কেমন আছে রেলের হকার ?
অমরনাথ কর্মকার ০৮/০৯/২০২০
রেল স্টেশন দিয়ে যখনই যাই, তখনই দেখতে পাই লোকটাকে। প্লাটফর্মে একা একা ব'সে আছেন সত্তরোর্ধ ব্যক্তিটি। খুব চেনা চেনা লাগে অথচ কিছুতেই মনে করতে পারি না। প্রায় ছ' মাসের বেশি হতে চলল, একদা বিরামহীন রেল পরিবহণ করোনা ভাইরাসের অতিমারীর প্রভাবে আজ পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে আছে। করোনা ভাইরাস রেলের চলমান ঐতিহ্যকে একেবারে থামিয়ে দিয়েছে। যাত্রিহীন প্লাটফর্মে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। লোকটাকে কিছুতেই মনে করতে পারছি না ব'লে ভেতরে ভেতরে একটা অস্থিরতা কাজ করছে। আজ অনেক ভেবেচিন্তে উদ্ধার করতে পেরেছি তার পরিচিতি। লজেন্স কাকু। সেই ছোট্ট বেলা থেকে আমি ট্রেনের নিত্য যাত্রী, স্কুলে যাওয়া- আসার নিত্য পরিবহণ। তারপর চাকরী জীবনেও সেই রেলই ভরসা। ছোট্ট বেলা থেকেই তাকে দেখে আসছি বয়াম ভর্তি লজেন্স নিয়ে ট্রেনের কামরায় বিচিত্র আকর্ষনীয় ভঙ্গিমায় লজেন্স বিক্রি করতে। আমরা ডাকতাম 'লজেন্স কাকু'। ট্রেন বন্ধ হবার আগের দিনও তার কাছ থেকে লজেন্স কিনেছি। লজেন্স বিক্রি ক'রে সামান্য উপার্জন অথচ পেশা পরিবর্তন করেননি। ট্রেনের যাত্রীদের প্রতি অনুরাগেই হয়ত পেশা পাল্টাননি। লকডাউনে কত লোকের জীবিকা বন্ধ হয়ে গেছে। লক ডাউন উঠে যাবার পর অনেকেই বাঁচার তাগিদে উপার্জনের বিকল্প পথ বেছে নিয়েছেন। ট্রেন কবে চালু হবে তা অনিশ্চিত। তাহ'লে ট্রেনে হকারি করা মানুষগুলো কেমন আছেন ? এই প্রশ্নের মধ্যে কিন্তু অনেক উদ্বেগ লুকিয়ে আছে।
শিয়ালদা থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর পর্যন্ত যে ঝালমুড়িওয়ালা একদা নিত্যযাত্রীদের চাহিদা পূরণে হিমশিম খেত, 'গরম চায়ে' হাঁক দেওয়া মাত্র যার পেটমোটা চায়ের কেটলি নিমেষে নিঃশেষ হয়ে যেত কিংবা বাঁশিতে বাচ্চার কান্নার নিখুঁত শব্দ শুনিয়ে জোকারের মত মানুষকে আনন্দ দিয়ে বাঁশি বিক্রি করত তাদের সংসার এখন চলছে কি ভাবে? পরিবারের দারিদ্র্য নিরসনে ক্যানিং কিংবা বনগাঁ লোকালে যে সমস্ত মহিলারা ভিড়ে ঠাসা রেলের কামরায় রীতিমত ঝগড়া আর মল্লযুদ্ধ করতে করতে কলকাতায় বাবুদের বাড়িতে কাজ করতে যেত তাদের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন? ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। তিল ধারনের অসাধ্য ট্রেনের কামরায় ঘর্মাক্ত কলেবরে গায়ে গা লাগিয়ে, ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা সহযাত্রীদের সাথে কুস্তি করতে করতে গন্ত্যব্যে পৌঁছনোয় অভ্যস্ত জীবনে আকষ্মিক দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা আমার মত অনেককেই হয়ত উপার্জনের পথ থেকে নিরস্ত করতে পারেনি, কিন্তু যাদের কাছে রেলের কামরাই ছিল উপার্জনের এক এবং একমাত্র জায়গা তাদের পরিণতির কথা মনকে ভারাক্রান্ত করে। যে অন্ধ ছেলেটা সুন্দর গান গেয়ে ট্রেনযাত্রীদের প্রশংসা সহ অর্থ উপার্জন করত সে কি এখন আর গান শুনিয়ে ভিক্ষে করতে পারে আগের মত?
আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়ত ট্রেন চালানো শুরু হবে বিভিন্ন নিয়ম কানুনের বজ্র আঁটুনি দিয়ে। মাস্ক বাধ্যতামূলক হবে, মানা হবে দূরত্ব বিধি। তাতে যাত্রী সাধারণ অবশ্যই উপকৃত হবেন। কিন্তু হকাররা, বাচিক শিল্পীদের মত অসাধারণ দক্ষতায় শুধুমাত্র 'কথা' দিয়ে যারা জিনিস বিক্রি করতেন তাদের দুর্দশার কিন্তু অবসান হওয়া প্রায় অসম্ভব। মাস্কের আড়াল থেকে মুখোচ্চারিত শব্দ আগের মত হবে না। অথবা ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে আসা কাজের মাসি আর কি কাজ পাবেন বাবুর বাড়িতে? করোনা সংক্রণের ভয়ে নির্ঘাত নৈব নৈব চ। গান গেয়ে ভিক্ষে করা ছেলেটা কি আর পারবে মাস্ক-মুখে গান গাইতে? আর এভাবেই যদি চলতে থাকে এই পরিবর্তিত ট্রেন যাত্রা তাহলে দেশের বেকারত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি আমরা চিরতরে হারাব একঘেয়ে ট্রেন যাত্রায় আমাদের মানসিক বিনোদন দানের প্রতিভাবান কুশিলবদের। এদের বিকল্প উপার্জনের পথ খুলতে আশাকরি সরকার সচেষ্ট হবেন।