পুজোয় মন খারাপঃ ষষ্ঠী ১৯/১০/২০১৫
গত বছরে পুজোয় মন খারাপের কথা লিখেছিলাম । এবছরেও ইতিমধ্যেই একরাশ মনখারাপ জমা
হয়ে গেছে । উৎসবের জীবন শুরু হয়ে গেছে । কিন্তু জীবনের উৎসবে যেখানে রঙিন আলোর
ঝলকানি নেই সেই অন্ধকার জায়গাগুলোর দিকেই আমার চোখ চলে যায়, আর তখনই আনন্দঘন
পারিপার্শ্বিকতার মধ্যেও মন খারাপ হয়ে যায় । আবার অদ্ভুতভাবে কর্মক্ষেত্রের
চাপমুক্ত উৎসবমুখর এই অবসরের দিনগুলিতে হারানো অতীতের নস্টালজিয়া অতর্কিতে হানা
দেয় এবং বিস্ময়করভাবে সেগুলোর বেশীরভাগই অনুভূতির মূলে আঘাতহানা । মন খারাপ
পঞ্চমীর রাতে । বাড়িতে বিকেলের পর থেকেই দেখলাম স্ত্রীর মুখ গোমড়া । কারণ জিজ্ঞেস
করাতে ঠিক উওর মিলল না । আজ ঠাকুর দেখতে যাওয়ার আগাম কোন পরিকল্পনা ছিলনা । তাই
বাড়ী থেকে বেরনোর কোন তারাও ছিলনা । অতএব, ঘরে বসে টিভি’র পর্দায় চোখ রেখে সবার
সঙ্গে গল্প-গুজবে মত্ত ছিলাম । কিন্তু স্ত্রীর নীরবতা কেমন যেন বেমানান লাগছিল ।
তাই বাধ্য হয়েই জিজ্ঞেস করলাম কারন । অনেক পরে জানতে পারলাম এবার পুজোতে ছেলের
অনেকগুলো জামাপ্যান্ট হয়েছে বটে কিন্তু আমার তরফ থেকে কেনা হয়নি । আমি যে জানতাম
না তা কিন্তু নয়, ভেবেছিলাম আত্মীয়-স্বজন প্রায় সকলকেই পুজোর উপহার কিনে দিয়ে মাঝ-মাসেই
হাত প্রায় শূন্য । ছেলেরও অনেক প্রাপ্তি ঘটেছে । সুতরাং আমারটা না দিলেই বা ক্ষতি
কি ? কিন্তু ব্যাপারটা যে এতটা সংবেদনশীল হয়ে উঠবে বুঝতে পারিনি । অগত্যা
অর্থকষ্টকে সহাস্যবদনের অন্তরালে রেখে নতুন জামা কিনে এনে দিলাম ছেলের জন্য ।
স্ত্রীর মুখের আষাঢ়ে মেঘ কেটে গিয়ে চকিতে দেখা দিল রৌদ্র করোজ্জ্বল দিনের আভাস ।
আমার কিন্তু মনখারাপের বিন্দুমাত্র উপশম হ’ল না । ছেলের জামাটা কিনতে গিয়ে মোড়ের
মাথায় মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, একটা ১০-১২ বছরের ছেলে ছুটে এসে পয়সা
চাইল, দশটি টাকা দিয়েও দিলাম । ইচ্ছের বিরুদ্ধেই দিলাম । আমি সাধারণত ভিখারিকে
পয়সা দিই না । পুজোর বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই লক্ষ্য করি ট্রেনে বাসে রাস্তায়
ভিখারির সংখ্যা বেড়ে যায় । কেউ মেয়ের বিয়ে, কেউ একমাত্র সন্তানের ক্যান্সারের
চিকিৎসা, কেউ বা বিকলাঙ্গতার কারণ শুনিয়ে ভিক্ষা চায় । ইতিপূর্বে জেনেছি, এমনকি স্বচক্ষে
দেখেছিও, ট্রেনের কামরায় যে মহিলা ছেলের ডায়ালিসিসের জন্য ভিক্ষা চায়, তার ছেলেটির
কোন রোগই আদতে নেই । ট্রেনের কামড়ায় অন্ধ সেজে লাঠি হাতে ভিক্ষা চাওয়া লোকটাকে
দিব্যি স্বাভাবিক ভাবে হাঁটা-চলা করতে দেখেছি রাস্তায় । এদের মধ্যে নিশ্চয়ই কেউ
কেউ আছেন সত্যিই যাদের অর্থ উপার্জনের ক্ষমতা নেই । সত্য আর মিথ্যার মিশ্রিত ভিড়ে
সত্যকে সনাক্তকরণের বৃথা চেষ্টায় না গিয়ে ভিক্ষা দেওয়াটাই বন্ধ করে দিয়েছি । তাই
ছেলেটার হাতে ১০টি টাঁকা দেওয়ার পরে মনে মনে বেশ একটা দ্বন্দ্ব অনুভব করছিলাম ।
এমনিতেই পুজোর আগে মনখারাপ, তারওপর সেই মাত্রাটা বেড়ে গেল । আজ ষষ্ঠী । এবার পুজোয়
নিজের জন্য কিছু কিনিনি । কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্ত্রি-পুত্রের জোর-জবরদস্তিতে একটা
জামা কিনতেই হ’ল । স্ত্রীর বায়নামত সকালে স্নান সেরে আলমারি খুলে নতুন জামাটা বের
করতে গিয়ে আলমারির কোনে অতি সযত্নে তুলে রাখা একটা পুরনো জামা চোখে পড়তেই মনটা
খারাপ হ’ল – ছোট বেলার একটা স্মৃতি চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল – বোধহয় চোখের
কোনে দু’এক ফোঁটা জলও এসে গিয়েছিল । আমাদের স্কুলের গেটে রামকাকু বসতেন ঝালমুড়ি
নিয়ে । টিফিন হলেই রামকাকুর ঝালমুড়ি খাওয়া ছিল আমার নিত্যদিনের কাজ । আজপর্যন্ত
অনেক ঝালমুড়ি খেয়েছি, কিন্তু রামকাকুর ঝালমুড়ির স্বাদ ছিল একদমই অন্য রকম – আজও সে
স্বাদ ভুলতে পারিনা । একদিন রামকাকুকে কৌতূহলবশে জিজ্ঞেস করেছিলাম –কাকু, তুমি
ঝালমুড়িতে কি কি দাও গো ? এতো টেস্টফুল হয় কি ক’রে ? স্বভাবগতভাবে স্বল্পভাষী
রামকাকু মুচকি হেসে বলেছিলেন ‘এমন কিছু না’ । রামকাকু আমাকে কেন জানিনা খুব
ভালবাসতেন । একদিন আমাকে না দেখতে পেলে বন্ধুদের কাছে খবর নিতেন । আমার মনে আছে,
একবার আমার খুব জ্বর হয়েছিল । প্রায় সপ্তাহখানেক স্কুলে যেতে পারিনি । বাড়িতে
শুয়েই দিন কাটছে । একদিন বিকেল বেলা হঠাৎ দেখি রামকাকু বাড়ী ফেরার পথে তার মালপত্র
সমেত আমাদের বাড়িতে এসে হাজির । মা-বাবার কাছে আমার খবর নিয়ে, আমার সঙ্গে দেখা
করে, মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন । সঙ্গে ছিল রামকাকুর একমাত্র ছেলেটা । সেই থেকে
শুরু । আমার বাবা প্রতি বছর পুজোর সময় রামকাকুর ছেলের জন্য জামাপ্যান্ট পাঠাতেন ।
মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার পর থেকে স্কুলে যাওয়া প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল ।
স্বভাবতই রামকাকুর ঝালমুড়ি খাওয়া বন্ধ । কিন্তু রামকাকুর স্মৃতি থেকে আমি এতটুকুও
ম্লান হলাম না । মাঝে মাঝেই ছেলেকে দিয়ে রামকাকু আমার জন্য ঝালমুড়ি পাঠিয়ে দিতেন ।
অনেক চেষ্টা করেও পয়সা নিতে রাজী করাতে পারিনি । রামকাকু গরীব হলেও তার আন্তরিকতা আর
ভালোবাসা নিয়ে বাবা আমাকে অনেক কিছু বলেছেন । বাবাও রামকাকুকে খুব ভালবাসতেন ।
মাধ্যমিকে ভালো ফল করে আমি কলকাতায় চলে এসেছি । কলকাতার এক নামী স্কুলে একাদশ
শ্রেণিতে ভরতি হলাম । সেখানেও স্কুলের গেটে ঝালমুড়ি আলুকাবলি নিয়ে বসতেন একজন ।
কিন্তু তার ঝালমুড়ি খেলেই রামকাকুর কথা মনে হ’ত । বড্ড মিস করতাম রামকাকুকে । সেবার
পুজোয় বাড়ী গিয়ে দেখলাম বাবা আমার জন্য বেশ দামী জামাপ্যান্ট কিনেছেন । তাছাড়া
মাধ্যমিকে ভালো ফল করার সুবাদে অনেক উপহার এসেছে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ।
রাত্রে মা আলমারি থেকে বের করে একে একে সব দেখাতে লাগলেন । মনে মনে খুব আনন্দ
পাচ্ছিলাম । দেখানো প্রায় শেষ । ওঘর থেকে বাবা এলেন একটা প্যাকেট হাতে ।
প্যাকেটখানা খুলে দেখলাম খুব কমদামী একটা জামা । পছন্দ না হওয়ায় কোন মন্তব্য না
করে রেখে দিলাম । এবার বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে দিয়েছে জানিস ?’ আমার কাকার যথেষ্ট
অর্থ থাকলেও বরাবরই ভীষণ কৃপণ প্রকৃতির মানুষ । তাই ভাবলাম নিশ্চয় এটা আমার কাকার
দেওয়া । বাবা এবার প্রায় উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন ‘তোর রামকাকু পাঠিয়েছে’। আমি
নির্বাক । চশমার মোটা কাচের ভেতর দিয়ে বাবার চকচকে চোখের কোনে মুক্তোর মত জল
স্পষ্ট চোখে পড়ল ।
এতো বছর ধ’রে রামকাকুর দেওয়া সেই জামা সযত্নে রক্ষা করে চলেছি । আজ আলমারি
খুলে নতুন জামা বের করতে গিয়ে যে জামাটা আবিষ্কার করলাম, মনে হ’ল উপহার যদি
সত্যিকারের ভালোবাসার স্মারক হয়, তবে রামকাকুর দেওয়া জামাটাই আমার জীবনের একমাত্র
উপহার । রামকাকুর কথা মনে করে ষষ্ঠীতে মনখারাপ হল । কে জানে রামকাকু আজ বেঁচে আছেন
কি না ! তবে শুনেছি ওনার ছেলেটা আজ প্রতিষ্ঠিত । বাবার সঙ্গে নাকি মাঝে মাঝে কথা
হয় ।
আজ ষষ্ঠীতে মন খারাপ । জানিনা কাল আবার কোন মনখারাপ এসে হাজির হবে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন