সপ্তমীতে মন খারাপ - অমরনাথ কর্মকার ০২/১০/২০২২
আকাশ ভয় দেখাচ্ছিল সারাদিন। কিন্তু রাত্রি বাড়লেও আমাদের এখানে সেটা কাগুজে বাঘের মত নিস্তেজই রয়ে গেল। উৎসবমুখী মানুষের জন্য এ এক স্বস্তির বার্তা। সপ্তমী আজ। উৎসবের উচ্ছ্বলতায় স্বাভাবিকভাবেই মহাত্মা গান্ধী হারিয়ে গেলেন। মন ভালো থাকে না পুজো এলে। একথা বহুবার বলেছি। তবে আমার মন খারাপের সঙ্গে অন্যদার সম্পৃক্ত করার কোন অধিকার আমার নেই। তাই বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সাথে আনন্দে সামিল হওয়ার বিরুদ্ধাচরণ করা দৃষ্টিকটু। তাই নতুন পাঞ্জাবি-পাজামায় সুবেশ হয়ে চললাম স্থানীয় পুজো মন্ডপগুলো প্রদক্ষিন করতে। এখন অবশ্য 'প্যান্ডেল হপিং' বললে বাঙালীরা ভালো বোঝেন। মন্ডপে মন্ডপে চোখ দিয়ে প্রতিমা দর্শনের লোকের সংখ্যা সামান্যই। বেশিরভাগই প্রতিমা বা মন্ডপের সৌন্দর্য দর্শন করছেন মোবাইল ফোনের লেন্স দিয়ে। এরই মধ্যে গতকাল থেকে ৫জি পরিষেবা চালু হয়েছে এ দেশে। এমনিতেই আমরা অন্তর্জালে আবদ্ধ হয়ে একরকম নিজস্বতা হারাতে বসেছি। তারপর ৫জি চালু হ'লে তার গতি আমাদের নিজস্বতাকে প্রায় সম্পূর্ণ হরন করার অপেক্ষায় আছে। মন্ডপ প্রদক্ষিণ করতে করতে গান্ধীমূর্তির পাদদেশের অবস্থা কল্পনা করছিলাম। সেখানে, গান্ধী জয়ন্তীতেও, পরীক্ষায় পাশ করেও প্রশাসনিক দুর্নীতির কারনে একদল বঞ্চিত চাকরীপ্রার্থী চাকরীর জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন চালাচ্ছেন। চারিদিকে যখন পুজোর আনন্দে সবাই মাতোয়ারা তখন তাদের বঞ্চনার কান্নার শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে। একদল অসুর আমাদের সমাজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যারা আমাদের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। দেবি দুর্গা নাকি মহিষাসুর মর্দিনী। বছরের পর বছর অসুরদলনী হিসাবে দুর্গার আবির্ভাব হয়। অথচ এই অসুরগুলো যুগে যুগে রয়েই যায়। এবার আবার বাংলার পুজো ইউনেস্কোর হেরিটেজ স্বীকৃতি পেয়েছে। ভেবেছিলাম অসুরনাশিনী দুর্গা এবারে অন্তত অসুর নিধনে লেগে পরবেন। কারন গত কয়েক মাসে বাঙালীর ইতিহাসে বিরল কিছু অন্যায়কারী ধরা পড়েছে যারা অনেক যোগ্য মানুষের আইনসম্মত অধিকার কেড়ে নিয়ে অযোগ্যদের কাছে সেই অধিকার তুলে দিয়েছে। জানিনা এই সমস্ত সমাজধ্বংসকারীদের দুগগা ঠাকুর শেষ পর্যন্ত নিধন করবেন কি না। আজ সপ্তমী – দুর্গোৎসব প্রবহমান। ভেবেছিলাম পুজোর কয়েকদিন অন্তত দুর্গন্ধমুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ অনুপস্থিত থাকবে। কিন্তু হ’ল ঠিক উল্টোটাই। পুজোর উদ্বোধনে গিয়েও রাজনৈতিক নেতাদের মুখে রাজনীতির কথা। আসলে রাজনৈতিক প্রভাব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে ঢুকে গেছে যে সমাজ আর রাজনীতিকে পৃথক করা যাচ্ছে না, আর এই দুই-এর মাঝখানে প’ড়ে সাধারণ মানুষ স্যান্ডউইচ। সপ্তমী শেষ। তার মানে দুর্গোৎসবের মধ্যগগন। আমার মন খারাপের মাত্রাও পৌঁছে গেছে সর্বোচ্চ স্তরে। আজ সপ্তমীর রাস্তায় মানুষের মিছিল দেখতে দেখতে ভাবছিলাম সবকিছু ভুলে মানুষ অনাবিল আনন্দে আত্মহারা। অথচ দুদিন বাদেই আবার কানে বাজবে সীমাহীন দুর্নীতির গল্প, রাজনৈতিক তরজা, আদালত, ইডি, সিবিআই, সিআইডি, পুলিশ আর সাধারণ মানুষ উদ্বেগের নদীতে হাবুডুবু খাবে, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে, আর্থিক সঙ্কট নিয়ে, পেট্রোল ডিজেলের দাম নিয়ে, শিক্ষায় দুর্নীতি নিয়ে। রেপো রেট কিংবা জিডিপি নিয়ে চায়ের দোকানে গভীর আলোচনা হলেও সাধারণ মানুষের এ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই, কারন এই জটিল অঙ্ক তাদের মাথার উপর দিয়ে যায়। মন খারাপ লাগছে। দু’দিন পরেই আবার শুরু হয়ে যাবে সেই দুর্নীতির গল্প, আইন-আদালত, রাজনৈতিক ভাষা সন্ত্রাস। টিভি খুললেই সারাদিন একটানা চলবে দুর্নীতি আর রাজনীতির খবর। যেন রাজনীতিই হয়ে গেছে আমাদের সংস্কৃতি।
অশান্তির হাতছানিতে শান্তিরও শান্তি নেই। কাল অষ্টমীর প্রস্তুতি চলছে বাঙালীর মনোরাজ্যে। আর আমার মন খারাপ হচ্ছে বাঙালীর স্বার্ণালী ঐতিহ্যের পরিণাম কল্পনা ক’রে। মন হয়ত এভাবে অনেকেরই খারাপ হয়। কিন্তু এই ভাবনাগুলো আমি লিখে ফেলি। কাল অষ্টমীতেও মন ভালো থাকবে না অবধারিতভাবে। আশা করি, আগামীকালও লিখব। চললাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন