ত্বেও আত্মীয়তার একটা অনুভুতি লুকিয়ে থাকে মনের গভীরে । সুতরাং সম্পর্ক ও আত্মীয়তা দুটি ভিন্ন জিনিস । আত্মীয়তা মানেই একটা সম্পর্ক, কিন্তু সম্পর্ক থাকলেই যে সেখানে আত্মীয়তা থাকবে তার কোন অর্থ নেই । বাবা, মা, ভাই, বোন, দাদু, ঠাকুমা, কাকা-কাকিমা এরা আত্মীয় কারন এদের সঙ্গে অনিবার্যভাবে গড়ে ওঠা সম্পর্কে কোন স্বার্থের প্রয়োজন থাকে না । কিন্তু বাইরের কারও সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কেউ আত্মীয় হতে পারবেন না এমন কোন কথা নেই । পরিচিত বা অপরিচিত কারো সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্কে যদি নিঃস্বার্থতা থাকে তবে তিনিও আত্মিক সম্পর্কের সুবাদে আত্মীয় হয়ে উঠতে পারেন, দুঃখের বিষয় আমাদের সমাজে আইনগতভাবে এদেরকে আত্মীয়ের পর্যায়ে ফেলা হয় না । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার সম্পর্ককে আত্মীয়তা বলা যায় কিনা তা বোধহয় সম্পর্কের চরিত্র বিচার না করে বলা কঠিন ।                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?