শৈশবের বনভোজনঃ অমরনাথ কর্মকার
শীত পড়লেই ছোটবেলার
পিকনিকের কথা মনে পড়ে যায়। সত্যি বলতে কি শীতের হাওয়ার নাচন আমলকি বনে লাগল কি লাগল
না, এসব চিন্তাভাবনা তখন মনেও আসত না। খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে শরীরে কম্বল মুড়িয়ে
শুয়ে শুয়ে। রেডিওতে খবর শুনতাম অমুক রাজ্যে শৈত্য প্রবাহ চলছে। তখন শৈত্যপ্রবাহ মানে
ভাবতাম বরফ পড়া। একটু বড় হয়ে অবশ্য সঠিক মানেটা জানতে পেরেছি। সে যাই হোক শীত মানেই
ছিল বনভোজন। তার না থাকত কোন পূর্ব পরিকল্পনা, না থাকত কোন বিশেষ স্থান নির্বাচন কিংবা
বিশেষ আড়ম্বর। কয়েকজন ক্ষুদে মিলে মিটিং ক’রে ঠিক ক’রে নিতাম বনভোজনের দিন বা সময়।
সত্যি বলতে কি ত খন আমাদের মধ্যে পিকনিক শব্দের প্রচলন খুব একটা ছিল না। বনভোজন বা
চড়ুইভাতি বলতেই অভ্যস্ত ছিলাম। হয়ত দুপুর বেলা ঠিক করলাম বিকেলে বনভোজন হবে। মেয়েরা
রান্নাবান্নার কাজ ভালো পারে ব’লে ওদেরকে সাথে রাখতাম । তারপর বাড়ি গিয়ে মায়ের কাছে
একটা চায়ের কাপ নিয়ে কানে কানে মায়ের কাছে আবদার করতাম এককাপ চাল, দুটো আলু আর একটা
ডিম দেওয়ার জন্য। পাছে বাবা জানতে পেরে রাগারাগি করে সেই ভয়ে গোপনে কাজ সারতে হ’ত।
লাল্টুদের বড় মুদি দোকান ছিল, ওর ওপরে সর্ষের তেল আনার দায়িত্ব দেওয়া হ’ত। ওই বয়সেও আমরা ধনী-গরীবের পার্থক্য বুঝতাম, তাই দায়িত্ব
দেওয়ার সময় সেই পার্থক্য মাথায় রাখা হ’ত। যদিও বন্ধুত্বে সে পার্থক্য স্থান পেত না।
যেমন রতনরা খুব গরীব ব’লে নীলিমাই রতনের চাল,
ডিম এনে দিত। নিষ্কলুষ সেই বন্ধুত্বের কথা আজ যখন ভাবি, বড্ড কষ্ট হয়। ভাত আর ডিমের
ঝোল রান্না হল। শাকিবদের বাগানের এক কোনে সন্ধ্যে নামার আগেই বনভোজনের পালা সাঙ্গ।
শীত পড়লে মাঝে মাঝেই এই আয়োজন চলত। তারপর একটু বড় হলে, মায়ের কাছে চাল, ডিম চাওয়ার
পরিবর্তে বনভোজনের জন্য পয়সা চাওয়া শুরু হ’ল। বনভোজনে ডিমের পরিবর্তে মুরগীর মাংস এল।
নিজেরা মুরগী কাটতে পারব না ব’লে আমাদের চেয়ে
বয়সে বড় কোন দাদাকে ডাকা হ’ত মুরগী কেটে দেওয়ার জন্য। মুরগী কেটে দেওয়ার সৌজন্যে সেই
দাদাটির জন্য বনভোজনে খাওয়ার আমন্ত্রণ থাকত। শুধু মুরগীর মাংস আর ভাত ছাড়াও অনেক সময়
ফুলকপির তরকারী, চাটনি এসবের ব্যবস্থাও করা হ’ত। তার জন্য একটু সাহসী বন্ধুদের অবদান
থাকত। কারন আশপাশের মাঠ থেকে ফুলকপি বা টমেটো চুরির কাজটা তারাই করত। প্রাইমারী ইস্কুলে
পড়া অবধি শীতকাল এভাবেই বনভোজনের আনন্দে কাটত। হাই ইস্কুলে ভর্তি হবার পর বনভোজনের
ধরণ পাল্টাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে বনভোজন বা
চড়ুইভাতি পিকনিকে রুপান্তরিত হ’ল। বনভোজন বা চড়ুইভাতির সঙ্গে পিকনিকের আভিধানিক অর্থের
মিল যতই থাক, মানসিক অনুভূতি আর উপভোগ্যতায় এদের মধ্যে মনে হয় বিস্তর ফারাক।
গত দু’তিন দিন
জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। এখন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে শৈশবের স্মৃতিবিলাসে মশগুল হয়ে ছোটবেলার
বনভোজনের কথা মনে হচ্ছিল বারবার।
এখন এক-একেকটা
পিকনিক
বাবা-মায়েদের
কাছে
খুবই
দুশ্চিন্তার
বিষয়।
ছেলে বা মেয়ে
পিকনিক
থেকে
না
ফেরা
পর্যন্ত
দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। এখন পিকনিক মানে শুধু হৈ হুল্লোড় ক’রে রান্না খাওয়া-দাওয়া নয়, থাকে বিনোদনের
নেপথ্যে অনেক অশালীনতা, আধুনিকতার দোহাই দেওয়া অসদাচরন। এর মানে এই নয় যে জেনারেশন গ্যাপকে মাথায় রেখে নবীন প্রজন্মের পিকনিক আমাদের
সময়ের থেকে খারাপ এই ধারণা পোষণ করছি।
তবে
মাঝে
মাঝে
ভাবি
মাত্র
অর্থ
শতকের
ব্যবধানে
আচার-ব্যবহারের
এতটা
গুণগত
পরিবর্তন
হয়ে
গেল।
এটা আদৌ কোন শুভ লক্ষণ কিনা এব্যাপারে মাঝে মাঝে সন্দিহান
হয়ে পড়ি।
আজ একটা জিনিস জানলাম যে Picnic শব্দটির উৎপত্তি ফরাসি শব্দ pique-nique থেকে
যেটি ১৬৯২ সালে টনি উইলিস’এর ‘ওরিজিনস দি লা ল্যাঙ্গু ফ্র্যানচেইস’ বইতে ব্যবহৃত হয়েছিল
যার অর্থ নিজেরা সঙ্গে ক’রে মদ নিয়ে রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে খাওয়া। জানিনা, এই কারনেই
আমাদের ছোটবেলার বনভোজন বা চড়ুইভাতির সঙ্গে আজকের পিকনিকের এত অমিল কিনা !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন