বুধবার, ৩০ জুন, ২০২১

শিশুমনের ভাবনা

শিশুমনের ভাবনা – অমরনাথ কর্মকার ০১/০৭/২০২১ ছোটবেলায় আমার এক অদ্ভুত ধারণা জন্মেছিল। ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হ’তে পারে কিন্তু আমার ছেলেবেলার সেই বিশ্বাসের সঙ্গে আজকের বাস্তবের বৈপরিত্য অনুভব করলেও ভেতর ভেতরে তা মেনে নেওয়ার ব্যাপারে যে দ্বিধা জন্মায় তা আমাকে কেমন যেন শৈশবের মানসিকতা ফিরিয়ে দেয়। ব্যাপারটা তাহলে একটু খোলসা ক’রে বলি। ছোটবেলায় দেখেছি বাড়িতে কারো অসুখ-বিসুখ হ’লে বাবা তাঁর এক ডাক্তার বন্ধুকে নিয়ে আসতেন। ডাক্তারবাবু আসছেন জানতে পারলে আমি এবং আমার মত ছোটরা রাস্তার ধারে সাগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন বাবার সঙ্গে রিক্সায় চ’ড়ে ডাক্তারবাবু আসবেন। ডাক্তারবাবুর ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী পরিহিত, উঁচু পেট সমৃদ্ধ, স্থূলকায় লম্বা চেহারা আমাদের কাছে যেমন আকর্ষক ছিল তেমনি আকর্ষণের বস্তু ছিল ডাক্তারবাবুর সঙ্গে থাকা পেটমোটা ব্যাগটা। বেশ মনে আছে, আমার ঠাকুমার যখন খুব শরীর খারাপ হ’ল, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী, বাড়িতে কান্নাকাটির ধুম পড়ে গেছে তখন ডাক্তারবাবুর আগমনে বাড়ির থমথমে পরিবেশটা কেমন যেন পাল্টে গেল। সবার দেখাদেখি আমার মনও খারাপ হয়ে গিয়েছিল, আমার চোখেও জল এসেছিল । ডাক্তারবাবু এসেই স্টেথিস্কোপ নামক যন্ত্র দিয়ে ঠাকুমার বুক পরীক্ষা ক’রে নিলেন। তারপর বড় একটা ইঞ্জেকশান বার ক’রে ঠাকুমার হাতে ঢুকিয়ে দিলেন। ডাক্তারবাবুর নির্দেশে সবাই ঠাকুমার কাছে না থাকলেও দূর থেকে ডাক্তারবাবুর কার্যকলাপ আর ঠাকুমার পরিস্থিতির পরিবর্তন লুকিয়ে চুরিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না। আমার বায়নার কাছে হার মেনে মা আমাকে তুলে দিয়েছিলেন জানলায়। বেশ কিছুক্ষণ বাদে লক্ষ্য করলাম থমথমে মানুষগুলোর মুখ থেকে উদ্বেগের কালো মেঘ সরে গিয়ে সকালের সূর্যের নরম আলোর মত হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। এবার ঠাকুমার অনেকটা কাছে গিয়ে দেখলাম ঠাকুমাকে। ঠাকুমা উঠে বসেছেন। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দু’একটা কথাও বলছেন। কে যেন বললেন ‘ভাগ্যিস ঠিক সময়ে ডাক্তার এসেছিলেন, না হ'লে বাঁচানো যেত না’। বিশ্বাস করুন, সেই ঘটনা দেখার পর থেকে ডাক্তার সম্বন্ধে এক অদ্ভুত ধারণা জন্মেছিল আমার। ধারণা হয়েছিল, যে ডাক্তার প্রায় মৃত মানুষকে চিকিৎসায় বাঁচিয়ে তুলতে পারেন – তিনি নিজে কখনোই মরতে পারেন না কারন মানুষ বাঁচানোর কৌশল তো তাঁর জানা। তার পর থেকে অনেক বছর পর্যন্ত ডাক্তার সম্বন্ধে এই ধারণাই পোষণ ক’রে আসতাম। এখন বুঝি, ডাক্তারদের অমরত্ব নিয়ে ছোটবেলা থেকে আমার পোষিত ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত। কথাটা বললাম বটে, কিন্তু সেই ভ্রান্তি স্বীকার করতে দ্বিধা বোধও হয়। কারন এখনও আমরা দেখি কত মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে ডাক্তাররা তাঁদের সুচিকিৎসায় বাঁচিয়ে তুলে নতুন জীবন দান করেন। সে ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুরা তো ঈশ্বরেরই সমান। তা’হলে তাঁরাও তো অমরত্বের অধিকারী। সুতরাং আমার ছেলেবেলার সেই বিশ্বাসের সত্যতা বাস্তবিক অস্বীকার করারও উপায় নেই। আসলে শিশু মনে যে কল্পনার জগৎ তৈরি হয় তা তার দেখা ছোট্ট গন্ডীর বাস্তবতা থেকে নেওয়া। কারন গল্প শুনে, বই প’ড়ে তবেই শিশুর কল্পনার জন্ম নেয়। কিন্তু তার দেখা পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী থেকে শিশুর মনে উদ্ভুত ধারণা সব সময়ই যে অমূলক হবে তার কোন মানে নেই। হয়ত তার ধারণার স্বপক্ষে উপযুক্ত যুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা তার মধ্যে নেই, কিন্তু তার ধারণার যুক্তিগ্রাহ্যতা থাকার সম্ভাবনা প্রবল। আমার এই উপলব্ধি থেকেই এখনোও কোনও বাচ্চার ধারণাগুলোকে বোঝার চেষ্টা করি, তার ধারণা জন্ম নেবার প্রেক্ষিত খোঁজার চেষ্টা করি, ধমক দিয়ে তার ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার চেষ্টা না ক’রে বরং তার বিশ্বাসকে মূল্য দিয়ে তার মত ক’রে তার ধারণার সত্যাসত্য ব্যাখ্যা ক’রে তার ধারণাকে সংশোধন ক’রে দেওয়ার চেষ্টা করি। তবে আমি খেয়াল ক’রে দেখেছি বাচ্চাদের মধ্যে জন্ম নেওয়া ধারণার মধ্যে কিছু যুক্তি থাকে যা তার দেখা, শোনা বা পড়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত । ছোট্ট একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমার এক বন্ধুর বাবার মৃত্যুতে আমি শ্মশানযাত্রী। পরিবারের অনেকের সঙ্গে বছর নয়-এর একটি ছেলেও যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে। বন্ধুর অনুরোধে যাত্রাপথে সেই বাচ্চা ছেলেটির দেখভালের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। হিন্দু শাস্ত্রের নিয়ম মেনে শব যাত্রায় মাঝে মাঝেই রাস্তায় খই, পয়সা ছিটানো হচ্ছিল। আর সেই সময় কিছু দরিদ্র মানুষ পয়সা কুড়িয়ে নিচ্ছিল রাস্তা থেকে। ব্যপারটা অনেকক্ষণ লক্ষ্য করার পর ছেলেটি একসময় আমায় প্রশ্ন ক’রে বসল, ‘আঙ্কেল, মানুষ মারা গেলে সব টাকা ফেলে দিতে হয়?’ বুঝলাম এটা ওর বিশ্বাস। দেখলাম বিশ্বাসটা অমূলক নয়। তার এই বিশ্বাসের স্বপক্ষে যুক্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলাম। সত্যি বলতে কি আমি এর পৌরাণিক ব্যাখ্যা জানি না। তাই একটু অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম। আমি মুচকি হেসে একটু প্রসঙ্গান্তরে এলাম। ওর কাছ থেকে জেনে নিলাম ও ইতিহাসে আলেকজান্ডার সম্বন্ধে পড়েছে কি না। উত্তর শুনে জানলাম আলেকজান্ডার সম্বন্ধে সে অনেকটাই জানে। তারপর আলেকজান্ডারের সেই অন্তিম ইচ্ছার কথা বললাম। মেসিডোনিয়ার রাজা বীর আলেকজান্ডার ব্যাবিলনে দ্বিতীয় নেবুচাদ নেজারের প্রাসাদে যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃত্যু বরণ করার আগে তিনি তাঁর যে শেষ তিনটি ইচ্ছার কথা বলেছিলেন তার অন্যতম ছিল – তাঁর কফিন যে পথ দিয়ে যাবে সেই পথে তাঁর কোষাগারের জমানো সমস্ত সম্পদ রাস্তায় ফেলে দিতে হবে। কারন তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, মৃত্যুর সময় মানুষ কিছুই সঙ্গে নিতে পারে না। জীবদ্দশায় শুধুই ধন সম্পদের পেছনে ছোটা আসলে সময়ের অপচয়। এত গূঢ় কথা ওইটুকু বাচ্চার মাথায় ঢোকানো উচিৎ হবে না ভেবে ব্যাপারটাকে লঘু ক’রে এবার অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম। ওকে বললাম – দেখ তোমার দাদু খুব গুনী মানুষ ছিলেন। বড় মাপের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর কথা সবাই মনে রাখবে। কিন্তু শুধু অনেক টাকা পয়সা রোজগার ক’রেই যারা জীবন কাটায় তাঁদের কথা কেউই মনে রাখে না। রাস্তায় যে খই আর পয়সা ছেটানো হচ্ছে তার মানে মানুষকে বোঝানো যে টাকা পয়সা সারাজীবন থাকে না কিন্তু ভাল কাজ করলে তাঁর সম্মান মৃত্যুর পরেও থেকে যায়। শেষে বললাম তুমিও বড় হয়ে মানুষের জন্য অনেক বড় কাজ করবে তাহলে দেখবে অনেক সম্মান পাবে। ছেলেটার মুখে একরাশ সরল লাজুক হাসি দেখলাম। কে জানে কি বুঝল।

শনিবার, ১৯ জুন, ২০২১

ও মন্ত্রী মশাই আমরা মুক্তি চাই

ও মন্ত্রীমশাই আমাদের শেখার দরজা বন্ধ রেখেছ তাই খাওয়া ঘুম খেলাতেই কাটে পুরো দিনটাই। এখন জ্ঞানের উৎস পাশে নিয়ে আর হয় না বসা কাটছে তাদের আলমারীতে বন্দী জীবন দশা। এমন জীবন চাই না আমরা, মুক্তি চাই। ও মন্ত্রীমশাই... মুখোশে ঢাকা পৃথিবীটা বড্ড বিশ্রী দেখতে লাগে খোলা হাওয়ায় মুক্তির স্বাদ নিতে ইচ্ছে জাগে দূরত্ব আজ দেয়াল তুলেছে বন্ধুতার মাঝখানে মনে হয় সে দেয়াল ভেঙে দিই একটি হ্যাচকা টানে। মনে হয় এই ছোট হাতে পৃথিবীটা পাল্টাই। ও মন্ত্রীমশাই... নিয়ম মেনে খুলছে দোকান, চলছে গাড়ি, চলছে কর্মশালা আমরাই শুধু বন্দী খাঁচায়, স্কুলের গেটে ঝুলছে তালা। করোনার সাথে যুদ্ধ জিততে আমরাও আছি পাশে ছোট্ট আমরা তবুও কিন্তু ভয় পাইনা করোনার ত্রাসে। ফিরিয়ে দাও সত্যিকারের শৈশব অনুরোধ একটাই। ও মন্ত্রীমশাই... --- অমরনাথ কর্মকার ০৭/০৬/২০২১

রবিবার, ৬ জুন, ২০২১

বাঙালীর আপন কালবৈশাখী

 বাঙালীর আপন কালবৈশাখীঃ অমরনাথ কর্মকার

 

কালবৈশাখী বাঙালীর রক্তধারায় মিশ্রিত -তার সাথে বাঙালীর আত্নিক সম্পর্ক। আর রাজনীতিতে ঝড় তোলার ব্যাপারে বাঙালীর খ্যতি বিশ্বময়। আড্ডায়, মজলিশে বাঙালীর চায়ের কাপে তুফান ওঠে। নদীমাতৃক বাংলায় ঝড় বলতে একমাত্র কালবৈশাখীকেই আমরা একান্ত আপন ব’লে জানতাম বা চিনতাম। আর বছরের অন্য সময়ে ওঠা ঝড়কে অকালবৈশাখী নামেই ডাকা হ’ত। বৈশাখের দাবদাহে অতিষ্ঠ জীবনে আকাশের ঈশান কোনে জমে ওঠা নিকষ কালো মেঘের রুদ্র, সংহারক আত্মপ্রকাশ পরিবেশে শীতলতা দানের পাশাপাশি ডেকে আনত বিপর্যয়। লন্ডভন্ড ক’রে দিত ঘর-বাড়ি, গাছপালা , পশুপাখি । আধুনিক উন্নত প্রযুক্তির যুগে আমরা বেশ কিছুদিন আগেই   জেনে যাই বিপর্যয়ের প্রায় নির্ভুল পূর্বাভাষ। সুতরাং বিপন্মুক্তির আগাম পরিকল্পনাও সহজ হয়ে যায় অনেকটাই।  কিন্তু মাত্র কয়েক দশক আগে, যখন প্রযুক্তির রমরমা ছিল না, তখন ঝড়ের মত বিধ্বংসী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আকষ্মিকতায় যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হ’ত  তা বৈদ্যুতিন বা বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপকতা না থাকার কারনে আমাদের দৃষ্টিগোচর হ’ত না। অসহায় মানুষের চোখের জল চোখেই শুকিয়ে যেত।  এখন আমাদের একান্ত আপন কালবৈশাখী বা অকালবৈশাখী মাঝে মাঝেই হাজির হয় ‘সিডার’, ‘আইলা’, আম্পান’ বা ‘ইয়াস’-এর মত বিভিন্ন নামে, বিপর্যয়ের বিভিন্ন মাত্রা ও ধ্বংসের বৈচিত্র নিয়ে।  গত বছরের আম্পান ঝড়ের তান্ডবের ক্ষত শুকোতে না শুকোতেই, কোভিডের অতিমারীর মধ্যেই আগুনে ঘৃতাহুতি দেওয়ার মতই হাজির হয়েছে ‘ইয়াস’ নামক ভিন্ন নামধারী আর এক বিপর্যয়।                                                                                                                                                                                                    বাঙালী সাহিত্যিকদের রচনায় মাঝে মাঝেই এসেছে কালবৈশাখীর অনুষঙ্গ। আসলে কালবৈশাখীর সঙ্গে অন্য কোন ঝড়ের তুলনা হয় না। ‘দেশে ও বিদেশে’ ভ্রমণ বৃত্তান্তে সৈয়দ মুজতবা আলী আফগানিস্থানের দিনের আলোর উত্তাপের তীব্রতার সঙ্গে কালবৈশাখীর ভয়াবহতার  তুলনা করেছেন। ঝড়বৃষ্টির ধ্বংসলীলা বাঙালী জীবন ও জীবিকার ওপর কি মর্মান্তিক আঘাত হানতে পারে তা মানিক বন্দোপাধ্যায় স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে। কাজী নজরুল ইসলাম বা  মোহিতলাল মজুমদারের কবিতায় কিংবা অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে আমরা পড়েছি ঝড়ের রুদ্র, সংহারক রূপ। তবে রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায় বর্ণিত ঝড়ের বিভৎসতা শরীরে রীতিমত শিহরণ জাগায়। মোটকথা বাংলা সাহিত্যের একটা বিশাল ক্ষেত্র জুড়ে রয়েছে ঝড়, আর সে ঝড় কালবৈশাখী। আমরাও ছোট বেলায় ঝড় এলে আম কুড়াতে ছুটতাম। এখনোও গ্রাম বাংলায় অপু-দুর্গার মত ছেলে-মেয়েরা ঝড়ে আম কুড়িয়ে আনন্দ পায়। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তকে দেখা গেছে ইন্দ্রনাথের সঙ্গে দুর্যোগে বেরিয়ে পড়তে। সে ঝড়ের নাম টাইফুন, টর্নেডো, আয়লা, আম্পান বা ইয়াসের মত অপিরিচিত ছিল না। সে ঝড় ছিল বাঙালীর চেনা, সে ঝড়েও মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আবার সে ঝড়ে রোমান্টিক কবি প্রেমিকার অভিসার প্রত্যাশা করেছেন।

আসলে আমরা যেমন আধুনিকতার নামে অন্য ভাষা, অন্য সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার প্রতি আসক্ত হচ্ছি তেমনি কালবৈশাখীর বাঙালীয়ানাও কি সেইভাবে বদলে যাচ্ছে ? বাঙালীর ঢেড়স যেমন নামী হোটেলের খাদ্যতালিকায় ‘লেডিস ফিঙ্গার’ হয়ে যাচ্ছে তেমনি আমাদের চির পরিচিত বাংলার ঝড়ই আয়লা, আম্পান, ইয়াস প্রভৃতি বিচিত্র নামের আড়ালে আসলে সেই বাংলার ঝড়ই রয়ে গেছে।

প্রযুক্তির এই আকাশচুম্বী উন্নতির আগে ঝড়ের আগাম খবর পাওয়া যেত না। হঠাৎই নেমে আসত দুর্যোগ, সমুদ্র নদী ফুলে-ফেঁপে বাঁধ ভাঙত, প্লাবিত করত  গ্রামের পর গ্রাম, ঝড়ের তান্ডবে বাড়িঘর, গাছপালা লন্ডভন্ড হ’ত । দুর্যোগে তখনও শোনা যেত মানুষের আর্তনাদ। আবার জীবন সংগ্রামে জিতে ফিরে আসত স্বাভাবিক জীবনস্রোতে। পার্থক্য একটাই – তখন আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর থেকে আসন্ন ঝড়ের সময়, ঝড়ের ভয়াবহতা নিয়ে আজকের মত (প্রায় নির্ভুল) সঠিক পূর্বাভাস মিলত না। ঝড়ের দুর্যোগ নেমে আসত প্রায় আচমকা। আসলে সে সময় মানুষের দুর্দশা জানা বা জানানোর মত আজকের মত উন্নত মাধ্যম ছিল না। ফলে মানুষের দুর্গতি সকলের দৃষ্টিগোচর হ’ত না। এখন বিচিত্র নামের আড়ালে সেই একই ঝড় আসে তবে আগাম বার্তা দিয়ে। দুর্যোগ মোকাবিলায় সবরকম প্রস্তুতি  আগাম নিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে, ত্রাণের ব্যবস্থা থাকে। এত কিছু সত্ত্বেও আমাদের চোখের সামনে দেখি গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হ’তে – দেখি মানুষের আশ্রয়হীনতা, পশু-পাখিদের অসহায়তা।

তাহলে পাল্টালো কি ? কিছুই পাল্টায়নি এক সময় ছাড়া। বরং ভিন্ন নামধারী ঝড়ের তান্ডবলীলা বেড়েছে, প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়তা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকৃতির রোষানল আমাদের আধুনিক বিজ্ঞান নির্ভরতাকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

আধুনিকতার নামে প্রকৃতির প্রতি আমাদের অযত্ন আর অবহেলাই প্রকৃতির এই বিধ্বংসী মনোভাবের কারন নয় তো  ?  

এ বছর মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হওয়া কি উচিৎ?

বর্তমান পরিস্থিতিতে চলতি বছর মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হওয়া আদৌ উচিৎ নয়।

কারনঃ

প্রথমত, পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া কোভিডের বর্তমান ভয়াবহ পরিবেশে পরীক্ষার্থীদের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাতে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক করোনা সংক্রমণের প্রবল সম্ভাবনা থেকে যাবে।

দ্বিতীয়ত, অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া অনুচিত । তার কারন, দরিদ্র ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী পরীক্ষার্থীদের পক্ষে ইন্টারনেট সংযোগ সহ কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব বা মোবাইল ফোনের ব্যবহার অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। বিশেষত, বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে কাজ-হারানো বা উপার্জন কমে যাওয়া অভিভাবকদের পক্ষে সেই ব্যয়ভার বহন করা খুবই কষ্টকর। 

তৃতীয়ত, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ‘ইয়াস’-এর বিপর্যয়ে অনেক পরিক্ষার্থীই বর্তমানে দুঃসহ জীবন অতিবাহিত করছে, এবং এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হয়ত আগামী কয়েক মাস লেগে যাবে। তাই তাদের কাছে অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়া প্রায় কল্পনাতীত।

সর্বোপরি, এই সমস্যা শুধুমাত্র আমাদের রাজ্য বা আমাদের দেশেরই নয়, এই সমস্যা সমগ্র বিশ্বের। 

সুতরাং পরীক্ষা না নিয়ে বিকল্প মূল্যায়ন  আগামীতে সর্বত্রই যে গ্রহণীয় হবে, তা বলাই বাহুল্য।

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?