বৃহস্পতিবার, ২৬ মার্চ, ২০২০

সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে

'সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে' : অ.না.ক. ২৭/০৩/২০২০

মারন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বময় যখন মৃত্যু-মিছিল, তখন আমাদের দেশকে সেই মহামারী থেকে বাঁচাতে আগামী বেশ কয়েক দিন সকলকে গৃহবন্দী থাকতে এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে সরকারী নির্দেশনামা জারি হয়েছে। কিন্তু সময়ে মানুষ অনেকেই সত্য উপলব্ধি করতে পারছেন না হয়ত।। আবার যারা পারছেন তারা সত্যকে সত্য বলে প্রকাশ করার পরিবেশ পাচ্ছেন না অনেকক্ষেত্রেই।  আমরা উপলব্ধি করি, জীবনের ছায়ায় কখনো প্রকৃতি, আবার  কখনো প্রকৃতির ছায়ায় জীবন। মূলত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই অভাবনীয় উন্নতির যুগেও এই মুহূর্তে প্রকৃতির ছায়ায় জীবন।জানিনা, জীবনের ছায়ায় প্রকৃতি যখন থাকে তখন কেন এই প্রকৃতিকেই আমরা কলুষিত করতে দ্বিধা করি না। আর আজ যখন প্রকৃতি চোখ রাঙাচ্ছে, তখন আমাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ।  এই দুঃসময়ে গৃহবন্দী থাকার প্রয়োজনীয়তা যে কি ভীষনভাবে জরুরী এই সত্যোপলব্ধি অনেকের মধ্যেই অনুপস্থিত। অনেকেই এসবের তোয়াক্কা না ক'রে অকারনে রাস্তায়  বেরোচ্ছেন। এরা একগুঁয়ে। যারা প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন তাঁদের অনেকেই প্রথম পক্ষের কারনে সত্য প্রকাশে পিছপা হচ্ছেন। সুতরাং এভাবে চললে পরিস্থিতি যে কোন দিকে গড়াবে তা ভেবে যথেষ্ট শঙ্কিত হতে শুরু করেছি। 
প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও জীবনান্দ দাশের '১৯৪৬-৪৭' কবিতার লাইনগুলো প্রাসঙ্গিকতা বয়ে নিয়ে আসছে। তখন একদিকে ব্রিটিশ শোষণের কড়াল অভিঘাতে বিপর্যস্ত বাঙালি-জীবন, অন্যদিকে বিশ্বরাজনীতির প্রতিহিংসায় দ্বিতীয় মহাসমরে ভেঙে যাওয়া অর্থনীতিতে মানুষের ওপর মানুষ যখন আস্থা হারিয়েছে তখন অযুত যন্ত্রণা-কষ্ট সত্ত্বেও বাঙালিরা মুক্তির স্বপ্ন দেখছিল। এক্ষেত্রেও একদিকে করোনা ভাইরাসের ভয়ঙ্কর সংক্রমণে বিপর্যস্ত জীবনযাত্রা, অন্যদিকে প্রবল অর্থনৈতিক মন্দা আর তারই মধ্যে আমরা মহামারীর ছোবল থেকে আগাম মুক্তি পাবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আবার মারণ সংক্রমণের আতঙ্কে পরস্পর পরস্পরের প্রতি সন্দিহান - সকলেই সকলকে আড়চোখে দেখতে শুরু করেছি। এ রোগের সংক্রমণ ঘটলে তার প্রতিষেধক নেই - এ যেন জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা।  কবির ভাষায় -

'আজকে অস্পষ্ট সব? ভালো করে কথা ভাবা এখন কঠিন;

অন্ধকারে অর্ধসত্য সকলকে জানিয়ে দেবার

নিয়ম এখন আছে; তারপর একা অন্ধকারে

বাকি সত্য আঁচ করে রেওয়াজ

রয়ে গেছে; সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে।'

এ রোগ ধর্ম মানে না, জাত মানে না, এর কাছে আকবর বাদশা আর হরিপদ কেরাণীর মধ্যে কোন  ভেদ নেই।  ধর্ম,জাত,অর্থ এ সবের চেয়ে এখন জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তাই নৈরাশ্য আর নেতিবোধকে প্রাধান্য না দিয়ে  জীবন রক্ষার চেষ্টা করাটাই আজ একমাত্র সংগ্রাম আমাদের।

বুধবার, ২৫ মার্চ, ২০২০

বই পড়ার উপকারিতা

        বই পড়ার উপকারিতাঃ অমরনাথ কর্মকার ২৫/০৩/২০২০
ছোটবেলায় বাবা-মার কাছে অনেক বকা শুনেছি বই না পড়ার কারনে। কোন বই ? ভুল ভেবে থাকতে পারেন হয়ত। বকা খেয়েছি স্কুলের পাঠ্য বই না পড়ার কারনে আদৌ নয়। স্কুলের পাঠ্য বই পড়া তো দৈনিক খাবার খাওয়ার মত। ওটা তো নিয়মমাফিক পড়তেই হ'ত। অবশ্য আমার বাবা-মা অতিরিক্ত খাওয়াতে পছন্দ করতেন না। বাবা বলতেন ক্ষিদে পেলে এমনিতেই খাবে। এখন অবশ্য বেশিরভাগ অভিভাবককে দেখি সন্তানের ভরা পেটেও জোর ক'রে গেলাতে। জানিনা, হয়ত বা জলবায়ুর পরিবর্তনের ফল। সে যা হোক, বকা খেয়েছি স্কুলের পাঠ্যের বাইরে বই না পড়ার কারনে। তার কারনও একটা ছিল। বাবা আমাদের স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরির সভ্য ছিলেন। বাড়িতে অনেক বিখ্যাত লেখকের বই আনতেন। নিজে পড়ার পর সাথে সাথে ফেরত না দিয়ে অতিরিক্ত কয়েকটা দিন বাড়িতে রেখে আমাকে পড়তে বলতেন। আমি বই পড়ছি কি না সে রিপোর্ট দেওয়ার দায়িত্ব ছিল মায়ের ওপর। আমি নিরুপায় হয়ে বই পড়ার নাম ক'রে অহেতুক পাতা উল্টে পড়ার ভান করতাম মাকে দেখানোর জন্য। বলা দরকার, আমার বাবা স্বল্পশিক্ষিত ছিলেন কিন্তু বই পড়ার অসম্ভব নেশা ছিল। মা ছিলেন অতি স্বল্পশিক্ষিতা কিন্তু আমার পড়ার নজরদারিতে শিক্ষকদেরও হার মানাতে পারতেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বই হাতে বসার অভ্যেস ক্রমশ বই-এর প্রতি আকর্ষণের জন্ম দিল। আস্তে আস্তে বিভিন্ন ধরনের বই, পত্র-পত্রিকা পড়ার প্রতি আগ্রহ এমনভাবে জন্মালো যে আজ আমার আয়ের একটা অংশ শুধু বই আর পত্র-পত্রিকা কিনতে ব্যয় হয়ে যায়। চাকরি পাবার আগে যখন কেবল টিউশানি করতাম তখন থেকেই আমার খরচে বাড়িতে নিয়মিত পত্র-পত্রিকা নিতাম। আর বই-এর একটা ছোটখাটো লাইব্রেরিই বানিয়ে ফেলেছিলাম। না, আমরা ধনী ছিলাম না, ছিলাম নিম্ন মধ্যবিত্ত। সেই অভ্যেস রক্তে মিশে গেছে ব'লে অবসর পেলেই বই পড়ি, আনন্দ পাই। বাবা আমার কেনা বই আর পত্র-পত্রিকায় মশগুল হয়ে থাকতেন অবসর সময়ে। মারা যাবার আগেও বাবাকে দেখেছি দুপুরে না ঘুমিয়ে বই পড়তে। দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে লক ডাউন - ভয়ঙ্কর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে। চলবে আরোও অন্তত ১৪ দিন। রাত দুটো নাগাদ বাড়ির বাইরের উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখলাম অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। মনে হ'ল পৃথিবী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অথচ অন্য সময় হ'লে রাত দুটোতেও পাড়া জেগে থাকে। কখনোও মাইকে গান ভেসে আসে, কখনোও পাশের বাড়ির জানলা দিয়ে ভেসে আসে শিশুর কান্না কিংবা স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার আওয়াজ। এই ভাবে দীর্ঘ দিন অলস ঘর বন্দী হয়ে থাকাটা কি সবার পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে? বিশেষ ক'রে যারা সারাদিন কাটান কর্মব্যস্ততায়? যাঁরা নাচ-গান বা অন্যান্য শৈল্পিক কাজে করেন তাঁদের সময় কাটবে শিল্প চর্চায়।কিন্তু যাঁরা এসবের মধ্যে নেই তাঁদের কি হবে? মোবাইল ঘেঁটে কতদিন চলবে? টিভিতেও চলছে সিরিয়ালের পুরোনো এপিসোডের পুনঃপ্রচার।সুতরাং এতদিন কাজের চাপ সামলে ছুটির উপভোগ্যতা যেভাবে অনুভব করেছি আজ থেকে তার বিপরীত। এখন ছুটির চাপ সামলানোই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমার বা আমার মত যাদের বই পড়ার নেশা আছে তাদের ক্ষেত্রে বোধ হয় এই দীর্ঘ সময় অলস সময় কাটানো কঠিন হবে না। 'বই পড়ে কি হবে' এই প্রশ্নের সম্মুখীন বহুবার হয়েছি। আমি ভালো চাকরি করি না, আর্থিক ভাবেও স্বচ্ছল নই, সামাজিক পরিচিতিও আমার নেই। তাই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে চলেছি কারন প্রশ্নকর্তার চাহিদামত উত্তর দেওয়ার যোগ্যতায় আমি ডাঁহা ফেল। আর যে উত্তর আমি দিতে পারি তাতে হাসির খোরাক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। তাই বই পড়ি নিভৃতে, ভালোবেসে মানসিক প্রশান্তির ছায়ায় বসে। তবে আজ সেই সমস্ত প্রশ্নকর্তাদের 'বই পড়ার উপকারিতা'র উত্তর নির্দ্বিধায় দিতে পারি। উত্তরটি হ'ল - বই পড়া সময় কাটানোর সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। এক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তা একশ তে একশ দিতে দ্বিমত করবেন না নিশ্চয়। যেহেতু আগামী বেশ কয়েকদিন আমাদের বন্দিদশা চলবে।

