বুধবার, ১৯ জুলাই, ২০১৭

আমার বিদায় সম্বর্ধনা ১৮/০৭/২০১৭

আজ আমার পুরোনো অফিসে আমাকে বিদায় সম্বর্ধনা দেওয়া হ'ল। প্রায় দেড় বছর পর এমন আমন্ত্রণ পেয়ে খুব পুলকিত হয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম সুন্দর আয়োজন। তার চেয়েও বেশি উচ্ছ্বসিত বোধ করলাম পুরোনো সহকর্মীদের দেখে যারা আমার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের 'দাগ' রম্যরচনার কথা মনে পড়ছিল খুব। সেই এক ভাড়াটে দীর্ঘ দিন ভাড়া থাকার পর বাড়ি ছেড়েছেন, কিন্তু মেঝে থেকে খাটের পায়ার চারটে দাগ প্রায় চিরস্থায়ী হয়ে জেঁকে বসেছে, সেই দাগ তোলা যাচ্ছে না কিছুতেই। অনুষ্ঠানে অনেকেই স্মৃতিচারণা করলেন। দেখলাম প্রায় সকলের মনেই আমার স্মৃতিগুলো অম্লান হয়ে আছে। সঞ্জয়ের স্মৃতিচারণায় আমার আপাত গুরুত্বহীন অথচ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতিগুলো উঠে এল অবলীলায়। এরকম অনুষ্ঠানে বিদায়ীদের বিশেষ বিশেষ গুনের পরিচয় তুলে ধরার স্বভাবসিদ্ধ প্রবনতার ব্যতিক্রম এখানেও ছিল না। এসবে আমার মন ছিল না। চোখ পড়ে ছিল পেছনের চেয়ারে বসা শত অনুরোধেও কিছু বলতে রাজী না হওয়া লক্ষ্মণ সিং-এর দিকে। তার মুখে সেই অনুষ্ঠান চলা কালে কোন আবেগের চিহ্ন মাত্র দেখিনি। আমার স্মৃতিচারণায় যখন লক্ষ্মণ সিং (সিংজী বলতেই আমরা অভ্যস্ত ছিলাম)-এর নাম বারবার উঠে আসছিল তখনও তার মধ্যে বিন্দুমাত্র আবেগ প্রবণতা লক্ষ্য করিনি। অফিসের নিয়মানুগ কাজের বাইরে আমার যে নিজস্ব একটা বিচরনক্ষেত্র আছে, দেখলাম সে খবর অনেকেই রাখেন এবং দেখেনও। বিভিন্ন জনের স্মৃতিচারণায় এই কথাগুলো যখন উঠে এল, তখন মনে হ'ল যাক সরকারী কাজের গতানুগতিকতা ছাড়াও সরকারী অফিসের অনেকেই অনেক খবর রাখে। আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে অস্থায়ী বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চ'লে গেলেও অন্তত স্থায়ী একটা দাগ রেখে যেতে পেরেছি। হাজার মোছামুছি করেও দাগটা তোলা যে সহজ হবে না সেটা নিশ্চিত হলাম অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে। নির্জনে লক্ষণ সিং আমার পাশে এসে দাঁড়াতেই মুহূর্তে পালটে গেল তার মুখচ্ছবি। আচমকা মেঘ নেমে এল মুখে এবং সেই মেঘ থেকে ............... বাড়ি ফিরে এলাম বৃষ্টিতে ভিজে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম স্মৃতির কোন ওজন হয় না। তাই অনায়াসেই তা বয়ে চলা যায়। সত্যিই পারব তো ?
কথাগুলো লিখতে গিয়ে আমার আগে লেখা (ছাপার অক্ষরেও বেরিয়েছিল একদা) স্কুলের স্মৃতি মনে পড়ল।
সমীরণবাবুঃ অ.না.ক.
ক্লাসে মাস্টারমশাইয়ের রক্তচক্ষু, বেত্রাঘাত, দু’আঙুলের মধ্যে পেন্সিল ঢুকিয়ে চাপ দেওয়া, দু’হাতে থান ইট চাপিয়ে নিল ডাউন বা বিভিন্ন ধরণের কষ্টকর শাস্তির ভয়ে ত্রস্ত হওয়ার প্রবণতা ছাত্রদের মধ্যে থাকেই । আবার এসব উপেক্ষা করে উল্টে মাস্টারমশাইদের বিড়ম্বনার কারণ হওয়া ডানপিটে ছাত্রের সংখ্যাও কম নয় । যেমন আমাদের ক্লাসের পার্থ আর অসীম বেত্রাঘাতে নিপুন কার্ত্তিক স্যারকে আড়াল থেকে বিকৃত স্বরে ‘ট্যারা কার্ত্তিক’ ব’লে পালিয়ে যেত প্রায়ই । স্যার ধরতেও পারতেন না । তবে আমাদের ইংরেজি স্যার সমীরণ বাবু ছিলেন ছিলেন সত্যিকারের কড়া, যদিও শেষ পর্যন্ত তাঁকেও পার্থদের কাছে হার মানতে হয়েছিল । একসময় আমাদের কাছে তো বটেই, অন্যান্য মাস্টারমশাইদের কাছেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক মজার চরিত্র ।
সমীরণ বাবু একসময় ছিলেন প্রেসিডেন্সির ইংরেজির কৃতি ছাত্র । ফর্সা, লম্বা চেহারা । মুখে সর্বদা পাইপ । কোট-টাই পড়া একদম সাহেবদের মত ফিটফাট চেহারা । একটা ইংরেজি কবিতা শেষ করতে তাঁর লেগে যেত মাসখানেক । স্বভাবতই সিলেবাস শেষ হ’ত না । কবির জীবনী শেষ করতে প্রায় মাস কাবার । পড়াতে পড়াতে প্রসঙ্গক্রমে নিজেই গান গাইতেন (তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ভালো গাইতে জানতেন), অভিনয় করতেন । এহেন সমীরণ স্যারের ক্লাসে দেখা যেত ৮০ শতাংশ ছাত্র উধাও । না, পড়া না পারার ভয়ে নয়, এমনকি শাস্তি পাবার ভয়েও নয় – কারণ তাঁর পড়ানোর ধরণ হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র ভালো ছাত্রের কাছে ভালো লাগত, বাকীরা বিন্দুমাত্র আনন্দ পেত না । তাঁর পড়ানো শুরু হওয়া মাত্র বিরক্ত ছাত্রদের মধ্যে শুরু হ’ত চঞ্চলতা । সামান্য অসহিষ্ণুতাও সমীরণবাবু সহ্য করতে পারতেন না, কারোও মধ্যে অমনোযোগিতা দেখলেই দুগালে বসাতেন টেনে থাপ্পর । পার্থ বসত একদম শেষ বেঞ্চে ঠিক দরজার পাশে । স্যার পড়ানো শুরু করার পর স্যারের অলক্ষ্যে পার্থ প্রায়ই বেরিয়ে যেত ক্লাস থেকে । একদিন স্যারের নজরে পড়ে গেল । পার্থ বেরিয়েছে – স্যারও বেরিয়ে পার্থকে হাতেনাতে ধরার উদ্যোগ নিচ্ছেন । বুঝতে পেরে পার্থ দোতলার বারান্দা দিয়ে দৌড় লাগাল । নাছোড়বান্দা স্যারও শুরু করলেন ওর পেছন পেছন দৌড় । দোতলা থেকে একতলা – স্যারও সমানে দৌড়ে চলেছেন । স্যারকে নিরস্ত করার জন্য অফিসরুম থেকে অন্যান্য স্যারেরাও ছুটে এলেন । কোনরকমে তাঁকে শান্ত করা হ’ল । ততক্ষণে পার্থ কিন্তু পগার পার । ফর্সা টুকটুকে সমীরণবাবুর মুখ তখন রাগে লাল । হেডস্যারের কাছে নালিশ হ’ল । পরদিন হাতে পায়ে ধরে পার্থর শাস্তি লাঘব হ’ল । এরপর থেকে ক্লাসে বসে প্রায়ই আমরা শুনতে পেতাম দুপদাপ শব্দ । দেখা যেত অনেকেই সমীরণবাবুকে উত্তক্ত করার ক্ষেত্রে পার্থর অনুসারী হয়ে উঠেছে । সমীরণবাবু দৌড়চ্ছেন আর তাঁর সামনে দৌড়চ্ছে অন্য কোন ছাত্র । এ দৃশ্য হামেসাই চোখে পড়ত ।
তবে সমীরণবাবুর পড়াশোনার পরিধি ছিল তুলনাতীত । ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর জ্ঞান ছিল অপরিসীম । হয়ত আমাদের মত সাধারণ মানের ছাত্রদের পক্ষে তা হজম করা কঠিন ছিল বলেই তাঁকে নিয়ে মজা করেছি । কিন্তু এখন বুঝতে পারি তিনি কি বিরাট মাপের মানুষ ছিলেন ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?