শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

পোলবা পুলকার দুর্ঘটনায় নিহত ছোট্ট ঋষভের উদ্দেশে



পুলকার দুর্ঘটনায় ছোট্ট ঋষভের মর্মান্তিক মৃত্যুর শোকস্তব্ধতায় ঋষভের পরিবার-পরিজনদের উদ্দেশে আমার এই ছোট্ট কবিতা

হারায়নি যাঃ অ. না.ক. ২২/০২/২০২০

আমরা বেঁচে আছি আশায়-ভালোবাসায়,
তাই হারানোর যন্ত্রণা বেশি টের পাই।
হৃদয়ে হৃদয় জুড়ে থাকার সুখ জানা,
তাই হৃদয় ভাঙলে অশ্রু মানে না মানা।
চেতনা, পার্থিব যন্ত্রণার ঊর্ধে নিশ্চয়,
একদিন মিলবে হারানো খন্ড হৃদয়।
সেদিন দুচোখে থাকবে আনন্দের ধারা,
হারায়নি যা তার খোঁজে কেন দিশেহারা?

বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

বাংলা ভাষার বিশ্বজয়


বাংলা ভাষায় বিশ্বজয়
অমরনাথ কর্মকার

মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে বাঙালী জনগোষ্ঠীর আন্দোলনের সূত্রপাত বেশ প্রাচীন। মানভূমের বাঙালীরা ১৯১২ সালে উপমহাদেশে প্রথম বাংলা ভাষা আন্দোলন শুরু করেন। সেই অনুপ্রেরণা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে আসাম থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে। তারপর সেই ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে উত্তাল তরঙ্গের আকার ধারণ করল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকার রাজপথে সালাম, জব্বার, বরকতের রক্তের বিনিময়ে বাঙালীর মাতৃভাষা কিভাবে সজীবতা পেল সে ইতিহাস তো সকলেরই জানা। ‘অমর একুশে’ বিশ্ববন্দিত হয়ে বাংলাদেশ বাংলা ভাষাকে সরকারী ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে বাঙালীর ভাষার স্বাধীনতার পতাকা সগর্বে প্রতিষ্ঠা করল। আজ যখন প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারী দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবস’ হিসাবে বিশ্বময় পালিত হয়, তখন বাঙালী হিসাবে আমাদের বুক গর্বে ভ’রে ওঠে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একটা প্রশ্ন বারংবার উঠে আসে – আমরা বাঙালীরা কি অন্তরের গভীর ভালোবাসা দিয়ে বাংলা ভাষাকে আঁকড়ে ধ’রে রাখতে  পারছি ?
বিশ্বে যেখানেই যান বাঙালীর পরিচিতি প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান মাধ্যম তাঁর মুখোচ্চারিত বাংলা ভাষা। শতাব্দী প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য ভারতীয় তথা বিশ্ব সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। দু-দুটো দেশের জাতীয় সঙ্গীতের ভাষা বাংলা। ভাষার জন্য বাঙালীর বিরল আত্মত্যাগ বিশ্বে বেনজির। অথচ বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক প্রবণতা বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে এক বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে।
ইংরেজি ‘Z’ এর প্রতিবর্ণ বাংলা ভাষায় অনুপস্থিত ব’লে সম্প্রতি ‘জ্৳’ দিয়ে ‘Z’ এর পরিপূরক বাংলা বর্ণ তৈরি হয়েছে। কই ইংরেজি বর্ণমালাতেও ‘ত’-এর প্রতিবর্ণ নেই। কখনোও কি ‘ত’-এর প্রতিবর্ণ সৃষ্টির জন্য ইংরেজদের কখনোও তৎপর হ’তে দেখেছেন ? অনুকরণপ্রিয় হিসাবে এমনিতেই বাঙালীর বদনাম আছে। ভাঙা বাংলায় উচ্চারণ, হিন্দি ইংরেজি মিশিয়ে বাংলা ভাষাকে একটি শংকর ভাষা বানিয়ে মাতৃভাষার মৌলিক্বত্ব বিনাশের কেমন যেন একটা মরিয়া প্রবণতা একশ্রেণির বাঙালীর মধ্যে ইদানিং খুব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বরং বাস্তবটা যদি বিপরীত হ’ত তাহলে বাংলা ভাষার অস্তিত্বের সংকট নিয়ে শঙ্কা হ’ত না। আমরা আগ বাড়িয়ে হিন্দিভাষীর সঙ্গে হিন্দি, ইংরেজিভাষীর সঙ্গে ইংরেজি বলার চেষ্টা করি – তাঁদেরকে কখনোই বাংলা বলানোর উদ্যোগ গ্রহণ করি না। উচ্চশিক্ষার জন্য ইংরেজি বই ছাড়া গত্যন্তর নেই এই বিশ্বাসে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলা ভাষায় বই লেখার চেষ্টা হয় না। অথচ দেখুন জাপানী-ফরাসিরা উচ্চশিক্ষার জন্য এই আক্ষেপ করে না। এমনকি বাংলাদেশেও সেই চেষ্টা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বলতে বাধা নেই বঙ্কিম-বিভুতিভূষনরা ক্রমশ অপাংক্তেয় হতে শুরু করেছে।
খুব সহজ ক’রে বললে বলতে হয় বাংলা ভাষার ওপর হিন্দি আর ইংরেজি ভাষার সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে যেন। না, এই সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য হিন্দি বা ইংরেজি ভাষাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বরং আমরা নিজেরাই বোধ হয় আমাদের মাতৃভাষার ওপর এই ভাষাসন্ত্রাস জারী করার ব্যাপারে আত্মঘাতি – আমাদের অপরিনামদর্শী অনুকরণপ্রিয়তার কারনেই বাংলা ভাষা ক্রমশ তাঁর স্বকীয়তা হারাচ্ছে। একদা ইংরেজ ঔপনিবেশিকতা প্রশাসনিক কাজে ইংরেজির ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করেছিল। যদিও সর্বত্র তা সার্থকতা পায়নি। স্বাধীন ভারতে প্রশাসনিক কাজে প্রাদেশিক ভাষা ব্যবহারের প্রচলন শুরু হলে বঙ্গের বাঙালীরা প্রশাসনিক কাজে বাংলা ব্যবহারের স্বাধীনতা পেয়েছে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের সরকারী ভাষা এখন বাংলা। সরকারী কাজে বাংলা ব্যবহারে কোন বাধা নেই অথচ আমাদের মধ্যে সার্বিকভাবে বাংলার চেয়ে ইংরেজি ব্যবহারের প্রবনতা রয়েই গেছে। বাংলায় অনেক ইংরেজি শব্দের প্রতিশব্দের অভাবকে দোষ দিতেও আমরা অভ্যস্ত। এখন ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ আদৌ অপ্রতুল নয়। আসলে আমাদের চেষ্টা নেই – সগর্বে বাঙালীত্ব প্রকাশের তীক্ষ্ণ হাতিয়ার হিসাবে বাংলা ব্যবহারের মানসিকতা এখনোও সেভাবে তৈরি হয়নি। ধরেই নেওয়া হয় বাংলা ভাষার প্রয়োজন সীমাবদ্ধ শুধু সাহিত্যের – শরীরটা যতই বাঙালীর হোক। বাংলা ভাষায় হিন্দি আর ইংরেজির অনুপ্রবেশ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির গুপ্তঘাতক হিসাবে নীরবে কাজ ক’রে চলেছে আমাদের অজান্তেই। এর পরিণাম যে কি সাঙ্ঘাতিক হতে পারে তা ভাবা যায় না।
আমার এক অধ্যাপক বন্ধু সেদিন আক্ষেপ ক’রে বলেছিলেন ‘বিশ্বায়ন বিশ্বায়ন নিয়ে আমরা হই চই করি অথচ বাঙালী হিসাবে আমরা বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন নিয়ে এতটুকুও ভাবি না’। বাঙালী হিসাবে আমরা বহু কৃতি বাঙালীর দৌলতে বিশ্ববন্দিত, সন্দেহ নেই। কিন্তু বাঙালীর ভাষাকে বিশ্ববন্দিত করতে পারলেই বোধ হয় ষোল কলা পূর্ণ হয়।
ইউনেস্কোর মতে ১০০০০-এর কম মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষা বিলুপ্ত হবার সম্ভাবনা বেশি। জানা গেছে গত ৬০ বছরে ভারতের প্রায় ২৫০টি ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে এবং ৭৮০টির মধ্যে ৬০০টির বিলুপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে। কে জানে বিলুপ্তির তালিকায় এই বাংলা ভাষাও স্থান পাবে কি না !  খোদ কোলকাতায় বাঙালীর ঐতিহ্যের কফি হাউসে বাঙ্গলায় কথা বললে মেলে অপমান, বাংলায় ব্যবসা করা কোম্পানীর কর্মচারিরা বাংলায় কথা বললে তাঁদের চাকরি যায়। সেই ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় জন্মানোটাই স্বাভাবিক। হিন্দি-ইংরেজী মেশানো জগাখিচুরি বাংলাতে যখন নবীন প্রজন্ম ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে তখন মনে হতেই পারে এ বুঝি বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি – বাংলাকে জাতীয় বা আন্তর্জাতিকীকরনের পন্থা । এও মনে হ’তে পারে, প্রতি বছর হাজার হাজার বাংলা বই প্রকাশিত হচ্ছে, অতএব, এই ভাষার মৃত্যু ঘটা অসম্ভব। মৃত্যু হয়ত ঘটছে না, কিন্তু তা যে ক্রমশ অ্যানিমিয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষা যেহেতু ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পথ বেয়ে আসেনি, তাই এই ভাষা রক্ষা এবং একে গৌরবান্বিত করার তাৎপর্য বিশেষ ক’রে নবীন প্রজন্মের কাছে অতটা গুরুত্ত্ব পায় না। তাই পরিবেশ রক্ষার জন্য প্লাস্টিক বর্জন নিয়ে আমরা যতটা সোচ্চার হই, বাংলা ভাষায় অহেতুক হিন্দি-ইংরেজীর মিশ্রন বর্জনে আমরা ততটা সরব হই না।
রেডিও টিভির প্যানেল ডিসকাশনে বাংলা ভাষা নিয়ে যতই গরমা-গরম আলোচনা হোক, ‘মাতৃ ভাষা মাতৃদুগ্ধসম’ এই প্রবচনের জ্ঞানগম্ভীর প্রবন্ধে পত্র-পত্রিকার পাতা যতই সেজে উঠুক, তা কিন্তু ওখানেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেই দুগ্ধের অভাব মেটানোর কার্যকরী ভূমিকার অভাবে কি ভাবে বাংলা ভাষাকে আমরা রক্তাল্পতার রোগী ক’রে তুলছি সেই অনুভব আমাদের চেতনায় আদৌ আঘাত হানছে না। যাঁদের এ নিয়ে রাস্তায় নামা জরুরী তাঁরা রাজনৈতিক মিছিলে হাঁটছেন ।
তাহ’লে কি এভাবেই ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকবে বাংলা ? একে উজ্জীবিত, প্রাণবন্ত করার কোন প্রয়াসই কে নেওয়া হবে না ? এ এক বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন বাঙালীর সামনে ।
সময় এসেছে, বাংলা ভাষার মৌলিকত্ব বজায় রেখে বাংলা ভাষাকে সর্বত্র ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া। স্বাধীনচেতা বাঙালীর মুখে, কাগজে-কলমে লেগে থাকুক শুদ্ধ বাংলা – অমর একুশের অনুপ্রেরণায় মাতৃভাষা হয়ে উঠুক বাঙালীর প্রাণের ভাষা, ভাবের ভাষা এবং কাজের ভাষা। বাংলা ভাষা হয়ে উঠুক অন্য ভাষা-ভাষীদের অনুকরনীয় অনুপ্রেরণা। তবেই হবে বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন

সোমবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২০

ভাল-মন্দের মাপ

,ভাল-মন্দের মাপঃ অ. না.ক. 21/01/2020

কারো কাছে শীত ভালো
কেউ কেউ বলে গ্রীষ্ম,
কেউ বলে ধনী সুখী
কেউ বা বলে নিঃস্ব।
ভালো মন্দের তফাত জানতে
পেতে হবে দুয়েরই স্বাদ
একটা দিয়ে হয়না বিচার
অন্যটাকে যদি দিই বাদ।
যতই আমরা চেঁচিয়ে মরি
'এইটা ভালো ওইটা খারাপ'
তবু সবই থাকে স্বমহিমায়
বৃথাই নিই ভালো- মন্দের মাপ।

সোমবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২০

রাগ ও অভিমান


রাগ ও অভিমানঃ অমরনাথ কর্মকার
রাগ আর অভিমান শব্দ দুটি যে ভিন্নার্থক তা বলাই বাহুল্য। রাগ আর অভিমান দুটি ভিন্ন মানসিক অনুভূতি। রাগের সাথে মিশে থাকে হিংসাত্মক বা নেতিবাচক মনোভাব। বিরক্তিও রাগের উদ্রেক ঘটায়। যে শিক্ষক কথায় কথায় ছাত্র পেটান, তাঁর ছাত্র পেটানো মূলত তাঁর রাগের বহিঃপ্রকাশ। আবার শুনেছি অভিমানের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের নিবিড়তা মিশে থাকে। অর্থাৎ অধিকার থাকলে কারোও ওপরে অভিমান হ’তে পারে, তার ওপরে রাগ হওয়াটা অস্বাভাবিক। মোদ্দা কথা, রাগ সবার ওপরই করা যায়, কেবলমাত্র যার ওপরে অধিকার আছে তার ওপরে প্রথমে অভিমান এবং তা মাত্রা ছাড়ালে রাগে পর্যবসিত হয়। তা হ’লে দাঁড়াচ্ছে, রাগ ব্যাপারটার সঙ্গে সম্পর্কহীনতার বা  দুঃসম্পর্কের যোগ আছে। পথে ঘাটে চলতে গিয়ে প্রায়শই আমরা অজানা-অচেনা মানুষদের সঙ্গে  ঝগড়া-ঝাটি, হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ি। বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা বেশি ভাড়া চেয়েছে ব’লে রেগে গিয়ে তাকে যা ইচ্ছে তাই ব’লে ফেলি। রিক্সাওয়ালার অন্যায় আবদার অসহনীয় হয়ে ওঠে কারন তার সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক নেই ব’লে তার প্রতি আমার অভিমান হয় না, রাগ হয়। ক’দিন আগে আমার অফিসে বার্ধক্য ভাতা পাবার আশায় এক বৃদ্ধ এসেছিলেন। তাঁর কাগজ-পত্র যথাযথ নেই, একথা তাকে বোঝাতে চাইলে তিনি কিছুতেই তা বুঝতে চাইওলেন না। কারন তিনি যে কোন প্রকারে বার্ধক্য ভাতা পেতে চান। যতবার বোঝাবার চেষ্টা করেছি, ততবার তিনি তার অসহায়ত্বের কথা, ছেলের দ্বারা তার বঞ্চনার কথা ব’লেই চলেছেন। মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছিলাম আর তার জীর্ণ চেহারা আর করুণ দৃষ্টি লক্ষ্য ক’রে বিরক্তি প্রশমণের আপ্রাণ চেষ্টা ক’রে যাচ্ছিলাম। বিরক্তিটা রাগে পরিণত হওয়ার আগেই তার দুরবস্থার কথা চিন্তা ক’রে তাকে বার্ধক্য ভাতা পাইয়ে দেবার পথ খুঁজতে লাগলাম। ইতিমধ্যে তাকে ধমক-ধামক দিয়ে থামাবার চেষ্টা করলাম। সেই ধমক ততক্ষণে অভিমান হয়ে গেছে। মনে মনে ভেবে নিয়েছি, তিনি তো আমারই সহ-নাগরিক, অতএব, আমার ক্ষমতার মধ্যে তাকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য। শেষ-মেশ গ্রাম পঞ্চায়েতে নিজেই যোগাযোগ ক’রে একটা সুরাহা ক’রে দিলাম। ঐ যে বলেছি, যে শিক্ষক কথায় কথায় ছাত্র পেটান, তাহলে তাঁর সঙ্গে ছাত্রদের সুসম্পর্ক নেই ? না হ’লে ছাত্র পিটিয়ে রাগ প্রকাশের কারন কি ? আসলে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক মূলতঃ নিবিড়। শিক্ষক নিশ্চয়ই চান ছাত্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, উৎকৃষ্ট বিদ্যার্জন। হয়ত ছাত্রদের অন্যায় আচরণে বিরক্ত শিক্ষকের এটাই অভিমান প্রকাশের ধরন। ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। অনেকক্ষেত্রে রাগের তীব্রতা দুঃসম্পর্ক তৈরি করে বলেই অনেক শিক্ষক অভিযুক্ত হন, খবরের কাগজের শিরোনামে আসেন। বাবা, মা বা নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে অভিমান হয় এবং এই অভিমান যখন রাগে পরিণত হয় তখনই ঘটে বিপর্যয় – মারামারি, খুনোখুনি। সেই মুহূর্তে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অধিকার ছিন্ন হয়। আবার অভিমানও হতে পারে ছাই চাপা আগুনের মত মারাত্মক। অনেক ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা এই অভিমানের করুন পরিণতি।  মার্ক টোয়েন যথার্থই বলেছিলেন Anger is an acid that can do more harm to the vessel in which it is stored than to anything on which it is poured. সোজা কথা রাগ আসলে নিজেরই বেশি ক্ষতি করে। সেই জন্যই কনফুসিয়াস বলেছিলেন, রাগ জমা হ’লে আগে তার পরিণাম ভাবা উচিৎ।
আমার মনে হয় অভিমানের সঙ্গে অনুভূতির একটা আত্মিক যোগাযোগ আছে। আধুনিকতার সাথে সাথে আমরা বোধ হয় ক্রমশ অনুভূতি হারাচ্ছি। আমরা সম্প্রীতি, সৌভ্রাতৃত্ব নিয়ে বড় বড় বক্তৃতা দিই। কিন্তু আদৌ কি আমরা সম্প্রীতি, সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারি ? তাই যদি হয়, তা হ’লে দেশ জুড়ে এত হানাহানি, হিংসা, অস্থিরতা থাকত না। সোজা কথায় একই দেশের নাগরিক হিসাবে, একই মাতৃভূমির সন্তান হিসাবে পরস্পরের মধ্যে যে সম্পর্ক থাকা উচিৎ তাতে অভিমান হয়ত থাকত, রাগ থাকত না। এবং এই রাগের পরিণাম নিয়ে দেশ সর্বদা এত উত্তপ্ত থাকত না। বিশেষ ক’রে রাজনৈতিক নেতাদের মুখের ভাষায় সম্প্রীতির সুর থাকলেও বাস্তবে তাঁদের মধ্যেই  অসহিষ্ণুতা বেশী, বক্তৃতায় পারস্পরিক দুঃসম্পর্কের বেলাগাম প্রকাশ। ফলত, বিবিধ রাজনৈতিক মতাদর্শে প্রভাবিত মানুষদের মধ্যে ক্রোধের বাতাবরণ।
আমরা নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই চিনি না। নিজের প্রতি নিজে অভিমান ক’রে লাভ নেই। তাই ক্রোধের আগুনে পুড়িয়ে মারি আমাদের দেশকে।  আমরা আদৌ কি দেশকে ভালোবাসি ? মাতৃভূমির সঙ্গে কি আমাদের আদৌ মায়ের সম্পর্ক অনুভব করি ? আজ এ এক বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন আমাদের সামনে। প্রসঙ্গত, দার্শনিক অ্যারিস্টটল-এর  বিখ্যাত উক্তির কথা মনে পড়ছে যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘যে কেউ ক্রুদ্ধ হ’তে পারেন, রেগে যাওয়া খুব সহজ। কিন্তু রাগ করার জন্য উপযুক্ত মানুষ চায়, রাগের মাত্রা থাকা চায় এবং রাগের উপযুক্ত সময়, উদ্দেশ্য এবং সঠিক পন্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। সেই ক্ষমতা সবার থাকে না এবং সে ক্ষমতা অর্জন সহজসাধ্য নয়’।   

সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯

ঊনিশ-বিশ


ঊনিশ-বিশ: অ.না.ক. 30/12/2019

সাত পাঁচ না ভেবেই কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না ঠিকই, তবে আগামী বছর আর বছর ক্যালেন্ডারে ঊনিশ-বিশ হলেও পরিস্থিতি যে ঊনিশ-বিশ হবে না একথা ঊনিশের পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে অনেকটাই আন্দাজ করা সম্ভব। আমরা জনগণ, 'গণ' শব্দটাকে গাণিতিক গড় করলে আমাদেরকে চার্লি চ্যাপলিনের ভাষায় 'হেড- লেস মনস্টার' বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবেনা। বৃত্তের কেন্দ্রে যে 'সে আছে আর পরিধির পৃষ্ঠতলে যারা শাসন করছে তারা আমাদেরই সিদ্ধান্তলব্ধ সরকার। কেন্দ্রের সূর্য তাপ ছড়াচ্ছে আর তারই চারপাশে ঘূর্ণায়মান রাজ্যগুলির কোন কোনটি তার থেকে ভিটামিন ডি সংশ্লেষের ক্ষমতা পাচ্ছে আবার সেই তাপের দহনে কোনকোনটি দহন জ্বালায় জর্জরিত। কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তকে কেউ বলছেন 'মোদিভ্রম', আবার  তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে কেউ কেউ বলছেন জনগণের মতিভ্রম। সাম্প্রতিক সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ সহ  বেশ কয়েকটি রাজ্য তোলপাড়। বছরের শেষে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। রাজ্যে ওপার বাংলা থেকে আসা 'অনুপ্রবেশকারী'দের মধ্যে যে ভীতির মেঘ সঞ্চারিত হচ্ছে তাতে আগামী বছরটা এবছরের তুলনায় ঊনিশ-বিশ না হয়ে পরিস্থিতির ব্যবধান যে আকাশ-পাতাল হবে না তা নিশ্চিত 'রে বলা কঠিন। এই অশান্ত পরিস্থিতির মধ্যে 'ফাওবাদি'দের রমরমা। 'ফাওবাদি' মানে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করতে যারা ততপর। কেন্দ্র-রাজ্যের বিরোধের এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রায় ভূমিকাহীন বেশ কিছু দল তাদের নেতা-নেত্রীরা পথে নেমে তাদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে এবং আত্মপ্রকাশের চেষ্টায় মগ্ন। আর গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যমে এই 'ফাওবাদি'রা অতি সক্রিয়। সুযোগ বুঝে পেঁয়াজ মুখ লুকিয়েছে গুদামে। ফলে আমিশাষী জনগণ পেঁয়াজের লাগামহীন দরবৃদ্ধির নাগাল না পেয়ে নিরামিশাষী হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আলুও তথৈ বচ। আলুহীন ব্যঞ্জনে অনভ্যস্ত বাঙালীর এখন মাথায় হাত। নববর্ষ উঁকি মারছে। এবছরের ক্ষত যে আগামী বছর ক্যান্সারে পরিণত হবে না সে গ্যারান্টি কে দেবেনাগরিকত্ব আইনের তীক্ষ্ণ নখের থাবা থেকে মুক্তি পাবার নিশ্চয়তা আদৌ কি পাওয়া যাবেঅযোধ্যা রায় নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিশৃঙখলা কতদূর গড়াবে সে নিয়ে আশঙ্কা রয়েই যাচ্ছে। নির্ভয়া কান্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই এবছর কিছুদিন আগেই ঘটে গেল তেলেঙ্গানায় মহিলা পশু চিকিতসকের ওপর বর্বরোচিত যৌন নির্যাতন এবং তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা। পুরো দেশ যখন  অপরাধীদের কঠিনতম সাজা দেখার জন্য উদগ্রীব ঠিক তখনই 'পুলিশের গুলি'তে নিহত ' সেই অপরাধীরা, আদালতের রায় ঘোষণার আগেই। দেশে খুন-ধর্ষণের ঘটনা ক্রমবর্ধমান এবং বলা বাহুল্য প্রতিকারহীন সমাজব্যবস্থায় তা আগামী বছরগুলিতে কি ভয়ঙ্কর রুপ নিতে পারে সে আশঙ্কায় বুক দুরু দুরু।  এই সব চিন্তা করতে করতেই আমরা ২০১৯-এর সীমান্তে এসে হাজির। ঊনিশ গেলেও দুশ্চিন্তার অবসানের সম্ভাবনা বিশ বাঁও জলে। ৩৭০ ধারা রদ হওয়ার দৌলতে লাদাখ এবং জম্মু-কাশ্মীরের পৃথক দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হওয়া কিংবা বিক্রমের চাঁদের মাটি স্পর্শ করার ব্যর্থতা প্রভৃতি ২০১৯কে ইতিহাসে বিশেষ জায়গা দেবে। ক্রীড়া প্রেমিকরা মনে রাখবেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে পিভি সিন্ধুর সোনা জয়, হিমা দাসের পাঁচটি পদক প্রাপ্তি ইত্যাদি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে  অভিনন্দনের বন্দি হওয়া এবং তার ফিরে আসার রুদ্ধশ্বাস ঘটনা মানুষের মনে দাগ রেখে যাবে। 'বুলবুল'-এর ধ্বংসলীলাও রেখাপাত করবে মনের গভীরে। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সময়ের সাথে আশঙ্কাজনক ক্রমাবনতি ঘটছে। ২০১৯-এর শেষে তাই ২০২০কে স্বাগত জানাতে গিয়ে আসন্ন দিনের রাজনৈতিক ভয়াবহতা নিয়ে জনগণ  কেমন যেন চিন্তাগ্রস্থ। সময় যেমন থেমে থাকে না, তেমনি সময়ের কাছে শিক্ষা নিয়ে জনগণের ভাবনা-চিন্তা পরিমার্জনের প্রয়োজনটাও গুরুত্বপূর্ণ। ঊনিশ-বিশ নয়, এই ভাবনা-চিন্তার ব্যবধান হওয়া উচিত অনেক বেশী।


মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?