রবিবার, ২২ মার্চ, ২০২০

করোনা ত্রাস ও আমরা

করোনা ত্রাস ও আমরাঃ অ.না.ক. ২৩/০৩/২০২০

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বজুড়ে যে ত্রাস সৃষ্টি হয়েছে তাতে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন। চীনের পর এবার এই মারন ভাইরাসের তাণ্ডবে ইতালিতে চলছে মৃত্যু-মিছিল। এই লেখা যখন শুরু করেছি তখন ইটালিতে  মৃতের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। ভারতে ইতিমধ্যেই সংক্রমন শুরু হয়েছে। মৃত্যুও হয়েছে বেশ কয়েকজনের। এই সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার যখন ব্যবস্থা নিচ্ছে তখন আমাদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যে রাজনৈতিক তরজা শুরু ক'রে দিয়েছি। কেউ গোমুত্র সেবনে এর প্রতিকার খুঁজছে, কেউ হোমিওপ্যাথিতে। কেউ থানকুনি পাতা খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, কেউ ভরসা করছেন ঈশ্বরের ওপর। বাংলাদেশের একজন তো ইতিমধ্যে স্বপ্নে পেয়ে গেছেন করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক। অথচ এই রোগের প্রতিষেধক এখনও অনাবিষ্কৃত বলেই কিন্তু বিশ্বজুড়ে এই আতঙ্ক, এত কর্মকান্ড। আর একদল মজা দেখতে ব্যস্ত। সামাজিক মাধ্যমে তারা মশকরা ক'রে চলেছে, গুজব ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি ক'রে দেঁতো হাসি হাসছে। জানিনা হয়ত এটাই তাদের নিরুদ্বেগ থাকার কৌশল। 'জনতা কার্ফু'র জন্য আজ সারাদিন বাড়ি ব'সে সময় কাটছে। তাই লিখতে ইচ্ছে হ'ল। লিখতে বসার আর একটি কারন হ'ল আজ সারাদিন যখন 'এই বিজ্ঞানের যুগেও আমরা কেন এতটা অসহায় বোধ করছি' এই ব্যাপারটা ভেবে কুল পাচ্ছি না তখন মনে প'ড়ে গেল অনেক বছর আগে পড়া বনফুল (বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়)-এর লেখা 'মানুষের মন' গল্পটার কথা। মানুষের চরম দুঃসময়ে মানূষ কিভাবে তাঁর নীতি,আদর্শ থেকে বিচ্যুত হ'তে পারে তারই বর্ণনা রয়েছে গল্পে। নরেশ ও পরেশ দুই সহোদর। দু'জনেই অকৃতদার। প্রথম জন রসায়নে এম.এস.সি., দ্বিতীয় জন সংস্কৃতে এম.এ., দুজনেই কলেজের অধ্যাপক। নরেশ জ্ঞানমার্গে বিশ্বাসী, 'থিওরি অফ রিলেটিভিটি' নিয়ে তাঁর সর্বক্ষণের চর্চা। পরেশের বিচরণ ভক্তিমার্গে।  ছোট ভাই মারা যাবার পর তার একমাত্র ছেলে পল্টুর দেখাশোনার সমস্ত ভার নরেশ ও পরেশই নিয়েছিলেন। দু'জনের কাছেই পল্টু ছিল অতি আদরের। একবার পল্টুর অসুখ করল। নরেশ যখন ডাক্তার ডাকার প্রস্তাব দিচ্ছেন, পরেশ তা না মেনে কবিরাজ ডাকতে চাইছেন। ডাক্তারের পরামর্শে নরেশ যখন ইঞ্জেকশান দেওয়ার তোরজোড় করছেন পরেশ তখন জ্যোতিষির পরামর্শ নিতে ব্যস্ত। এদিকে অসুখ ক্রমশ বাড়ছে। নরেশ তখনও পরেশকে ডাক্তারের ইঞ্জেকশনে রাজী করানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। ওদিকে নরেশের ঘোরতর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও পরেশ ঠাকুরের চরণামৃত খাইয়ে পল্টুকে সুস্থ ক'রে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। একসময় পল্টু প্রায় মরনাপন্ন। তখন দেখা গেল পল্টুকে বাঁচিয়ে তোলার তাগিদে নরেশ ও পরেশ তাঁদের সব নীতি, বিশ্বাস বিসর্জন দিলেন। দেখা গেল নরেশ নিজ হাতে পল্টুর মুখে চরণামৃত তুলে দিচ্ছেন আর ওদিকে পরেশ ডাক্তারবাবুকে ফোন করছেন পল্টুকে ইঞ্জেকশান দেওয়ার জন্য।
গল্পটা যাঁদের পড়া আছে তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন এই গল্পের অবতারনা করার উদ্দেশ্য।
করোনা ভাইরাস যখন মহামারীর আকার ধারণ করেছে তখন চিকিতসা শাস্ত্রে অনাবিষ্কৃত থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ এই রোগের প্রতিষেধক বাতলে দিচ্ছেন অনায়াসে। আসলে এগুলো আমাদের অসহায়ত্বের প্রকাশ। তবে এটাও ঠিক একশ্রেণির মানুষ এতে অনেকটা আশ্বস্তও হন। আবার গোমুত্র পানে অসুস্থও হয়ে পড়েন। আমার বক্তব্য, এখনোও সেই অসহায়ত্ব বোধ করার মত পরিস্থিতি বোধ হয় আসেনি। সুতরাং সচেতন থেকে এই রোগ এবং তার সংক্রমণ প্রতিহত করতে হবে আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে। এখনোও বিজ্ঞান ধর্মের দ্বারস্থ হয়নি কিংবা ধর্ম বিজ্ঞানের।

রবিবার, ৮ মার্চ, ২০২০

অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চায় ?

রবীন্দ্রভারতি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাকে কেন্দ্র ক'রে আমার কবিতা

অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চায় ?
অমরনাথ কর্মকার ০৮/০৩/২০২০


একদল অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চায়
সেই তীব্র রোদ, যার তাপের জ্বালায় 
শেষমেশ সেই দহনে সে হয় আত্মঘাতী
আর চার পাশ পুড়ে খাক হয় রাতারাতি।
মাথার ওপর মুচকি হেসে বলেন রবি কর
‘আমার রোদে প্রাণদায়ী তাপ, আলো মনোহর,
যে রোদে তুই মরলি পুড়ে সে তোর অপমান
আমার রোদে বেঁচে থাকে হাজার কোটি প্রাণ ‘।

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

পোলবা পুলকার দুর্ঘটনায় নিহত ছোট্ট ঋষভের উদ্দেশে



পুলকার দুর্ঘটনায় ছোট্ট ঋষভের মর্মান্তিক মৃত্যুর শোকস্তব্ধতায় ঋষভের পরিবার-পরিজনদের উদ্দেশে আমার এই ছোট্ট কবিতা

হারায়নি যাঃ অ. না.ক. ২২/০২/২০২০

আমরা বেঁচে আছি আশায়-ভালোবাসায়,
তাই হারানোর যন্ত্রণা বেশি টের পাই।
হৃদয়ে হৃদয় জুড়ে থাকার সুখ জানা,
তাই হৃদয় ভাঙলে অশ্রু মানে না মানা।
চেতনা, পার্থিব যন্ত্রণার ঊর্ধে নিশ্চয়,
একদিন মিলবে হারানো খন্ড হৃদয়।
সেদিন দুচোখে থাকবে আনন্দের ধারা,
হারায়নি যা তার খোঁজে কেন দিশেহারা?

বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

বাংলা ভাষার বিশ্বজয়


বাংলা ভাষায় বিশ্বজয়
অমরনাথ কর্মকার

মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে বাঙালী জনগোষ্ঠীর আন্দোলনের সূত্রপাত বেশ প্রাচীন। মানভূমের বাঙালীরা ১৯১২ সালে উপমহাদেশে প্রথম বাংলা ভাষা আন্দোলন শুরু করেন। সেই অনুপ্রেরণা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে আসাম থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে। তারপর সেই ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে উত্তাল তরঙ্গের আকার ধারণ করল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকার রাজপথে সালাম, জব্বার, বরকতের রক্তের বিনিময়ে বাঙালীর মাতৃভাষা কিভাবে সজীবতা পেল সে ইতিহাস তো সকলেরই জানা। ‘অমর একুশে’ বিশ্ববন্দিত হয়ে বাংলাদেশ বাংলা ভাষাকে সরকারী ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে বাঙালীর ভাষার স্বাধীনতার পতাকা সগর্বে প্রতিষ্ঠা করল। আজ যখন প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারী দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবস’ হিসাবে বিশ্বময় পালিত হয়, তখন বাঙালী হিসাবে আমাদের বুক গর্বে ভ’রে ওঠে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একটা প্রশ্ন বারংবার উঠে আসে – আমরা বাঙালীরা কি অন্তরের গভীর ভালোবাসা দিয়ে বাংলা ভাষাকে আঁকড়ে ধ’রে রাখতে  পারছি ?
বিশ্বে যেখানেই যান বাঙালীর পরিচিতি প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান মাধ্যম তাঁর মুখোচ্চারিত বাংলা ভাষা। শতাব্দী প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য ভারতীয় তথা বিশ্ব সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। দু-দুটো দেশের জাতীয় সঙ্গীতের ভাষা বাংলা। ভাষার জন্য বাঙালীর বিরল আত্মত্যাগ বিশ্বে বেনজির। অথচ বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক প্রবণতা বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে এক বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে।
ইংরেজি ‘Z’ এর প্রতিবর্ণ বাংলা ভাষায় অনুপস্থিত ব’লে সম্প্রতি ‘জ্৳’ দিয়ে ‘Z’ এর পরিপূরক বাংলা বর্ণ তৈরি হয়েছে। কই ইংরেজি বর্ণমালাতেও ‘ত’-এর প্রতিবর্ণ নেই। কখনোও কি ‘ত’-এর প্রতিবর্ণ সৃষ্টির জন্য ইংরেজদের কখনোও তৎপর হ’তে দেখেছেন ? অনুকরণপ্রিয় হিসাবে এমনিতেই বাঙালীর বদনাম আছে। ভাঙা বাংলায় উচ্চারণ, হিন্দি ইংরেজি মিশিয়ে বাংলা ভাষাকে একটি শংকর ভাষা বানিয়ে মাতৃভাষার মৌলিক্বত্ব বিনাশের কেমন যেন একটা মরিয়া প্রবণতা একশ্রেণির বাঙালীর মধ্যে ইদানিং খুব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বরং বাস্তবটা যদি বিপরীত হ’ত তাহলে বাংলা ভাষার অস্তিত্বের সংকট নিয়ে শঙ্কা হ’ত না। আমরা আগ বাড়িয়ে হিন্দিভাষীর সঙ্গে হিন্দি, ইংরেজিভাষীর সঙ্গে ইংরেজি বলার চেষ্টা করি – তাঁদেরকে কখনোই বাংলা বলানোর উদ্যোগ গ্রহণ করি না। উচ্চশিক্ষার জন্য ইংরেজি বই ছাড়া গত্যন্তর নেই এই বিশ্বাসে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলা ভাষায় বই লেখার চেষ্টা হয় না। অথচ দেখুন জাপানী-ফরাসিরা উচ্চশিক্ষার জন্য এই আক্ষেপ করে না। এমনকি বাংলাদেশেও সেই চেষ্টা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বলতে বাধা নেই বঙ্কিম-বিভুতিভূষনরা ক্রমশ অপাংক্তেয় হতে শুরু করেছে।
খুব সহজ ক’রে বললে বলতে হয় বাংলা ভাষার ওপর হিন্দি আর ইংরেজি ভাষার সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে যেন। না, এই সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য হিন্দি বা ইংরেজি ভাষাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বরং আমরা নিজেরাই বোধ হয় আমাদের মাতৃভাষার ওপর এই ভাষাসন্ত্রাস জারী করার ব্যাপারে আত্মঘাতি – আমাদের অপরিনামদর্শী অনুকরণপ্রিয়তার কারনেই বাংলা ভাষা ক্রমশ তাঁর স্বকীয়তা হারাচ্ছে। একদা ইংরেজ ঔপনিবেশিকতা প্রশাসনিক কাজে ইংরেজির ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করেছিল। যদিও সর্বত্র তা সার্থকতা পায়নি। স্বাধীন ভারতে প্রশাসনিক কাজে প্রাদেশিক ভাষা ব্যবহারের প্রচলন শুরু হলে বঙ্গের বাঙালীরা প্রশাসনিক কাজে বাংলা ব্যবহারের স্বাধীনতা পেয়েছে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের সরকারী ভাষা এখন বাংলা। সরকারী কাজে বাংলা ব্যবহারে কোন বাধা নেই অথচ আমাদের মধ্যে সার্বিকভাবে বাংলার চেয়ে ইংরেজি ব্যবহারের প্রবনতা রয়েই গেছে। বাংলায় অনেক ইংরেজি শব্দের প্রতিশব্দের অভাবকে দোষ দিতেও আমরা অভ্যস্ত। এখন ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ আদৌ অপ্রতুল নয়। আসলে আমাদের চেষ্টা নেই – সগর্বে বাঙালীত্ব প্রকাশের তীক্ষ্ণ হাতিয়ার হিসাবে বাংলা ব্যবহারের মানসিকতা এখনোও সেভাবে তৈরি হয়নি। ধরেই নেওয়া হয় বাংলা ভাষার প্রয়োজন সীমাবদ্ধ শুধু সাহিত্যের – শরীরটা যতই বাঙালীর হোক। বাংলা ভাষায় হিন্দি আর ইংরেজির অনুপ্রবেশ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির গুপ্তঘাতক হিসাবে নীরবে কাজ ক’রে চলেছে আমাদের অজান্তেই। এর পরিণাম যে কি সাঙ্ঘাতিক হতে পারে তা ভাবা যায় না।
আমার এক অধ্যাপক বন্ধু সেদিন আক্ষেপ ক’রে বলেছিলেন ‘বিশ্বায়ন বিশ্বায়ন নিয়ে আমরা হই চই করি অথচ বাঙালী হিসাবে আমরা বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন নিয়ে এতটুকুও ভাবি না’। বাঙালী হিসাবে আমরা বহু কৃতি বাঙালীর দৌলতে বিশ্ববন্দিত, সন্দেহ নেই। কিন্তু বাঙালীর ভাষাকে বিশ্ববন্দিত করতে পারলেই বোধ হয় ষোল কলা পূর্ণ হয়।
