রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২১

শিশুশ্রম – আজকের প্রাসঙ্গিকতা

 

শিশুশ্রম – আজকের প্রাসঙ্গিকতা

– অমরনাথ কর্মকার ২৮/১১/২০২১

শিশুশ্রম বিষয়টির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে এই মুহূর্তে উদ্বেগের কারন ' প্রায় বছরের দীর্ঘ লকডাউনের পরে হঠাৎ স্কুল খোলার নির্দেশনামা জারি হয়েছে। ইতিমধ্যে গত ১৬ নভেম্বর, ২০২১ থেকে এই রাজ্যে স্কুল-কলেজেও সরকারী নির্দেশনামা মেনে ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে। স্কুল-কলেজ খোলার পরে পড়ুয়াদের উপস্থিতির অস্বাভাবিক নিম্নমুখী হারে শিক্ষা মহলে যথেষ্ট উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। স্কুল  বা কলেজ কর্তৃপক্ষ যদি পড়ুয়াদের অনুপস্থিতির কারন শুধুই করোনার ভীতি 'লে ধরে থাকেন তবে বোধ হয় ভুল ভাবা হবে। এই দুই বছরে বহু পরিবার কাজ না থাকার কারনে দারিদ্রের অন্ধকারে হাবুডুবু খেয়ে বেঁচে আছে। স্বভাবতই অনেক দরিদ্র বাড়ির স্কুলপড়ুয়া ছেলে বা মেয়েটি পরিবারের আর্থিক চাহিদা মেটাতে অর্থোপার্জনের কাজে নিয়োজিত হয়ে গেছে না, শহুরে স্বচ্ছল পরিবারের পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে এই কারনের যে কোন ভিত্তি নেই, তা বলাই বাহুল্য। গ্রামের দারিদ্র পীড়িত পরিবারগুলো থেকে এক বিপুল সংখ্যক পড়ুয়া এই কারনে স্কুল বা কলেজ ছেড়েছে। স্কুল-কলেজ ছাড়ার এটা মুখ্য কারন হলেও এর পেছনে কিছু মানসিক কারনও রয়েছে।

ওয়েস্টবেঙ্গল রাইট টু এডুকেশন ফোরাম এবং ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট চাইল্ড লেবার নামে দুটি সংস্থার  একটি সমীক্ষায় জানা গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইনে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে মাত্র ২৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। ছাড়া শ্রমজীবী পরিবারগুলোর আয় কমে যাওয়ায় ১৭ শতাংশ শিশুর দুই বেলা নিয়মিত খাবার জোটেনি। করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে আশঙ্কাজনক হারে শিশুশ্রম বেড়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির হার ৯৪. শতাংশ। মেয়েদের ক্ষেত্রে হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৩ শতাংশে। এতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ঘোষিত লকডাউনে অনেক শ্রমজীবী পরিবারের শিশুরা অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারেনি। স্কুল বন্ধ থাকায় জীবিকার জন্য তারা ইটভাটা পাথর ভাঙার মতো বিভিন্ন কাজে যোগ দিয়েছে। সংস্থা দুটি মে জুন মাসে শিশুদের শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্যের ১৯টি জেলার প্রায় দুই হাজার শিশুর ওপর এই জরিপ চালিয়েছে। মহামারির সংকটের সময় ১১ শতাংশ শিশু শিক্ষার্থী ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা পায়নি বলেও উঠে এসেছে জরিপে।

সংবিধানের শিশু শ্রম (রোধ নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৮৬-এর ২৪ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা রয়েছে, “১৪ বছরের নীচে কোনও শিশুকে কোনও কারখানা, খনি বা কোনও বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত করা যাবে না।১৯৮৬ সালে তৈরি হওয়া শিশু শ্রম (রোধ নিয়ন্ত্রণ) আইন আইন বলে, ১৪ বছর পূর্ণ হয়নি এমন ব্যক্তিদের শিশু বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

শিশুদেরকে শিশুশ্রমে নিয়োগ করে কার্যত তাদের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে৷ কেননা অল্প বয়সে কাজ করতে গিয়ে তারা লেখাপড়ার সুযোগ হারাচ্ছে, মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে৷ আর শিশুদের বৃদ্ধির যে স্বাভাবিক পন্থা, সেই পন্থা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে৷ তারা এমন সব কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে যেগুলো তাদের বয়সে করার কথা স্বাভাবিক অবস্থায় ভাবাই যায় না৷   

