শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

আমার প্রথম শিক্ষক

 

আমার প্রথম শিক্ষক – অমরনাথ কর্মকার ০৫/০৯/২০২০ (শিক্ষক দিবস)

শিক্ষক দিবস নিয়ে লিখতে গিয়ে আজ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। জীবনের অতিক্রান্ত পথের দৈর্ঘ্য অনেক। স্বভাবতই ভেসে উঠছে শয়ে শয়ে শিক্ষকের মুখ। শুধু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই নন, এই দীর্ঘ পথে লেখাপড়ার বাইরেও অনেক শিক্ষক পেয়েছি যাদের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষায় বাস্তব জীবনে উপকৃত হয়েছি আবার কারো কারো কাছ থেকে পাওয়া 'শিক্ষা' কাঁদিয়ে  ছেড়েছে। তাই শিক্ষক দিবসে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে থেকে বাড়িতে পড়াতে আসা হতদরিদ্র অনু মাস্টারমশাই থেকে শুরু ক'রে আজ অবধি শিক্ষা প্রদানকারী মানুষদের বিচিত্র অবয়বগুলো কখনো স্পষ্ট, কখনো আবছা হয়ে ভেসে উঠছে চোখের সামনে। শৈশবের অনু মাস্টারমশায় অনেকদিন আগেই শিক্ষা দিয়ে এবং উচিত শিক্ষা পেয়ে গত হয়েছেন। স্মৃতি গুলো আবছায়া মনে আছে।

         তখনো স্কুলে ভর্তি হইনি। না, স্কুলে ভর্তি পরীক্ষার চল তখন ছিল না, প্রয়োজনও ছিল না বোধ হয়। শুধু পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ তৈরির উদ্দেশ্যেই বাবা অনু মাষ্টারমশাইকে ঠিক করলেন। জীর্ণ চেহারার মানুষটি খাকি রঙের একটা জামা আর একই রঙের একটা প্যান্ট পরে ভোরবেলা হাজির হতেন আমাদের বাড়ি। অত ভোরে আমাকে ঘুম থেকে ওঠানো ছিল প্রায় দুঃসাধ্য। আমাকে ঘুম থেকে তোলার জন্য যখন ঘরের মধ্যে আমার সঙ্গে মায়ের চিতকার সহযোগে যুদ্ধ চলছে সেই অবসরে মাস্টারমশাই চা পান করে নিতেন বারান্দায় বসে। তিনি সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকতেন আমাদের বাড়ি। বেশিরভাগ দিনই আমাকে পড়াতে বসানো সম্ভব হ'ত না। মাস্টারমশাই মাকে নিরস্ত করতেন 'থাক বউমা, কাল পড়বে, আজ ঘুমাক'। আমি এই কথাটিই শোনার জন্য ঘুমানোর ভান ক'রে থাকতাম এবং সেই অভয় বাক্য শোনার পর নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। সাড়ে আটটা নাগাদ মাস্টারমশাইকে ভাত দেওয়া হ'ত। তিনি ভাত খেয়ে চলে যেতেন পোষ্ট অফিসে। উনি ছিলেন পোস্টম্যান। সে সময় পোষ্টম্যানের চাকরি ক'রে সংসার চালানো ছিল প্রায় দুঃসাধ্য। আমি ওনাকে পোস্ট অফিসের ইউনিফর্মেই সর্বত্র যাতায়াত করতে দেখতাম।নতুন জামা-প্যান্ট কেনার সাধ্য তাঁর ছিল না।   তাঁর দারিদ্রের কথা ভেবেই বাবা তাঁকে আমাকে পড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং আমাদের বাড়িতে তাঁর সকালের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই আমার শিক্ষার প্রথম সোপানে ওঠা। আমার হাতে হাত রেখে শ্লেটের ওপরে পেন্সিলের আঁচড় দিয়ে সযত্নে অ-আ-ক-খ শেখানো আজ খুব মনে পড়ছে। একটু বড় হয়ে হাই স্কুলে পড়ার সময় একদিন স্কুলে যাবার পথে শ্মশানগামী এক মৃতদেহ যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম অনু মাস্টার মারা গেছে। ছোট্ট মনে তখন অনুভূতিগুলো প্রখর ছিল না। তবুও ভেতরে ভেতরে মন খারাপ হ'ল। বাড়ি ফিরে বাবার কাছে জানলাম যক্ষা হয়েছিল। দারিদ্রের কারনে ডাক্তার না দেখিয়ে রোগ পুষে রেখেছিলেন। দারিদ্রের কাছে উচিত ধিক্ষা পেয়ে মারা গেলেন।তারপর বড় হওয়ার সাথে সাথে বহু শিক্ষক্কের সান্নিধ্যে এসেছি। তাঁদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কারো কারো কথা লিখেওছি অনেক জায়গায়। আজ আমার প্রথম শিক্ষকের স্মৃতি যেন বেশি মনে পড়ছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই কারনেই বোধ হয় মানুষ শৈশবের ডাক শুনতে পায়।  প্রাত্যহিক জীবন-সংগ্রামে এখন সবচেয়ে বড় শিক্ষক রাজনীতি আর রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা। এরা বেত হাতে শাসন করে আর আমাদের শিক্ষা দেয়, বলা যায় উচিত শিক্ষা। আর গত ছ'মাস ধ'রে যে অদৃশ্য শিক্ষক সভ্যতার সব মানুষকে কঠিন শিক্ষা দিয়ে চলেছে, যার শিক্ষায় এতদিনের সমাজ ব্যবস্থায় এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন, যার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ অতিমারী থেকে জীবন রক্ষার জন্য সামাজিক পরিবর্তনের পথ বেছে নিয়েছে তাকে স্যালুট জানানোটাও জরুরী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?