ইউনেস্কোর মতে ১০০০০-এর কম মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষা বিলুপ্ত হবার সম্ভাবনা বেশি। জানা গেছে গত ৬০ বছরে ভারতের প্রায় ২৫০টি ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে এবং ৭৮০টির মধ্যে ৬০০টির বিলুপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে। কে জানে বিলুপ্তির তালিকায় এই বাংলা ভাষাও স্থান পাবে কি না !  খোদ কোলকাতায় বাঙালীর ঐতিহ্যের কফি হাউসে বাঙ্গলায় কথা বললে মেলে অপমান, বাংলায় ব্যবসা করা কোম্পানীর কর্মচারিরা বাংলায় কথা বললে তাঁদের চাকরি যায়। সেই ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় জন্মানোটাই স্বাভাবিক। হিন্দি-ইংরেজী মেশানো জগাখিচুরি বাংলাতে যখন নবীন প্রজন্ম ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে তখন মনে হতেই পারে এ বুঝি বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি – বাংলাকে জাতীয় বা আন্তর্জাতিকীকরনের পন্থা । এও মনে হ’তে পারে, প্রতি বছর হাজার হাজার বাংলা বই প্রকাশিত হচ্ছে, অতএব, এই ভাষার মৃত্যু ঘটা অসম্ভব। মৃত্যু হয়ত ঘটছে না, কিন্তু তা যে ক্রমশ অ্যানিমিয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষা যেহেতু ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পথ বেয়ে আসেনি, তাই এই ভাষা রক্ষা এবং একে গৌরবান্বিত করার তাৎপর্য বিশেষ ক’রে নবীন প্রজন্মের কাছে অতটা গুরুত্ত্ব পায় না। তাই পরিবেশ রক্ষার জন্য প্লাস্টিক বর্জন নিয়ে আমরা যতটা সোচ্চার হই, বাংলা ভাষায় অহেতুক হিন্দি-ইংরেজীর মিশ্রন বর্জনে আমরা ততটা সরব হই না।
রেডিও টিভির প্যানেল ডিসকাশনে বাংলা ভাষা নিয়ে যতই গরমা-গরম আলোচনা হোক, ‘মাতৃ ভাষা মাতৃদুগ্ধসম’ এই প্রবচনের জ্ঞানগম্ভীর প্রবন্ধে পত্র-পত্রিকার পাতা যতই সেজে উঠুক, তা কিন্তু ওখানেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেই দুগ্ধের অভাব মেটানোর কার্যকরী ভূমিকার অভাবে কি ভাবে বাংলা ভাষাকে আমরা রক্তাল্পতার রোগী ক’রে তুলছি সেই অনুভব আমাদের চেতনায় আদৌ আঘাত হানছে না। যাঁদের এ নিয়ে রাস্তায় নামা জরুরী তাঁরা রাজনৈতিক মিছিলে হাঁটছেন ।
তাহ’লে কি এভাবেই ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকবে বাংলা ? একে উজ্জীবিত, প্রাণবন্ত করার কোন প্রয়াসই কে নেওয়া হবে না ? এ এক বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন বাঙালীর সামনে ।
সময় এসেছে, বাংলা ভাষার মৌলিকত্ব বজায় রেখে বাংলা ভাষাকে সর্বত্র ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া। স্বাধীনচেতা বাঙালীর মুখে, কাগজে-কলমে লেগে থাকুক শুদ্ধ বাংলা – অমর একুশের অনুপ্রেরণায় মাতৃভাষা হয়ে উঠুক বাঙালীর প্রাণের ভাষা, ভাবের ভাষা এবং কাজের ভাষা। বাংলা ভাষা হয়ে উঠুক অন্য ভাষা-ভাষীদের অনুকরনীয় অনুপ্রেরণা। তবেই হবে বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?