বৃহস্পতিবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৯

সল্টলেকের ডায়েরি

সল্টলেকের ডায়েরিঃ অ.না.ক. ১০/০১/২০১৯

এই মুহুর্তে ব'সে আছি সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের ফুটপাতে পুরোনো একটা বাংলা খবরের কাগজ পেতে। ছেলে একটা সর্বভারতীয় প্রবেশিকা  পরীক্ষায় বসছে তাই সঙ্গে আসতে হয়েছে। যখন লিখছি তখন দুপুর প্রায় দুটো। চারপাশে বিশাল বিশাল আকাশচুম্বি  তথ্যপ্রযুক্তি দপ্তর। আমার আশপাশে ফুটপাতে সারি সারি খাবারের দোকান। বুকে পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি দপ্তর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরোচ্ছে সুবেশ তরুন তরুনী।  তারুন্য পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছানো মহিলাদের মধ্যেও তারুন্য বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। ওই বয়সের পুরুষদের দেখা, কেন জানিনা, খুব একটা মিলল না। আমি যেখানে ব'সে আছি তার সামনের দোকানে তথ্যপ্রযুক্তি দপ্তরের আধুনিক পোষাক-আশাকে সজ্জিত তরুন-তরুনীরা দাঁড়িয়ে চা-সিগারেট খেতে খেতে কথাবার্তা বলছেন। নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রায় সকলের মুখেই সিগারেট। বেশিরভাগ মহিলাকেই দেখলাম সিগারেটের ধোঁয়া আদৌ গিলছেন না। অর্থাৎ ধুমপায়িদের মত নেশাগ্রস্থ নন, অথচ সিগারেট ধরিয়েছেন। হয়ত এটাই তাঁদের মেলামেশার রীতি। অনেককে দেখলাম আমার দিকে তাকাচ্ছেন। সেই সময় আমার চোখ চলে যাচ্ছিল আমার আসন হিসাবে ব্যবহৃত বাংলা খবরের কাগজের দিকে। কারন আমার সন্দেহ হচ্ছিল হয়ত তাঁরা আমার বাংলা কাগজ দেখে আশ্চর্য হয়েছেন। কারন এতক্ষন তাঁদের কথাবার্তায় বাংলার লেশমাত্র কানে আসেনি। প্রায় পুরো কথাবার্তা ছিল ইংরেজিতে, মাঝে মাঝে দু'একটি হিন্দি শব্দ। আশপাশের উঁচু উঁচু আধুনিক অট্টালিকা, সল্টলেকের পরিচ্ছন্ন রাস্তা, সুন্দর সুন্দর গাড়ী আর তার মাঝে অনর্গল ইংরেজী বাক্যালাপ শুনে ভুলেই গেছিলাম যে আমি পশ্চিমবঙ্গে আছি, যতই বঙ্গভঙ্গ হোক, যার সঙ্গে 'বঙ্গ' জড়িয়ে , যে রাজ্যের সরকারী ভাষা বাংলা। মনে হচ্ছিল আমি অন্য কোন দেশে এসে হাজির হয়েছি যেখানে বাঙালী হিসাবে আমি বেমানান, তাই অন্যদের আমার প্রতি এই বিষ্ময়জনিত দৃষ্টিপাত। পরে অবশ্য বুঝলাম আমার দিকে তাঁদের দৃষ্টিপাত আসলে আমাকে ফুটপাতে ব'সে থাকতে দেখে। পাতি বাংলা মাধ্যমে পড়া একজন অতি সাধারণ মানুষ হলেও ইংরেজী 'বাঙালী ইংরেজদের' মত বলতে  না পারলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না। এতক্ষন কথোপকথন শুনছিলাম অবাক হয়ে। ইংরেজী শুনতে খারাপ লাগছিল না। কিন্তু খুব খারাপ লাগছিল মাঝে মাঝে। কারন দু'একজন তরুণীকে দেখলাম নির্দ্বিধায় কথার মাঝে গালাগালি দিয়ে যাচ্ছে ঠিক যেমন অনেকে কথায় কথায় 'ব'যুক্ত শব্দের খিস্তি ব্যবহার করে। আমাকে ইংরেজীতে নিরক্ষর পাতি বাঙালি ভেবেই হয়ত খিস্তি দিতে দ্বিধা বোধ করেনি। ঘটনাটা আমার কাছে বেশ উপভোগ্যই ছিল এতক্ষন। বাংলা ভাষার এই পরিণতি নিয়ে সারাদিন বাজার গরম। হায় হায় না ক'রে নিজেরা বাংলাকে বেশি বেশি ক'রে ব্যবহার করার চেষ্টা করলেই যথেষ্ট। যেমন এই লেখাতে আমি যতটা সম্ভব বাংলা শব্দ ব্যবহারের চেষ্টা করছি। মায়ের ভাষাকে আসলে ভোলা যায় না। এতক্ষণ উপভোগ করছিলাম। কিন্তু আকষ্মিক একটা ঘটনা এতক্ষণের উপভোগ্যতায় জল ঢেলে দিল। এক তরুণী তখন অনর্গল ইংরেজীর ফোয়ারা সহকারে ধুমপানে মশগুল। একটা ফোন এল। কানে দিয়েই তিনি প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে পরিষ্কার ঢাকাইয়া বাংলায় কথোপকথন শুরু করলেন। বুঝতে পারলাম বাড়িতে হঠাৎই কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এটাও বুঝতে বাঁকি রইল না যে বাংলা মরেনি, মরেও না, শুধু মোড়ক পালটায়।

মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৮

আলোর হোলিঃ অনাক ০৬/১১/২০১৮

আলোর হোলি দীপাবলী মনে দেয় না তো সুখ
বারুদের ধোঁয়ায় শ্মশানের শবদাহের  গন্ধ পাই
বারুদ বিহীন দগ্ধতাহীন হাজার আলোর বন্যা
পৃথিবী ভাসাক, আনন্দে সবাই হাবুডুবু খাক।

রবিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৮

চেয়ারহীন শ্রেণিকক্ষের প্রাসঙ্গিকতা



চেয়ারহীন শ্রেণিকক্ষের প্রাসঙ্গিকতা 

                                                                            অ.না.ক. ২৮/১০/২০১৮



ক্লাসরুমে এখন থেকে শিক্ষকের জন্য কোন চেয়ার থাকবে না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা দপ্তরের সাম্প্রতিক এই নির্দেশিকাকে কেন্দ্র ক’রে শিক্ষা মহলে নানান বিতর্ক শুরু হয়েছে। শিক্ষকের দাঁড়িয়ে পড়ানোর স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তির ঝড় উঠতে শুরু করেছে শিক্ষক মহলে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ক্লাসে শিক্ষকের জন্য চেয়ার না রাখার পেছনে কি যুক্তি আছে আবার এর বিপক্ষের যুক্তিই বা কি।
প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা হয়ত জানেন চেয়ারে ব’সে পড়ানোর সময় ক্লাসের বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষকের পড়ানোর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের কৌশল।  কিন্তু একথা ঠিক যে চেয়ারে ব’সে পড়ানোর সময় পেছনের দিকের বা কোন এক বা একাধিক বিশেষ অঞ্চলে উপবিষ্ট ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষকের দৃষ্টিগোচর না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বলতে বাধা নেই, পড়া না করা, ফাঁকিবাজ, দুষ্টুমিতে সিদ্ধহস্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যেই পেছনের বেঞ্চে বা শিক্ষকের দৃষ্টির আড়ালে বসার প্রবণতার সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলেছে। উদ্দেশ্য অবশ্যই শিক্ষকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে শিক্ষকের পড়ানোকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দুষ্টুমি করা বা পড়ায় ফাঁকি দেওয়া। সুতরাং ক্লাসে শিক্ষকের বসার জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা না থাকলে পড়ানোর সময় শিক্ষকের দৃষ্টি সমস্ত ক্লাসের ওপর নিবদ্ধ থাকতে বাধ্য এবং হাঁটা-চলার মাধ্যমে শিক্ষক প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর একেবারে কাছে পৌঁছে যেতে পারেন যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষকের পড়ানোর প্রতি ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণ করানোর সুযোগ বাড়ে।  আরোও বড় ব্যাপার হ’ল মনস্তত্বের বিচারে, দাঁড়িয়ে কথা বললে শরীরী ভাষার সঙ্গে বক্তব্যের সাবলীলতা বাড়ে যা শ্রোতার দৃষ্টি আকর্ষণ করার কাজে বেশি কার্যকরি হয়। সম্ভবত সেই কারনেই কোন আলোচনা সভায়, বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখার রীতি প্রচলিত। এমনিতেই অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা পড়ানোর সময় ক্লাসে একটুও বসেন না, দাঁড়িয়ে বা ধীর পদক্ষেপে ক্লাসময় পায়চারী করতে করতে শিক্ষাদানে অভ্যস্ত। আমাদের সময় কোন কোন শিক্ষককে দেখেছি ক্লাসে এসে পড়ানো বাদ দিয়ে চেয়ারে ব’সে আরাম ক’রে ঘুমিয়ে নিতেন। এমনকি কাউকে দিয়ে ঘাড় মাথা টিপিয়ে নিতেন। ততক্ষণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চলত নিচু স্বরে গল্প, আড্ডা, দুষ্টুমি। এখনকার স্কুলগুলিতে এরকম শিক্ষক থাকাটাও অসম্ভব নয়। ক্লাসে চেয়ার না থাকলে শিক্ষকের এই ধরনের প্রবনতা থেকে ১০০ শতাংশ মুক্তি মিলবে।
দাঁড়িয়ে পড়ানোর যথেষ্ট সঙ্গত বিপক্ষ যুক্তিও রয়েছে। শিক্ষক দির্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়ানোর পর ক্লান্ত বোধ করতেই পারেন, বিশেষ ক’রে বয়স্ক শিক্ষক বা গর্ভবতী শিক্ষিকার ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। কিংবা কিছুক্ষণ পড়ানোর পরে শিক্ষক ছাত্রদেরকে কিছু কাজ দিলেন ক্লাসে করার জন্য। সেই সময়টুকু শিক্ষক সম্পূর্ণ দাঁড়িয়ে বা চলালচল ক’রে কাটাবেন তার যৌক্তিকতা কোথায় ? সে্ক্ষেত্রে শিক্ষক তাঁর চেয়ার সরিয়ে সুবিধামত জায়গায় ব’সে নজরদারী করতেই পারেন। কিন্তু ক্লাসে যদি চেয়ারই না থাকে তাহলে শিক্ষকের কাছে এ এক বড় বিপদের কারন। তাহলে কি হাঁটুর সমস্যা আছে বা বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে শারীরিক অসুবিধা বোধ করেন এমন শিক্ষকদের শিক্ষকতা ছেড়ে দেওয়ার দিন আসন্ন ? আমাদের রাজ্যে একজন শিক্ষককে প্রতিদিন গড়ে ৫-৬ টি ক্লাস নিতে হয় এবং বিরতিহীন ভাবে ৩-৪টি ক্লাস অনেক শিক্ষককেই নিতে হয়। সুতরাং এতটা দীর্ঘ সময় একটানা দাঁড়িয়ে পড়ানো একজন সুস্থ শিক্ষকের পক্ষেও কতটা সম্ভবপর তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্নচিহ্ন আছে। আরোও একটি আপাত গুরুত্বহীন কথাও বলা জরুরী। একজন পুরুষ শিক্ষক পড়ানোর সময় যদি ক্রমাগত ছাত্রীদের কাছে দাঁড়ান তাহলে ছাত্রীদের কাছে তা অস্বস্তির কারন হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয় মোটেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রবহমান প্রথাকে রাতারাতি পাল্টে ফেলার আকষ্মিক নির্দেশে শিক্ষক মহলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠাটা স্বাভাবিক। নিঃসন্দেহে শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিকতা এসেছে, এসেছে শিক্ষণের বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি, অনেক প্রগতিশীল দেশে তার প্রয়োগও হচ্ছে। ক্লাসে শিক্ষকের জন্য চেয়ার না রাখার যৌক্তিকতা হয়ত এই কারনেই প্রাসঙ্গিক। কিন্ত আমাদের দেশে তা প্রয়োগের হটকারী সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
ক্লাস থেকে শিক্ষকের চেয়ারকে রাতারাতি নির্বাসনে না পাঠিয়ে চেয়ার রেখেই শিক্ষককে দাঁড়িয়ে পড়ানোর নির্দেশ জারি করলে হয়ত সাপও মরে লাঠিও ভাঙে না। প্রয়োজনে শিক্ষক বসবেন, কিন্তু সাধারণভাবে তাকে দাঁড়িয়েই পড়াতে হবে এবং তা নজরদারী করবেন প্রধান শিক্ষক বা ভারপ্রাপ্ত কেউ, প্রাথমিকভাবে এমন নিয়ম চালু করলে হয়ত পদক্ষেপটা হবে অনেকটা মসৃণ।    

