শুক্রবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১
শুক্রবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১
সামাজিক মাধ্যম ও বাংলা ভাষা
সামাজিক
মাধ্যম ও বাংলা ভাষা
অমরনাথ কর্মকার ২৫/১২/২০২১
আজকাল
কিছু শব্দ ইন্টারনেট ও
বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে বিশ্বময় বিপুল জনপ্রিয়। কিছুদিন আগে একটি সিংহলি
গান ‘মানিকে মাগে হিথে..’ ভাইরাল
হয়েছিল। অতি সম্প্রতি ভূবন
বাদ্যকারের ‘কাঁচা বাদাম’ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু বিষ্ময়ের ব্যাপার হ’ল ইংরেজি অভিধান
অনুযায়ী ‘ভাইরাল’ শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত
হওয়ার কথা এক্ষেত্রে তার
সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মূলত শাব্দিক
অর্থের পরিবর্তে এখানে ভাবার্থই প্রাধান্য পেয়েছে। বিশেষ্য ‘ভাইরাস’-এর গুণবাচক বিশেষণ
হিসাবে ‘ভাইরাল’ শব্দটির জনপ্রিয়তা। আবার আভিধানিক অর্থের
ভিত্তিতে, ভাইরাস যেহেতু অতি দ্রুত বিস্তার
লাভ করে তাই অতি
দ্রুত বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে কোন বিষয় অতি
দ্রুত ছড়িয়ে পড়া অর্থে ভাইরাল
শব্দের ব্যবহার আভিধানিক স্বীকৃতি পেতেই পারে – পার্থক্য একটাই, আভিধানিকভাবে এই ছড়িয়ে পড়া
একটি বিষক্রিয়া অর্থাৎ ক্ষতিকারক আর সামাজিক মাধ্যমে
এটি বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত । ২০১৭ সালে
গুগল, ইউটিউব, ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বা
খোঁজ করা শব্দগুলোর মধ্যে
ভাইরাল শব্দটি অন্যতম।
তবে সামাজিক মাধ্যমে
এই ‘ভাইরাল’ শব্দটির ব্যাপক ব্যবহারের একটা ইতিহাস আছে। ২০০০
সালের ৩১ জুলাই মার্কিন
লেখক সেথ গোডিন ‘ফাস্ট
কোম্পানি ডট কম’ নামক ওয়েব সাইটে ‘আনলিশিং
দ্য আইডিয়া ভাইরাস’শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন
যেখানে একটি লাইন ছিল
Have the Idea behind your online experience go viral… সেই থেকেই
‘ভাইরাল’ শব্দটির
ভাইরাল হওয়ার সূত্রপাত। আর এখন তো
গ্রামবাংলার মানুষও রানু মন্ডল বা
ভূবন বাদ্যকারের ‘ভাইরাল হওয়ার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। সেইসঙ্গে নেটদুনিয়ায় সর্বক্ষণ চলছে রাতারাতি ভাইরাল
হওয়ার ইদুরদৌড়। বিষয়ের ভালো-মন্দ এক্ষেত্রে
হয়ত মূল বিচার্য নয়,
কত বেশি সংখ্যক মানুষ
তার দর্শক সেটাই বিচার্য । এতে কেউ
হয়ত রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে উঠছেন আবার
কেউ বা হয়ে উঠছেন
খলনায়ক। ভূবন বাদ্যকারের ‘কাঁচা
বাদাম’
ভাইরাল হয়ে তিনি বিখ্যাত
হয়ে উঠেছেন রাতারাতি, আবার একদা ভাইরাল
হওয়া প্রশংসিত গায়িকা রানু মন্ডল পুনরায়
ভাইরাল হয়েছেন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের পাত্রী হিসাবে। সুতরাং এই ভাইরালিজমের ভালো,
মন্দ দুটো দিকই আছে।
‘ভাইরাল’-এর
মত আরোও অনেক শব্দ
সামাজিক মাধ্যমের বদান্যতায় বিশ্বময় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বলা যেতে পারে
ইন্টারনেট তথা বিভিন্ন সামাজিক
মাধ্যমের কারনে ভাষাবিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত
উন্মোচিত হয়েছে। অনেক দেশে এ
নিয়ে রীতিমত গবেষণা শুরু হয়েছে। ইউরোপের ভাষাবিজ্ঞানী
ও গবেষক ডেভিড ক্রিস্টাল ‘ইনটারনেট লিঙ্গুইস্টিক্স’(আন্তর্জালিক
ভাষাবিজ্ঞান) নামে নতুন এক
বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তিনি মনে করেন,
একাডেমিক শৃঙ্খলায় একটি নতুন বিষয়ের
সংযোজন করা খুব সহজ
নয়, কিন্তু ইন্টারনেটের
আবির্ভাব ভাষাকে এতটাই প্রভাবিত করেছে যে ইন্টারনেটের ভাষা
নিয়ে গবেষণা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই
সমস্ত ভাষার স্থায়ীত্ব সাময়িক, খুব কম সময়ের
ব্যবধানে এই ভাষা পরিবর্তিত
হচ্ছে, ।
সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে বাংলাভাষীদের মধ্যেও ভাষার পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক মাধ্যমের কিছু শব্দ আজকাল
বাংলাভাষীদের মধ্যে প্রায় মাতৃভাষার মতই উচ্চারিত হ’তে শোনা যায়। এমনকি
যারা ইংরেজী পড়তে পর্যন্ত পারে
না তাদের মুখেও এই সমস্ত শব্দ
স্বচ্ছন্দে উচ্চারণ করতে শোনা যায়।
আবার ফেসবুক, হোয়াটসআপ-এর দৌলতে বাংলা
ভাষাও বিকৃত হতে শুরু করেছে।
বাক্য বা শব্দগুচ্ছ একত্র
ও সংক্ষিপ্ত করার প্রবণতা এক
নাটকীয় মোড় নিতে শুরু
করেছে। আছে লেখা হচ্ছে
a6 কিংবা রাইট বোঝাতে লেখা
হচ্ছে r8. এছাড়াও বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিশিয়ে জগাখিচুরি মার্কা একটা বহুভাষিক পরিস্থিতি
তৈরি করারও প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ইদানিং
নেটিজেন শব্দটি বহুশ্রুত। সিটিজেন শব্দটা আজও যে তার
অস্তিত্ব বজায় রেখেছে সেটাই বিষ্ময়ের।
যে সামান্য সংখ্যক নাগরিক এখনোও অন্তর্জালে আবদ্ধ হননি তাদের সৌজন্যেই
বোধ হয় সিটিজেন শব্দটি
বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। অদূর
ভবিষ্যতে যখন একশ শতাংশ
মানুষই অন্তর্জালে বন্দি হবেন তখনই সিটিজেন
তার অস্তিত্ব হারিয়ে নির্ঘাত নেটিজেন-এ রুপান্তরিত
হবে।
মোদ্দা কথা, ইন্টারনেট সামাজিক
যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে চর্চিত ভাষা প্রমিত বাংলা
যেমন নয়, তেমনি আঞ্চলিক
বাংলাও নয়। এই মিশ্র
ভাষারীতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গন্ডি ছাড়িয়ে আমাদের বাস্তব জীবনের ভাষা ব্যবহারকে বদলে
দিচ্ছে ধীরে ধীরে। সামাজিক
যোগাযোগের মাধ্যমে ভাষার এই পরিবর্তনে বদলে
যাচ্ছে বাংলা ভাষা। আবির্ভাব ঘটছে এক মিশ্র
প্রকৃতির ভাষারীতি।
সামাজিক মাধ্যমকে কেন্দ্র ক’রে বাংলা
ভাষার এই বিকৃতি বাংলা
ভাষা আর বাংলাভাষীদের পক্ষে
কতটা গ্রহণযোগ্য তা বিবেচনার বিষয়।
সামাজিক মাধ্যমের সৌজন্যে কিছু ইংরেজি বা
বিদেশী শব্দ
বা শব্দগুচ্ছ বিশ্বময় জনপ্রিয় হচ্ছে কিন্তু যদি বাংলা শব্দ
বা শব্দগুচ্ছও একইভাবে বিশ্ব ময় গ্রহণীয় হয়ে
উঠত তাহলেই বোধ হয় বাংলা
ভাষার সম্মান বাড়ত । কারন
বাংলা ভাষার উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে এই ভাষার আন্তর্জাতিকিকরণ
অনেকটাই ভূমিকা রাখে।
ইন্টারনেট এখন যোগাযোগের অপরিহার্য
ও শক্তিশালী মাধ্যম। আজ আর ইন্টারনেটের
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ব্যবহার বিনোদনের গন্ডিতে আবদ্ধ নেই, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিতর্ক, জনমত তৈরি, দাবি
আদায়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেও এখন ব্যাপকভাবে ভূমিকা
রাখছে এটি। সামাজিক যোগাযোগের
মাধ্যমের প্রভাবে পালটাতে শুরু করেছে আমাদের
সামগ্রিক জীবনযাত্রা। ফেসবুক, ব্লগ প্রভৃতিতে চলছে
বাংলা ভাষায় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা। ইন্টারনেটে একদিকে
যেমন বাংলার বিকৃত ব্যবহার বাড়ছে অন্যদিকে প্রমিত ও শুদ্ধ বাংলার
ব্যবহারও রয়েছে। এভাবেই ভালো-মন্দে সারা
বিশ্বে ছড়িয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেটের বাংলা ভাষা।
ভাষা ব্যবহারে তাই
আমাদের সবারই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ভাষার
নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে,
একটা ঐতিহ্য আছে। সুতরাং ভাষাকে
বিকৃত করতে গিয়ে কোনভাবেই
ভাষা যেন তার নিজস্ব
ঐতিহ্য না হারায়, ভাষা
কালিমালিপ্ত না হয়। বাংলা ভাষার বিশ্বজনীনতা কিন্তু এসেছে অনেক সংগ্রাম,
রক্তক্ষয় আর বলীদানের মধ্যে দিয়ে। সুতরাং প্রতিটি বাংলাভাষীর উচিৎ বাংলা ভাষার যে কোন
ঐতিহ্যহরণকারী বিকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করা।
বুধবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২১
শৈশবের বনভোজন
শৈশবের বনভোজনঃ অমরনাথ কর্মকার
শীত পড়লেই ছোটবেলার
পিকনিকের কথা মনে পড়ে যায়। সত্যি বলতে কি শীতের হাওয়ার নাচন আমলকি বনে লাগল কি লাগল
না, এসব চিন্তাভাবনা তখন মনেও আসত না। খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে শরীরে কম্বল মুড়িয়ে
শুয়ে শুয়ে। রেডিওতে খবর শুনতাম অমুক রাজ্যে শৈত্য প্রবাহ চলছে। তখন শৈত্যপ্রবাহ মানে
ভাবতাম বরফ পড়া। একটু বড় হয়ে অবশ্য সঠিক মানেটা জানতে পেরেছি। সে যাই হোক শীত মানেই
ছিল বনভোজন। তার না থাকত কোন পূর্ব পরিকল্পনা, না থাকত কোন বিশেষ স্থান নির্বাচন কিংবা
বিশেষ আড়ম্বর। কয়েকজন ক্ষুদে মিলে মিটিং ক’রে ঠিক ক’রে নিতাম বনভোজনের দিন বা সময়।
সত্যি বলতে কি ত খন আমাদের মধ্যে পিকনিক শব্দের প্রচলন খুব একটা ছিল না। বনভোজন বা
চড়ুইভাতি বলতেই অভ্যস্ত ছিলাম। হয়ত দুপুর বেলা ঠিক করলাম বিকেলে বনভোজন হবে। মেয়েরা
রান্নাবান্নার কাজ ভালো পারে ব’লে ওদেরকে সাথে রাখতাম । তারপর বাড়ি গিয়ে মায়ের কাছে
একটা চায়ের কাপ নিয়ে কানে কানে মায়ের কাছে আবদার করতাম এককাপ চাল, দুটো আলু আর একটা
ডিম দেওয়ার জন্য। পাছে বাবা জানতে পেরে রাগারাগি করে সেই ভয়ে গোপনে কাজ সারতে হ’ত।
লাল্টুদের বড় মুদি দোকান ছিল, ওর ওপরে সর্ষের তেল আনার দায়িত্ব দেওয়া হ’ত। ওই বয়সেও আমরা ধনী-গরীবের পার্থক্য বুঝতাম, তাই দায়িত্ব
দেওয়ার সময় সেই পার্থক্য মাথায় রাখা হ’ত। যদিও বন্ধুত্বে সে পার্থক্য স্থান পেত না।
যেমন রতনরা খুব গরীব ব’লে নীলিমাই রতনের চাল,
ডিম এনে দিত। নিষ্কলুষ সেই বন্ধুত্বের কথা আজ যখন ভাবি, বড্ড কষ্ট হয়। ভাত আর ডিমের
ঝোল রান্না হল। শাকিবদের বাগানের এক কোনে সন্ধ্যে নামার আগেই বনভোজনের পালা সাঙ্গ।
শীত পড়লে মাঝে মাঝেই এই আয়োজন চলত। তারপর একটু বড় হলে, মায়ের কাছে চাল, ডিম চাওয়ার
পরিবর্তে বনভোজনের জন্য পয়সা চাওয়া শুরু হ’ল। বনভোজনে ডিমের পরিবর্তে মুরগীর মাংস এল।
নিজেরা মুরগী কাটতে পারব না ব’লে আমাদের চেয়ে
বয়সে বড় কোন দাদাকে ডাকা হ’ত মুরগী কেটে দেওয়ার জন্য। মুরগী কেটে দেওয়ার সৌজন্যে সেই
দাদাটির জন্য বনভোজনে খাওয়ার আমন্ত্রণ থাকত। শুধু মুরগীর মাংস আর ভাত ছাড়াও অনেক সময়
ফুলকপির তরকারী, চাটনি এসবের ব্যবস্থাও করা হ’ত। তার জন্য একটু সাহসী বন্ধুদের অবদান
থাকত। কারন আশপাশের মাঠ থেকে ফুলকপি বা টমেটো চুরির কাজটা তারাই করত। প্রাইমারী ইস্কুলে
পড়া অবধি শীতকাল এভাবেই বনভোজনের আনন্দে কাটত। হাই ইস্কুলে ভর্তি হবার পর বনভোজনের
ধরণ পাল্টাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে বনভোজন বা
চড়ুইভাতি পিকনিকে রুপান্তরিত হ’ল। বনভোজন বা চড়ুইভাতির সঙ্গে পিকনিকের আভিধানিক অর্থের
মিল যতই থাক, মানসিক অনুভূতি আর উপভোগ্যতায় এদের মধ্যে মনে হয় বিস্তর ফারাক।
গত দু’তিন দিন
জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। এখন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে শৈশবের স্মৃতিবিলাসে মশগুল হয়ে ছোটবেলার
বনভোজনের কথা মনে হচ্ছিল বারবার।
এখন এক-একেকটা
পিকনিক
বাবা-মায়েদের
কাছে
খুবই
দুশ্চিন্তার
বিষয়।
ছেলে বা মেয়ে
পিকনিক
থেকে
না
ফেরা
পর্যন্ত
দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। এখন পিকনিক মানে শুধু হৈ হুল্লোড় ক’রে রান্না খাওয়া-দাওয়া নয়, থাকে বিনোদনের
নেপথ্যে অনেক অশালীনতা, আধুনিকতার দোহাই দেওয়া অসদাচরন। এর মানে এই নয় যে জেনারেশন গ্যাপকে মাথায় রেখে নবীন প্রজন্মের পিকনিক আমাদের
সময়ের থেকে খারাপ এই ধারণা পোষণ করছি।
তবে
মাঝে
মাঝে
ভাবি
মাত্র
অর্থ
শতকের
ব্যবধানে
আচার-ব্যবহারের
এতটা
গুণগত
পরিবর্তন
হয়ে
গেল।
এটা আদৌ কোন শুভ লক্ষণ কিনা এব্যাপারে মাঝে মাঝে সন্দিহান
হয়ে পড়ি।
আজ একটা জিনিস জানলাম যে Picnic শব্দটির উৎপত্তি ফরাসি শব্দ pique-nique থেকে
যেটি ১৬৯২ সালে টনি উইলিস’এর ‘ওরিজিনস দি লা ল্যাঙ্গু ফ্র্যানচেইস’ বইতে ব্যবহৃত হয়েছিল
যার অর্থ নিজেরা সঙ্গে ক’রে মদ নিয়ে রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে খাওয়া। জানিনা, এই কারনেই
আমাদের ছোটবেলার বনভোজন বা চড়ুইভাতির সঙ্গে আজকের পিকনিকের এত অমিল কিনা !
সোমবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২১
রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১
শুক্রবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২১
মঙ্গলবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২১
রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২১
শিশুশ্রম – আজকের প্রাসঙ্গিকতা
শিশুশ্রম
– আজকের প্রাসঙ্গিকতা
–
অমরনাথ কর্মকার ২৮/১১/২০২১
শিশুশ্রম বিষয়টির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে এই মুহূর্তে উদ্বেগের কারন হ'ল প্রায় ২ বছরের দীর্ঘ লকডাউনের পরে হঠাৎ স্কুল খোলার নির্দেশনামা জারি হয়েছে। ইতিমধ্যে গত ১৬ নভেম্বর, ২০২১ থেকে এই রাজ্যে স্কুল-কলেজেও সরকারী নির্দেশনামা মেনে ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে। স্কুল-কলেজ খোলার পরে পড়ুয়াদের উপস্থিতির অস্বাভাবিক নিম্নমুখী হারে শিক্ষা মহলে যথেষ্ট উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। স্কুল বা কলেজ কর্তৃপক্ষ যদি পড়ুয়াদের অনুপস্থিতির কারন শুধুই করোনার ভীতি ব'লে ধরে থাকেন তবে বোধ হয় ভুল ভাবা হবে। এই দুই বছরে বহু পরিবার কাজ না থাকার কারনে দারিদ্রের অন্ধকারে হাবুডুবু খেয়ে বেঁচে আছে। স্বভাবতই অনেক দরিদ্র বাড়ির স্কুলপড়ুয়া ছেলে বা মেয়েটি পরিবারের আর্থিক চাহিদা মেটাতে অর্থোপার্জনের কাজে নিয়োজিত হয়ে গেছে । না, শহুরে স্বচ্ছল পরিবারের পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে এই কারনের যে কোন ভিত্তি নেই, তা বলাই বাহুল্য। গ্রামের দারিদ্র পীড়িত পরিবারগুলো থেকে এক বিপুল সংখ্যক পড়ুয়া এই কারনে স্কুল বা কলেজ ছেড়েছে। স্কুল-কলেজ ছাড়ার এটা মুখ্য কারন হলেও এর পেছনে কিছু মানসিক কারনও রয়েছে।
ওয়েস্টবেঙ্গল রাইট টু এডুকেশন ফোরাম এবং ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট চাইল্ড লেবার নামে দুটি সংস্থার একটি সমীক্ষায় জানা গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইনে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে মাত্র ২৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া শ্রমজীবী পরিবারগুলোর আয় কমে যাওয়ায় ১৭ শতাংশ শিশুর দুই বেলা নিয়মিত খাবার জোটেনি। করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে আশঙ্কাজনক হারে শিশুশ্রম বেড়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির হার ৯৪.৭ শতাংশ। মেয়েদের ক্ষেত্রে হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৩ শতাংশে। এতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ঘোষিত লকডাউনে অনেক শ্রমজীবী পরিবারের শিশুরা অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারেনি। স্কুল বন্ধ থাকায় জীবিকার জন্য তারা ইটভাটা ও পাথর ভাঙার মতো বিভিন্ন কাজে যোগ দিয়েছে। সংস্থা দুটি মে ও জুন মাসে শিশুদের শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্যের ১৯টি জেলার প্রায় দুই হাজার শিশুর ওপর এই জরিপ চালিয়েছে। মহামারির সংকটের সময় ১১ শতাংশ শিশু শিক্ষার্থী ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা পায়নি বলেও উঠে এসেছে জরিপে।
সংবিধানের শিশু শ্রম (রোধ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৮৬-এর ২৪ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা রয়েছে, “১৪ বছরের নীচে কোনও শিশুকে কোনও কারখানা, খনি বা কোনও বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত করা যাবে না।” ১৯৮৬ সালে তৈরি হওয়া শিশু শ্রম (রোধ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন আইন বলে, ১৪ বছর পূর্ণ হয়নি এমন ব্যক্তিদের শিশু বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
শিশুদেরকে শিশুশ্রমে নিয়োগ করে কার্যত তাদের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে৷ কেননা অল্প বয়সে কাজ করতে গিয়ে তারা লেখাপড়ার সুযোগ হারাচ্ছে, মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে৷ আর শিশুদের বৃদ্ধির যে স্বাভাবিক পন্থা, সেই পন্থা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে৷ তারা এমন সব কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে যেগুলো তাদের বয়সে করার কথা স্বাভাবিক অবস্থায় ভাবাই যায় না৷
তাহলে অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে শিশুশ্রমে নিয়োজিত পড়ুয়াদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য করণীয় কি? প্রথমেই যেটা প্রয়োজন সেটা হ’ল শিশুশ্রম বিরোধী আইনের যথাযথ এবং কঠোর প্রয়োগ । এখানে সরকারের দায়িত্ব অনেক৷ সরকারকে শিশুশ্রম বন্ধ করে সেসব শিশুকে লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি ক’রে দেওয়া, তাদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে, বিনিয়োগ করতে হবে৷ প্রয়োজনে শিশুদের উপর নির্ভরশীলদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে৷ এক্ষেত্রে সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সহায়তা নেয়া যেতে পারে৷ মনে রাখতে হবে, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ ।
বিশ্বজুড়ে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ২০২০ সালের ১৬ কোটি অতিক্রম করেছে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চার বছরে এ তালিকায় যোগ হয়েছে ৮৪ লাখ নতুন নাম, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। আগামী দুই বছরে আরও ৫ কোটি শিশুশ্রমিক বাড়তে পারে। জাতিসংঘের নতুন এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। ‘চাইল্ড লেবার: গ্লোবাল এস্টিমেটস ২০২০, ট্রেন্ডস অ্যান্ড দ্য রোড ফরোয়ার্ড ’শীর্ষক প্রতিবেদনটি যৌথভাবে প্রকাশ করে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।
জাতিসংঘ বলছে, করোনাভাইরাস মহামারি ও লকডাউনের প্রভাবে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট গত এক বছরে আরও কোটিখানেক শিশুকে ঠেলে দিয়েছে একই দুর্ভাগ্যের দিকে। ইউনিসেফের প্রধান হেনরিয়েত্তা ফোর বলেন, শিশুশ্রম বন্ধের লড়াইয়ে আমরা হারতে বসেছি। করোনাভাইরাস মহামারি আমাদের অনেক পেছনে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্বময় লকডাউন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, অচল অর্থনীতি ও জাতীয় বাজেট সংকোচনের দ্বিতীয় বছর চলছে। এ পরিস্থিতিতে অনেক পরিবারকে বাধ্য হয়ে সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করে কাজে পাঠানোর কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
এই সমস্ত পরিসংখ্যান থেকে পরিস্থিতির আভাস মিললেও পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়। এই পরিসংখ্যান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানে তৎপর হওয়ার জন্য অত্যন্ত জরুরী।
স্পষ্টতই বিপুল সংখ্যক পড়ুয়ার চিরতরে স্কুল থেকে বিদায় নেওয়ার কারন মূলত মানুষের দারিদ্র।
এছাড়াও রয়েছে পড়ুয়াদের মানসিক অবসাদজনিত আপাত গুরুত্বহীন সমস্যা। দীর্ঘ দু’বছরের গৃহবন্দী দশায় পড়ুয়াদের মনে এসেছে নানান মানসিক পরিবর্তন। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, দীর্ঘ সময়
স্কুলের বাইরে থাকার কারণে অনেক স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যেই আচরণগত পরিবর্তন এসেছে। তাঁরা বলছেন, এমন
পরিস্থিতি একদিকে যেমন তাদের সঠিক মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অনভ্যস্ত হওয়ার প্রবণতা তৈরি
হয়েছে তাদের মধ্যে। পড়ুয়াদের স্কুল ত্যাগের পেছনে তাদের এই মানসিক পরিবর্তনের এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। এর জন্য তাদের মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন আছে। অধিকাংশ অভিভাবকই এই সমস্যাকে গুরুত্ব দেন না অশিক্ষা এবং অসেচতনতার কারনে। সে ক্ষেত্রে সরকারকেই সমস্ত দায়িত্ব নিতে হবে প্রতিটি পড়ুয়ার মানসিক স্বাস্থ্যের পরীক্ষা করা এবং মানসিক অসুস্থতার প্রতিকার করার ব্যবস্থা করা এবং অবশ্যই বিনামূল্যে। সুতরাং করোনা অতিমারী পড়ুয়াদের যে কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে তার থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য সরকারী উদ্যোগ সহ সমাজের সর্বস্তর থেকে কোমর বেঁধে লেগে পড়তে হবে।
মুখ চাপা সত্য
মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু নাকি সত্যের চির সমাধি? নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?
-
এক লাইনের কাব্যঃ অ.না.ক. ২১/০৩/২০১৭ এক লাইনেও কাব্য হয় দু'লাইনে ছন্দময় ।