শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০২২

ষষ্ঠীতে মন খারাপ – অমরনাথ কর্মকার ০১/১০/২০২২

 

 

ষষ্ঠীতে মন খারাপ – অমরনাথ কর্মকার ০১/১০/২০২২

না পাওয়ার যন্ত্রনাকে কোনোদিন মনের মধ্যে সেভাবে স্থান দিইনি। তার  চেয়ে  না দিতে পারার যন্ত্রণায় ভুগি অনেক বেশি। না পাওয়া দুঃখ দেয়নি বা দেয় না তার কারন আমার চাহিদার পরিমাণ নিতান্তই সামান্য। ছোটবেলায় পুজো এলে যখন আমার বন্ধু-বান্ধবদের নতুন পোশাক আশাকের প্রদর্শনী আর সংখ্যা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলত তখন আমিও সেই প্রতিযোগিতায় দর্শক হতাম হাসি মুখে, কারন মাত্র এক বা বড়জোর দুই প্রস্থ (তাও কম দামী) নতুন পোশাক পেয়ে সেই প্রতিযোগিতায় যোগ দিলে শেষ থেকে প্রথম হয়ে হাস্যকর  হওয়ার কোন মানেই হয় না। পুজোর সময় নতুন পোশাকের চেয়েও বেশি আনন্দ পেতাম যখন পুজো উপলক্ষে গুরুজনেরা পয়সা হাতে দিতেন। সেই পয়সা সযত্নে আর সুরক্ষার সঙ্গে জমিয়ে রাখার মধ্যে যে কি আনন্দ ছিল তা অভাবনীয়। মনে পড়ছে ঠাকুমার আঁচলে বাঁধা পয়সা চুরির কথা গুলো। সেই ছোট ছোট পাওয়ার সাথে সাথে দেওয়ার আনন্দও অনুভব করতাম খুব।চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোমকথাটা শুধুই প্রবাদ নয়। পুজোর সময় বাড়িতে কোন সাহায্যপ্রার্থী এলে মা-এর হাত দরাজ হয়ে উঠত। আমি ছোট লে সেই সময় মা আমার হাত দিয়েই তাদের হাতে চাল, পয়সা তুলে দিতেন। আমার হাত দিয়ে সাহায্য তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্য অবশ্যই আমার ওপর ঈশ্বরের আশির্বাদ বর্ষণএটাই বোধ হয় মায়েদের ধর্ম, সন্তানকে ভালো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। এই ভাবেই বোধ হয় আমার মধ্যে তৈরি হয়েছে কাউকে কিছু দিয়ে আনন্দ পাওয়া। সেই ট্রাডিশান আজও সমানে চলেছে। প্রাপ্তিযোগ আমার কম, এখনও। প্রাপ্তির জায়গা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী।  আবার অনেকক্ষেত্রে অবধারিত প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত হই অনেক সময়। তা নিয়ে ভাবি না বললে ভুল হবে, তবে দ্রুত তা মাথা থেকে ভ্যানিশ করার চেষ্টা করি। ছাত্রাবস্থায় কলেজে পড়ার অর্থ যোগাতে যখন থেকে ছাত্র পড়িয়ে রোজগার করতে শুরু করেছি তখন থেকেই সেই রোজগার থেকে পুজোর সময় পরিজনদের নতুন পোশাক কিনে দিয়েছি। সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল পরিজনদের শিশুদের কিছু দেওয়ার চেষ্টা করতাম। আমি এখনও তাই ক’রে থাকি। অর্থবানদের উপহার দিতেও আমার সঙ্কোচ হয়, কারন তাদের বেশিরভাগই উপহারকে আর্থিক মূল্যে বিচার করে এবং তা কম দামী হ’লে উপহার প্রদানকারীর সমালোচনায় লিপ্ত হয়। 

পুজো এসে গেল। আজ ষষ্ঠী। পুজো এলেই আমার মন খারাপ হয় প্রতি বছর। পুজো একটা উৎসব, বাঙালীর ঐতিহ্য। পুজো মানেই এক দেবিকে সামনে রেখে এলাহি আয়োজন, টানা কয়েকদিন আনন্দ, উদ্দীপনা। এ তো প্রতিবছরই হয়। অথচ কেন জানিনা এক’দিন বাইরে যতটা আলো, আমার মনের মধ্যে ততটাই অন্ধকার। নির্দিষ্ট কারনও খুঁজে পাই না। তবে এই সময় গাদাগাদি ভিড়ে অনেক অর্থ ব্যয়ে নির্মিত ঝা চকচকে প্যান্ডেলে আলোর রোশনাই, উচ্ছ্বসিত সুসজ্জিত মানুষের আনন্দঘন আনাগোনা দেখতে দেখতে আর একদল হতদরিদ্র মানুষের ছবি উঁকি মারতে থাকে মনের জানালায়। এ এক অদ্ভুত কন্ট্রাস্ট। এই হতদরিদ্র না খেতে পাওয়া মানুষগুলোও কিন্তু উৎসবে সামিল হয়। তবে অন্যভাবে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই মোরগের মত – যার স্থান হয়েছিল টেবিলে – খার খেতে নয় – খাবার হিসাবে। এরা পুজো প্যান্ডেলে মানুষের ভিড়ে হাজির হয় ঠাকুর দেখতে নয়, উৎসব থেকে সাহায্য পেতে। ছোট্ট ছেলেটির হাতে রঙিন বেলুনের পসরা। বেলুন বিক্রিতে তাঁর মন নেই। সে সোৎসাহে চেয়ে আছে নতুন পোশাকে সজ্জিত তার সমবয়সীদের আনন্দ-উচ্ছ্বল বিচরণে। টানাটানির সংসারে বাড়তি উপার্জনের সুযোগ হাতছাড়া না করার তাগিদেই বাবা-মায়ের আদেশ পালন ক’রে যাচ্ছে সে। উৎসব তো তাদের জন্যই হওয়া দরকার কোনোক্রমে বেঁচে থাকার রসদ যোগাতেই যাদের হিমশিম খেতে হয়। অর্থবানদের সারাবছরই তো উৎসব চলে। সমাজের এই ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য এই সময়টা বড্ড বেশি চোখে পড়ে। বড়লোকের ছেলেটা যখন তার নতুন পোশাক প্রাপ্তির হিসাব করছে ডজনে, তখন পরের বাড়ি বাসন মেজে আয় করা মহিলার ছোট্ট ছেলেটার নউন জামা না হওয়ার দুঃখে চোখের জল শুকিয়ে গেছে।

ষষ্ঠীতে মন খারাপ দিয়ে পুজো শুরু। সপ্তমীতে বৃষ্টির পূর্বাভাষ থাকলেও ষষ্ঠীতেই হাজির। মন খারাপের বৃষ্টি। কাল সপ্তমীতে আবার লিখব মন খারাপের গল্প – ইচ্ছে রইল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?