সামাজিক
মাধ্যম ও বাংলা ভাষা
অমরনাথ কর্মকার ২৫/১২/২০২১
আজকাল
কিছু শব্দ ইন্টারনেট ও
বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে বিশ্বময় বিপুল জনপ্রিয়। কিছুদিন আগে একটি সিংহলি
গান ‘মানিকে মাগে হিথে..’ ভাইরাল
হয়েছিল। অতি সম্প্রতি ভূবন
বাদ্যকারের ‘কাঁচা বাদাম’ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু বিষ্ময়ের ব্যাপার হ’ল ইংরেজি অভিধান
অনুযায়ী ‘ভাইরাল’ শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত
হওয়ার কথা এক্ষেত্রে তার
সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মূলত শাব্দিক
অর্থের পরিবর্তে এখানে ভাবার্থই প্রাধান্য পেয়েছে। বিশেষ্য ‘ভাইরাস’-এর গুণবাচক বিশেষণ
হিসাবে ‘ভাইরাল’ শব্দটির জনপ্রিয়তা। আবার আভিধানিক অর্থের
ভিত্তিতে, ভাইরাস যেহেতু অতি দ্রুত বিস্তার
লাভ করে তাই অতি
দ্রুত বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে কোন বিষয় অতি
দ্রুত ছড়িয়ে পড়া অর্থে ভাইরাল
শব্দের ব্যবহার আভিধানিক স্বীকৃতি পেতেই পারে – পার্থক্য একটাই, আভিধানিকভাবে এই ছড়িয়ে পড়া
একটি বিষক্রিয়া অর্থাৎ ক্ষতিকারক আর সামাজিক মাধ্যমে
এটি বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত । ২০১৭ সালে
গুগল, ইউটিউব, ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বা
খোঁজ করা শব্দগুলোর মধ্যে
ভাইরাল শব্দটি অন্যতম।
তবে সামাজিক মাধ্যমে
এই ‘ভাইরাল’ শব্দটির ব্যাপক ব্যবহারের একটা ইতিহাস আছে। ২০০০
সালের ৩১ জুলাই মার্কিন
লেখক সেথ গোডিন ‘ফাস্ট
কোম্পানি ডট কম’ নামক ওয়েব সাইটে ‘আনলিশিং
দ্য আইডিয়া ভাইরাস’শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন
যেখানে একটি লাইন ছিল
Have the Idea behind your online experience go viral… সেই থেকেই
‘ভাইরাল’ শব্দটির
ভাইরাল হওয়ার সূত্রপাত। আর এখন তো
গ্রামবাংলার মানুষও রানু মন্ডল বা
ভূবন বাদ্যকারের ‘ভাইরাল হওয়ার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। সেইসঙ্গে নেটদুনিয়ায় সর্বক্ষণ চলছে রাতারাতি ভাইরাল
হওয়ার ইদুরদৌড়। বিষয়ের ভালো-মন্দ এক্ষেত্রে
হয়ত মূল বিচার্য নয়,
কত বেশি সংখ্যক মানুষ
তার দর্শক সেটাই বিচার্য । এতে কেউ
হয়ত রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে উঠছেন আবার
কেউ বা হয়ে উঠছেন
খলনায়ক। ভূবন বাদ্যকারের ‘কাঁচা
বাদাম’
ভাইরাল হয়ে তিনি বিখ্যাত
হয়ে উঠেছেন রাতারাতি, আবার একদা ভাইরাল
হওয়া প্রশংসিত গায়িকা রানু মন্ডল পুনরায়
ভাইরাল হয়েছেন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের পাত্রী হিসাবে। সুতরাং এই ভাইরালিজমের ভালো,
মন্দ দুটো দিকই আছে।
‘ভাইরাল’-এর
মত আরোও অনেক শব্দ
সামাজিক মাধ্যমের বদান্যতায় বিশ্বময় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বলা যেতে পারে
ইন্টারনেট তথা বিভিন্ন সামাজিক
মাধ্যমের কারনে ভাষাবিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত
উন্মোচিত হয়েছে। অনেক দেশে এ
নিয়ে রীতিমত গবেষণা শুরু হয়েছে। ইউরোপের ভাষাবিজ্ঞানী
ও গবেষক ডেভিড ক্রিস্টাল ‘ইনটারনেট লিঙ্গুইস্টিক্স’(আন্তর্জালিক
ভাষাবিজ্ঞান) নামে নতুন এক
বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তিনি মনে করেন,
একাডেমিক শৃঙ্খলায় একটি নতুন বিষয়ের
সংযোজন করা খুব সহজ
নয়, কিন্তু ইন্টারনেটের
আবির্ভাব ভাষাকে এতটাই প্রভাবিত করেছে যে ইন্টারনেটের ভাষা
নিয়ে গবেষণা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই
সমস্ত ভাষার স্থায়ীত্ব সাময়িক, খুব কম সময়ের
ব্যবধানে এই ভাষা পরিবর্তিত
হচ্ছে, ।
সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে বাংলাভাষীদের মধ্যেও ভাষার পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক মাধ্যমের কিছু শব্দ আজকাল
বাংলাভাষীদের মধ্যে প্রায় মাতৃভাষার মতই উচ্চারিত হ’তে শোনা যায়। এমনকি
যারা ইংরেজী পড়তে পর্যন্ত পারে
না তাদের মুখেও এই সমস্ত শব্দ
স্বচ্ছন্দে উচ্চারণ করতে শোনা যায়।
আবার ফেসবুক, হোয়াটসআপ-এর দৌলতে বাংলা
ভাষাও বিকৃত হতে শুরু করেছে।
বাক্য বা শব্দগুচ্ছ একত্র
ও সংক্ষিপ্ত করার প্রবণতা এক
নাটকীয় মোড় নিতে শুরু
করেছে। আছে লেখা হচ্ছে
a6 কিংবা রাইট বোঝাতে লেখা
হচ্ছে r8. এছাড়াও বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিশিয়ে জগাখিচুরি মার্কা একটা বহুভাষিক পরিস্থিতি
তৈরি করারও প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ইদানিং
নেটিজেন শব্দটি বহুশ্রুত। সিটিজেন শব্দটা আজও যে তার
অস্তিত্ব বজায় রেখেছে সেটাই বিষ্ময়ের।
যে সামান্য সংখ্যক নাগরিক এখনোও অন্তর্জালে আবদ্ধ হননি তাদের সৌজন্যেই
বোধ হয় সিটিজেন শব্দটি
বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। অদূর
ভবিষ্যতে যখন একশ শতাংশ
মানুষই অন্তর্জালে বন্দি হবেন তখনই সিটিজেন
তার অস্তিত্ব হারিয়ে নির্ঘাত নেটিজেন-এ রুপান্তরিত
হবে।
মোদ্দা কথা, ইন্টারনেট সামাজিক
যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে চর্চিত ভাষা প্রমিত বাংলা
যেমন নয়, তেমনি আঞ্চলিক
বাংলাও নয়। এই মিশ্র
ভাষারীতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গন্ডি ছাড়িয়ে আমাদের বাস্তব জীবনের ভাষা ব্যবহারকে বদলে
দিচ্ছে ধীরে ধীরে। সামাজিক
যোগাযোগের মাধ্যমে ভাষার এই পরিবর্তনে বদলে
যাচ্ছে বাংলা ভাষা। আবির্ভাব ঘটছে এক মিশ্র
প্রকৃতির ভাষারীতি।
সামাজিক মাধ্যমকে কেন্দ্র ক’রে বাংলা
ভাষার এই বিকৃতি বাংলা
ভাষা আর বাংলাভাষীদের পক্ষে
কতটা গ্রহণযোগ্য তা বিবেচনার বিষয়।
সামাজিক মাধ্যমের সৌজন্যে কিছু ইংরেজি বা
বিদেশী শব্দ
বা শব্দগুচ্ছ বিশ্বময় জনপ্রিয় হচ্ছে কিন্তু যদি বাংলা শব্দ
বা শব্দগুচ্ছও একইভাবে বিশ্ব ময় গ্রহণীয় হয়ে
উঠত তাহলেই বোধ হয় বাংলা
ভাষার সম্মান বাড়ত । কারন
বাংলা ভাষার উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে এই ভাষার আন্তর্জাতিকিকরণ
অনেকটাই ভূমিকা রাখে।
ইন্টারনেট এখন যোগাযোগের অপরিহার্য
ও শক্তিশালী মাধ্যম। আজ আর ইন্টারনেটের
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ব্যবহার বিনোদনের গন্ডিতে আবদ্ধ নেই, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিতর্ক, জনমত তৈরি, দাবি
আদায়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেও এখন ব্যাপকভাবে ভূমিকা
রাখছে এটি। সামাজিক যোগাযোগের
মাধ্যমের প্রভাবে পালটাতে শুরু করেছে আমাদের
সামগ্রিক জীবনযাত্রা। ফেসবুক, ব্লগ প্রভৃতিতে চলছে
বাংলা ভাষায় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা। ইন্টারনেটে একদিকে
যেমন বাংলার বিকৃত ব্যবহার বাড়ছে অন্যদিকে প্রমিত ও শুদ্ধ বাংলার
ব্যবহারও রয়েছে। এভাবেই ভালো-মন্দে সারা
বিশ্বে ছড়িয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেটের বাংলা ভাষা।
ভাষা ব্যবহারে তাই
আমাদের সবারই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ভাষার
নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে,
একটা ঐতিহ্য আছে। সুতরাং ভাষাকে
বিকৃত করতে গিয়ে কোনভাবেই
ভাষা যেন তার নিজস্ব
ঐতিহ্য না হারায়, ভাষা
কালিমালিপ্ত না হয়। বাংলা ভাষার বিশ্বজনীনতা কিন্তু এসেছে অনেক সংগ্রাম,
রক্তক্ষয় আর বলীদানের মধ্যে দিয়ে। সুতরাং প্রতিটি বাংলাভাষীর উচিৎ বাংলা ভাষার যে কোন
ঐতিহ্যহরণকারী বিকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন