আবৃত্তিকার খুব
সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করলেন কিন্তু সূচনায় ‘আবৃত্তি’কে বললেন ‘আবৃতি’ । চট করে
মাথাটা গরম হয়ে গেল । ফলে সেই আবৃত্তিকারের আবৃত্তি শোনার প্রতি আগ্রহ রইল না ।
বই-এর মলাটেই যদি বড় বড় হরফে লেখা ভুল বানান চোখে পড়ে তাহলে ভেতরের দশা কল্পনা করে
সেই বই পড়ার ইচ্ছেটা স্তিমিত হওয়াটাই স্বাভাবিক – অন্তত মাতৃভাষার প্রতি
শ্রদ্ধাশীল একজন বাঙালীর মানসিকতায় এমনটিই ঘটা উচিৎ । বাসে, রেলে, ট্যাক্সির পেছনে, দোকানের পরিচিতি ফলকে, দেয়াল লিখনে ভুলের ছড়াছড়ি দেখা যায়। বাক্যগঠন, যতিচিহ্নের ব্যবহার, শব্দ চয়ন ইত্যাদি ভুল উপেক্ষা করলেও বাংলা বানানের লাগামছাড়া ভুলের বহর দেখলে ৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারির
ভাষা-আন্দোলনের শহীদদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করে । এমনকি সরকারী
বিজ্ঞাপনেও দৃষ্টিকটু বানান বিপর্যয় আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা ম্লান করে দেয় ।
পরীক্ষার খাতায় ছাত্র বানান ভুল করবে, একজন ছাত্র, একজন অশিক্ষিত বা
স্বল্প-শিক্ষিত মানুষ শব্দ ভুল উচ্চারণ করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক । আবার
অনেকক্ষেত্রে অজ্ঞতায় কিংবা অবচেতনে শিক্ষিত মানুষদেরও ভুল হয়ে থাকে । ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক, তাই হয়তো প্রবাদে আছে ‘মানুষ মাত্রই ভুল’। সব ভুল কিন্তু মেনে নেওয়া যায় না। ধরা যাক মুমূর্ষু রোগীর অস্ত্রোপচার চলছে। তখন যদি চিকিত্সক ভুল করে রোগীর পেটে ছুরি-কাঁচি রেখে সেলাই করে দেন। তখন এ ভুল কি মেনে নেওয়া যায়? তেমনি বাংলা বানানে ভুল হলেও মেনে নেওয়া কষ্টকর। কেননা বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ভাষা আন্দোলনের এক কঠিন
অধ্যায় অতিক্রম করতে হয়েছে, ঝরেছে অনেক শহীদের রক্ত । এখন বিশ্বময় বাংলা ভাষা অন্যান্য অনেক ভাষার সঙ্গে সমান গুরুত্বে সমমর্যাদায়
প্রতিষ্ঠিত, এমনকি একটি স্বাধীন দেশের জাতীয় ভাষা হিসাবেও স্বীকৃত । সুতরাং এখন যদি আমরা বাংলা বানান ভুল করি বা বাংলা শব্দের ভুল উচ্চারণ করি, সেটা হবে আমাদের মাতৃভাষাকে অবমাননা করার সামিল ।
অনেকেই ‘সম্মান’
শব্দটিকে ‘সন্মান’ উচ্চারন করতে অভ্যস্ত । টি ভি খুললেই বহু স্বনামধন্য ব্যক্তির
মুখে ‘সন্মান’ উচ্চারন করতে শুনবেন । উৎসাহ নিয়ে কারও বক্তব্য শুনতে গিয়ে যখনই
বক্তার মুখ থেকে ‘সন্মান’ উচ্চারন শুনি, বক্তার বক্তব্য যত সুন্দরই হোক তৎক্ষণাৎ
বক্তার প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মে যায় আমার ।
এই অভ্যেসটা (বন্ধুবান্ধবরা অনেকে ব’লে থাকে ‘বদভ্যেস’) আমার দীর্ঘদিনের । বক্তার
‘সন্মান’ উচ্চারনে তাঁর প্রতি আমার অসম্মান জন্মে যাওয়ার অভ্যেসটা শত চেষ্টাতেও
ত্যাগ করতে পারিনি । হাতে গোনা বিশিষ্ট
কয়েকজনকে দেখেছি প্রথম প্রথম ‘সন্মান’ বললেও পরবর্তীকালে শুধরে নিয়ে ‘সম্মান’
বলছেন । কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বক্তারা শব্দটির বানান তথা উচ্চারন নিয়ে মাথা
ঘামান না । তার চেয়েও বেশি আশ্চর্যের, কেউ বক্তাদের (বিশেষ ক’রে বিশিষ্টজন,
রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে) এই ভ্রম সংশোধনের চেষ্টাও করেন না । কোন লেখা পড়তে
গিয়ে যখনই ‘ব্যথা’ শব্দটি ‘ব্যাথা’ হয়ে যায় কিংবা ‘ব্যক্তি’ পরিনত হয় ‘ব্যাক্তি’তে
তখনই লেখাটা আর পড়তে ইচ্ছে করে না । এমনকি ছাপার ভুল হলেও না । খবরের কাগজে,
পত্রিকায়, টিভি চ্যানেলে (বিখ্যাত থেকে অথ্যাত সর্বত্র)যখন কোন বিজ্ঞাপনে বড় বড়
হরফে ‘ব্যাথা’ শব্দটি দেখা যায় তখন বিজ্ঞাপনদাতার ওপর নয়, রাগ হয় ওই খবরের কাগজ,
পত্রিকার বা টিভি চ্যানেলের কর্তৃপক্ষের বা সম্পাদকের ওপর । তাঁরই তো উচিৎ এই ভুল
সংশোধন করা । ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না’ বা ‘এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ’ এই
বক্ত্যব্যটি লিখতে গিয়ে অন্তত শতকরা পঁচানব্বই ভাগ দেওয়ালে ‘প্রস্রাব’ শব্দটিকে
লেখা হয় ‘প্রস্বাব’ বা এই জাতীয় কোন ভুল শব্দ । সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটগুলোতে অনেকক্ষেত্রেই
চোখে পড়ে নিয়মনীতির ধার না ধারা বাংলা লেখা । এগুলো আসলে সুন্দর প্রাচীরের গায়ে
ঘুঁটে দেওয়ার মত । যত্র-তত্র দৃশ্যমান ভুল বানান মুলতঃ ভাষা সচেতন মানুষের পক্ষে এক
ধরনের দৃশ্যদূষণ। আর ভুল উচ্চারণে কথা বলা বা বক্তৃতা করা, অশালীন ভাষা প্রয়োগ করা এক ধরনের মারাত্মক
ক্ষতিকর শব্দ দূষণ যা নব্য প্রজন্মের ভবিষ্যৎ এবং বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎকে বিপথে
চালনা করতে বাধ্য । ইদানিং ‘ভাষা-সন্ত্রাস’ শব্দটির বহুল প্রচলন শুরু হয়েছে যা
নাকি প্রতিপক্ষকে আক্রমনের জন্য পেশ করা উগ্র, অশালীন বক্তব্য । বাংলা ভাষাতেও যদি
এই উগ্র পন্থার অনুপ্রবেশ ঘটে তবে বাঙ্গালীর মাতৃভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট
উদ্বেগের কারন আছে । বাংলা ভাষার মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করার জন্য অনতিবিলম্বে আমাদের
সকলেরই এগিয়ে আসা উচিৎ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন