বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৩

পুজোয় মন খারাপ ; অমরনাথ কর্মকার , পঞ্চমী, ০৯/১০/২০১৩

পুজোয় মন খারাপ ; অমরনাথ কর্মকার , পঞ্চমী, ০৯/১০/২০১৩ বয়স বড়জোর ১১-১২ । কয়েকমাস আগেও দেখতাম লক্ষ্মীকান্তপুর লাইনে ট্রেনের কামরায় ওর থেকেও বেশি ওজনের ব্যাগ কাঁধে করে ফটাস জল বিক্রি করতে । ট্রেনের নিত্যযাত্রী হিসাবে লক্ষ্য করতাম ওর পাকা বিক্রেতার মত কথার ফুলঝুরি আর উৎসাহী ক্রেতাদের ওকে নিয়ে নানান হাসি ঠাট্টা । হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবে ট্রেনের কামরায় এসব দেখেও চুপ করে থাকতাম । বড্ড মায়া হত ছেলেটাকে দেখে । এর আগে ওর বয়সের ছেলেকে দেখেছি পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়তে । কাঁধে বই ভরতি ব্যাগ না ঝুলিয়ে সামান্য পয়সা উপার্জনের তাগিদে পিঠে ফটাস জলের ভারী ব্যাগ ঝুলিয়ে ট্রেনের কামরায় কামরায় ঘুরে বেড়ানো এই ছেলেটাকে দেখে মনের অনুভূতি হ’ত সম্পূর্ণ অন্য রকম । একদিন প্লাটফর্মে ওকে একা পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম – কিরে স্কুলে যাস না ? সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে খুব নিচু গলায় উত্তর দিল – না, বাড়িতে মা’র অসুখ – বাবা নেই – তাই ফটাস জোল বিক্রি করি । মা বলেছে মা’র শরীর ভাল হলে আবার আমি ইস্কুলে যাব । তারপর মাথা তুলল যখন তখন দেখলাম ওর হাসি মাখা মুখে তখনও জেগে আছে এক রাশ স্বপ্ন । শুনলাম, মনটা খারাপ হ’ল এবং প্রাত্যহিক নানান অভিজ্ঞতার মত এটিও স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেল । তারপর বেশ কয়েকটা মাস ওর দেখা পায়নি । ওর দীর্ঘ অনুপস্থিতি মনে বেশ আশার উদ্রেক করেছিল । ভেবেছিলাম এতদিনে নিশ্চয়ই ওর মায়ের শরীর ঠিক হয়ে গেছে আর ছেলেটাও আবার স্কুলে যাচ্ছে । আসলে অবসর সময়ে গতানুগতিকতার বাইরের কিছু ঘটনা মনের জানালায় উঁকি দিয়ে যায় মাঝে মাঝে । তারপর কর্মব্যস্ততায় কখন বেমালুম হারিয়ে গেছে মন থেকে ! আজ পঞ্চমী । অফিসের প্রবল কাজের চাপ সামলে এবং আগামী কাল ষষ্ঠীর দিনেও অফিসে হাজিরা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যখন বাড়ি ফিরছি, পাড়ার আলোকময় পুজো প্যান্ডেলের একপাশে দেখলাম একটা বাচ্চা ছেলে মুখে ফুঁ দিয়ে বুদবুদ তৈরি করছে আর বুদবুদ তৈরির যন্ত্র বিক্রি করছে । ছেলেটাকে কেমন যেন চেনা মনে হ’ল । কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম সেই ছেলেটা – যাকে ট্রেনের কামরায় দেখেছি ফটাসজল বিক্রি করতে । নতুন পোষাকে সেজে পুজোর আনন্দে আপ্লুত হয়ে ওর সামনে দিয়ে তখন কত ছেলে মেয়ের দল বাবা-মায়ের হাত ধরে ঠাকুর দেখতে চলেছে । ওর পরনে ছেঁড়া হাফ-প্যান্ট আর পুরনো একটা জামা । কাছে যেতেই বুঝলাম চিনতে পেরেছে আমাকে । মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলাম – কিরে মায়ের শরীর ভাল হয়নি ? দেখলাম ওর চোখে জল । বলল, মা মারা গেছে – এখন মসির বাড়ি থাকি । হাতে দুটো একশো টাকার নোট দিয়ে বললাম – পুজোর পর আমার বাড়িতে আসবি । মাথা নাড়ল ও । ইচ্ছে আছে ওকে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করার । মনটা এবার আবার খারাপ হ’ল । পুরো পুজো জুড়ে মনে বাজবে মন খারাপের সুর । আবার মনকে প্রবোধ দেওয়ারও চেষ্টা করছি – ছেলেটা যে বুদবুদ তৈরি করছিল, বোধহয় ওর জন্য ওটাই আদর্শ । কারন ওদের স্বপ্নগুলো তো বুদবুদের মতোই ফেটে যায় ! আর শিশুশ্রম ? আইনের পাতায় তার উপাস্থিতি কাগুজে বাঘের মত আপাত ভয়ঙ্কর হলেও বাস্তবে তার উপস্থিতি ভিজে বেড়ালের মতো ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?