তাহলে অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে শিশুশ্রমে নিয়োজিত পড়ুয়াদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য করণীয় কি? প্রথমেই যেটা প্রয়োজন সেটা শিশুশ্রম বিরোধী আইনের যথাযথ এবং কঠোর প্রয়োগ এখানে সরকারের দায়িত্ব অনেক৷ সরকারকে শিশুশ্রম বন্ধ করে সেসব শিশুকে লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি রে দেওয়া, তাদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে, বিনিয়োগ করতে হবে৷ প্রয়োজনে শিশুদের উপর নির্ভরশীলদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে৷ এক্ষেত্রে সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সহায়তা নেয়া যেতে পারে৷ মনে রাখতে হবে, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ

বিশ্বজুড়ে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ২০২০ সালের ১৬ কোটি অতিক্রম করেছে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চার বছরে তালিকায় যোগ হয়েছে ৮৪ লাখ নতুন নাম, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। আগামী দুই বছরে আরও কোটি শিশুশ্রমিক বাড়তে পারে। জাতিসংঘের নতুন এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।     চাইল্ড লেবার: গ্লোবাল এস্টিমেটস ২০২০, ট্রেন্ডস অ্যান্ড দ্য রোড ফরোয়ার্ড শীর্ষক প্রতিবেদনটি যৌথভাবে প্রকাশ করে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।

জাতিসংঘ বলছে, করোনাভাইরাস মহামারি লকডাউনের প্রভাবে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট গত এক বছরে আরও কোটিখানেক শিশুকে ঠেলে দিয়েছে একই দুর্ভাগ্যের দিকে। ইউনিসেফের প্রধান হেনরিয়েত্তা ফোর বলেন, শিশুশ্রম বন্ধের লড়াইয়ে আমরা হারতে বসেছি। করোনাভাইরাস মহামারি আমাদের অনেক পেছনে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্বময় লকডাউন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, অচল অর্থনীতি জাতীয় বাজেট সংকোচনের দ্বিতীয় বছর চলছে। পরিস্থিতিতে অনেক পরিবারকে বাধ্য হয়ে সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করে কাজে পাঠানোর কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।

এই সমস্ত পরিসংখ্যান থেকে পরিস্থিতির আভাস মিললেও পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়। এই পরিসংখ্যান  সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানে তৎপর হওয়ার জন্য অত্যন্ত জরুরী।

স্পষ্টতই বিপুল সংখ্যক পড়ুয়ার চিরতরে স্কুল থেকে বিদায় নেওয়ার কারন মূলত মানুষের দারিদ্র।

এছাড়াও রয়েছে পড়ুয়াদের মানসিক অবসাদজনিত আপাত গুরুত্বহীন সমস্যা। দীর্ঘ দুবছরের গৃহবন্দী দশায় পড়ুয়াদের মনে এসেছে নানান মানসিক পরিবর্তন। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, দীর্ঘ সময় স্কুলের বাইরে থাকার কারণে অনেক স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যেই আচরণগত পরিবর্তন এসেছে। তাঁরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি একদিকে যেমন তাদের সঠিক মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অনভ্যস্ত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে। পড়ুয়াদের স্কুল ত্যাগের পেছনে তাদের এই মানসিক পরিবর্তনের এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। এর জন্য তাদের মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন আছে। অধিকাংশ অভিভাবকই এই সমস্যাকে গুরুত্ব দেন না অশিক্ষা এবং অসেচতনতার কারনে। সে ক্ষেত্রে সরকারকেই সমস্ত দায়িত্ব নিতে হবে প্রতিটি পড়ুয়ার মানসিক স্বাস্থ্যের পরীক্ষা করা এবং মানসিক অসুস্থতার প্রতিকার করার ব্যবস্থা করা এবং অবশ্যই বিনামূল্যে। সুতরাং করোনা অতিমারী পড়ুয়াদের যে কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে তার থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য সরকারী উদ্যোগ সহ সমাজের সর্বস্তর থেকে কোমর বেঁধে লেগে পড়তে হবে।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?