অমরনাথ কর্মকার

সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৮

মরু প্রেমিকা

সহকর্মী প্রিয় মানসের (মানস নন্দী) মিশর ভ্রমনকে উদ্দেশ্য ক'রে লেখাঃ

মরু প্রেমিকাঃ অ.না.ক.২৩/১০/২০১৮

তবুও মেলে জলজ্যান্ত জীবন চারপাশে।
তপ্ত বালির ক্রুদ্ধ তাপ, নেই এতটুকু ছায়া,
পিরামিডের মৃত্যুপুরী ঠাসা মমির লাশে,
বেদুইনকে বিভ্রান্ত করে মরীচিকার মায়া।

তবুও মেলে জলজ্যান্ত জীবন চারপাশে।
মরীচিকার দর্পণে জলের অলীক আভাস,
দুস্তর, দুর্গম, তবুও আমার প্রেমিকা সে
কাঁটা আছে,তবু আছে জলভরা ক্যাকটাস।

বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

নবমীতে মন খারাপঃ অ.না.ক. ১৮/১০/২০১৮

আজ সারাদিন সর্বত্র যেন মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়ির পরিবেশ। বরং বলা ভাল, পাত্রীপক্ষের বাড়ির পরিবেশ ব’লে মনে হ’ল। কারন মাইকে বাজতে শুরু করেছে সানাই-এর সুর। কারনটা সহজেই অনুমেয়। আজ নবমী। আমার মন খারাপের মাত্রা ক্রম হ্রাসমান। সুর ব্যপারটা আজ সকাল থেকেই আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। সুর কখনো মন ভালো করছে, কখনো কাঁদাচ্ছে, হাসাচ্ছে। কি অদ্ভুত! আরও অদ্ভুত সানাই নামক সঙ্গীতের যন্ত্রটা। কে জানে কার মাথা থেকে কিভাবে বেরিয়েছিল এই যন্ত্র সৃষ্টির ভাবনাটা। মন অবশ করা আওয়াজ। পূজোর আনন্দ অবসানের প্রাকমুহূর্তে, নবমী নিশি অতিক্রান্ত না হওয়ার আকুতি জানিয়ে সকলেরই বাসনা উৎসবের আনন্দ আরও একটু স্থায়ী হোক । আজ তাই সবার মন খারাপ । আর আমার তো এমনিতেই মন খারাপ হয়েই আছে । মন খারাপ দিয়ে শুরু করেছিলাম ষষ্ঠী থেকে – সেই মনখারাপ প্রবহমান নবমীর রাত পর্যন্তও । আজ বোধ হয় সকলেরই মন খারাপ । তাদের মন খারাপের নির্দিষ্ট কারন আছে – দেবী দুর্গার ‘অদ্য শেষ রজনী’র বিহ্বলতা । ওসবে আমার মন নেই । আমার মন খারাপের কারন হয়ত আছে কিন্তু শত অনুসন্ধানেও তার হদিশ পাচ্ছি না ।আজ নবমী – বাতাসে বিষাদ – সবার মন খারাপ । জীবনের উৎসবে যারা ব্রাত্য তাদের কথা ভেবে আজ সারাদিন মনের মধ্যে কেমন যেন লাগছে। অবশ্য এই ভাবনার আকষ্মিক উদয় হয়নি। এমনিতেই অকারন মন খারাপের বিষণ্ণতা, তার ওপর সকালে ঘটে গেল একটা ঘটনা। আসলে বিপদ আর বিভ্রান্তি পাশাপাশি চলে। পূজোর ছুটিতে সকালে ঘুম থেকে দেরি করে উঠি। কিন্তু আজ সকালে এক ব্যক্তি এসে হাজির বাড়ির চারদিকে গজিয়ে ওঠা জঙ্গল পরিস্কার করার কাজ করবে ব’লে। পূজোর মধ্যে এসব কাজ করানোর ইচ্ছে নেই। তবুও সে নাছোরবান্দা। অনেক অনুনয়, বিনয়। পূজোর মধ্যে সবাই যখন ছুটির আনন্দ উপভোগ করতে চায়, তখন ওর এই আবেদনে নিশ্চয়ই কোন কারন আছে। কথায় কথায় জানালো ‘পূজোর ক’দিন কাজ নেই ব’লে সংসারে বড্ড টানাটানি, তাই কাজ চাইছি। তাছাড়া মেয়েটার খুব অসুখ’। সামান্য সময় কাজ করিয়ে পুরো দিনের পারিশ্রমিক দিয়ে ওকে ছেড়ে দিলাম পূজোর পরে আবার কাজ করানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে। সত্যিই তো এরকম দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমিকদের কাছে পূজোর দীর্ঘ ছুটি আনন্দের চেয়ে বেশি দুঃখ বয়ে নিয়ে আসে। মন খারাপ হ’ল। তার চেয়েও বেশি রাগ হ’ল সামাজিক উন্নয়নের নামে সরকারী আষ্ফালনের বিজ্ঞাপনের ওপর। গণতন্ত্রের এই বেহাল দশার কথা বেশি না বলাই ভাল। এতে বিড়ম্বনা বাড়ার আশঙ্কা। আজকের মন খারাপের তীব্রতা কম ব’লে অনভ্যাস সত্ত্বেও দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নিয়েছি। ঘুমানোর আগে ছোটোবেলার পূজোর দিনগুলোর স্মৃতি উঁকি মারছিল মনে। বোধ হয় তখন ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। তিনজন বন্ধু মিলে ঠিক করেছিলাম সিগারেট খাব। সকাল থেকেই বুক দুরু দুরু। সিগারেট কিনে প্যান্টের পকেটে কাগজে মুড়ে রাখা আছে। পাছে কেউ দেখে ফেলে সেই আতঙ্কে ছিলাম। বিকেল হতেই বন্ধুর ডাক। বাবার পকেট থেকে দেশলাই-এর প্যাকেটটা নিয়ে চললাম নদীর ধারের এক নির্জন রাস্তায়। চারিদিকে দেখে শুনে ধরিয়ে ফেললাম সিগারেট তিনজনেই। একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা – এক অদ্ভুত শিহরন। সাথে কারো দেখে ফেলার ভয়। এবং ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়’ এই প্রবাদকে সত্যি প্রমাণ ক’রে সেখানে অকস্মাৎ হাজির আমার বাবার অতি পরিচিত এক ভদ্রলোক এবং আমাকে সিগারেট মুখে দেখেই থমকে দাঁড়ালেন আমার সামনে। আমার তো তখন ভয়ে প্রায় জ্ঞান হারানোর মত অবস্থা। মুখ থেকে সিগারেট ফেলে ফ্যাল ফ্যাল ক’রে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ভদ্রলোকের দিকে। আমাদের কান ধরিয়ে উঠবোস করিয়ে ছেড়ে দিলেন। সে যাত্রায় মুক্তি পেলাম বটে কিন্তু বাবা জেনে গেলে কি হবে তার পরিণাম চিন্তা ক’রে হৃৎপিন্ডের স্পন্দন বেড়ে গেল। পরে বুঝেছি ভদ্রলোক বাবাকে জানাননি। তবে অনেক বড় হয়েও আমি সেই ভদ্রলোকের মুখোমুখি হবার সাহস পায়নি। আমি কিন্তু ধূমপানে আসক্ত নই। জানিনা সেই ঘটনার কোন প্রভাব এর মধ্যে আছে কি না। ঘুমের আগে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম বাবা-কাকার মুখগুলো যাঁদের হাত ধ’রে ছোটোবেলায় যেতাম পূজো দেখতে। একেই বোধ হয় বলে স্মৃতিবিলাস। এই বিলাসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল সন্ধের সময়। মন খারাপটা অনুভূত হ’ল কিন্তু তীব্রতা কম। তবে সন্ধের পরে যে ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি তা হ্রাসমান অকারন মনখারাপকে টেক্কা দিয়ে গেছে। রাত্রে রাস্তায় বেরিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হতে ও আর আমি একসঙ্গে হাটতে বেরোলাম। উদ্দেশ্য একটু মনের কথা আদান-প্রদান। নবমীর ভিড়ে তখন রাস্তাঘাট সরগরম। একসময় বন্ধু বলল ‘চল আইসক্রীম খাই’। আমি সাধারণত আইসক্রীম খাই না। কিন্তু বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে না করলাম না। ওখানে অনেকগুলো আইসক্রীমের দোকান। কিন্তু বন্ধুকে দেখলাম অনেকটা ভেতরে গিয়ে একটি ছেলের কাছ থেকে আইসক্রীম নিল। জিজ্ঞেস করলাম ‘অত দূরে যাওয়ার দরকার কি ছিল ? সামনেই তো দোকান আছে অনেক’। বন্ধু বলল ‘খা। পরে বলছি’। গল্প করতে করতে আইসক্রীম শেষ করলাম। তারপর বন্ধুটি আমার প্রশ্নের জবাব দিতে শুরু করল বেশ গুরুত্ব সহকারে। আসলে ঐ আইসক্রীম বিক্রেতা ছেলেটি ওর পরিচিত। তার থেকেও বড় কথা ও নিজে উদ্যোগী হয়ে ওদের ক্লাব থেকে ওকে ওখানে বসার ব্যবস্থা ক’রে দিয়েছে। কারন ছেলেটি ক্যান্সারে আক্রান্ত। চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্য ও ছেলেটাকে ক্লাবের সাহায্য নিয়ে সবরকম সহযোগিতা করে। শুনে ভীষণ খুশী হলাম। পিঠ চাপড়ে ধন্যবাদ জানালাম অজস্র। ছেলেটার কথা ভেবে মনটা খারাপ হ’ল খুব। রাত্রে বাড়ি ফিরে বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ক্যান্সার আক্রান্ত সেই আইসক্রীম বিক্রেতার মুখ। নবমীর নিশাবসান আসন্ন ব’লে চারিদিকে মানুষের উদ্দীপনার মধ্যেও একটা বিষাদের মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রতি বছর নবমীতে ‘যেওনা নবমী নিশি’র আকুতি দেখতে দেখতে চুলে শুভ্রতা আসতে শুরু ক’রে দিল। আজ আমার মনে যে বিষন্নতা তা নবমীর রাতের জন্য নয়, ছুটি শেষ হয়ে আসছে ব’লে। এবার বোধ হয় অকারন মন খারাপের দিন ফুরিয়ে আসছে। এবার যে মন খারাপ হবে তার মধ্যে কারন থাকবে। হ্যাঁ, সেই আইসক্রীম বিক্রেতা ছেলেটার মুখ এখনোও আমার সামনে ভাসছে। কিন্তু এইমাত্র একটা মস্ত ভুলের জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে। যে বন্ধুর সঙ্গে এত গল্প হ’ল, যার মহানুভবতা নিয়ে এত কথা লিখলাম এতক্ষণ, তার নিজের কথা তো জানা হ’ল না। বন্ধুটির নাম নিশিকান্ত। খুব ভাল ছিল পড়াশুনায়। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং করেছিল। এইমাত্র মনে পড়ল ক’দিন আগেই আমার এক বন্ধু জানিয়েছিল নিশিকান্ত’র নাকি মানসিক চিকিৎসা চলছে। আত্মহত্যার চেষ্টাও নাকি করেছিল কিছুদিন আগে – চাকরিটাও নেই। খুব খারাপ লাগছে, এত খবর নিলাম অথচ ওর দুর্দশার খবরটাই নিতে ভুলে গেলাম। এবার যে তীব্র মন খারাপ হতে শুরু করেছে তার পেছনে যথেষ্ট ও যথার্থ কারন আছে। সত্যিই কিছু ভালো লাগছে না এবার। লেখা থামালাম। শুভরাত্রি।

সেলফি-সুখ

যখন আয়নায় দেখি নিজের মুখ,
সে তো দেয় কেবল ক্ষণিকের সুখ
তাই সেলফি তুলি মোবাইল ক্যামে,
সুখ থেকে যায় স্মৃতির অ্যালবামে।

.......   অ.না.ক.  ১৮/১০/২০১৮

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?