বাঙালীর আপন কালবৈশাখীঃ অমরনাথ কর্মকার
কালবৈশাখী বাঙালীর রক্তধারায় মিশ্রিত -তার সাথে বাঙালীর আত্নিক সম্পর্ক। আর রাজনীতিতে ঝড় তোলার ব্যাপারে বাঙালীর খ্যতি বিশ্বময়। আড্ডায়, মজলিশে বাঙালীর চায়ের কাপে তুফান ওঠে। নদীমাতৃক বাংলায় ঝড় বলতে একমাত্র কালবৈশাখীকেই আমরা একান্ত আপন ব’লে জানতাম বা চিনতাম। আর বছরের অন্য সময়ে ওঠা ঝড়কে অকালবৈশাখী নামেই ডাকা হ’ত। বৈশাখের দাবদাহে অতিষ্ঠ জীবনে আকাশের ঈশান কোনে জমে ওঠা নিকষ কালো মেঘের রুদ্র, সংহারক আত্মপ্রকাশ পরিবেশে শীতলতা দানের পাশাপাশি ডেকে আনত বিপর্যয়। লন্ডভন্ড ক’রে দিত ঘর-বাড়ি, গাছপালা , পশুপাখি । আধুনিক উন্নত প্রযুক্তির যুগে আমরা বেশ কিছুদিন আগেই জেনে যাই বিপর্যয়ের প্রায় নির্ভুল পূর্বাভাষ। সুতরাং বিপন্মুক্তির আগাম পরিকল্পনাও সহজ হয়ে যায় অনেকটাই। কিন্তু মাত্র কয়েক দশক আগে, যখন প্রযুক্তির রমরমা ছিল না, তখন ঝড়ের মত বিধ্বংসী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আকষ্মিকতায় যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হ’ত তা বৈদ্যুতিন বা বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপকতা না থাকার কারনে আমাদের দৃষ্টিগোচর হ’ত না। অসহায় মানুষের চোখের জল চোখেই শুকিয়ে যেত। এখন আমাদের একান্ত আপন কালবৈশাখী বা অকালবৈশাখী মাঝে মাঝেই হাজির হয় ‘সিডার’, ‘আইলা’, আম্পান’ বা ‘ইয়াস’-এর মত বিভিন্ন নামে, বিপর্যয়ের বিভিন্ন মাত্রা ও ধ্বংসের বৈচিত্র নিয়ে। গত বছরের আম্পান ঝড়ের তান্ডবের ক্ষত শুকোতে না শুকোতেই, কোভিডের অতিমারীর মধ্যেই আগুনে ঘৃতাহুতি দেওয়ার মতই হাজির হয়েছে ‘ইয়াস’ নামক ভিন্ন নামধারী আর এক বিপর্যয়।
আসলে আমরা যেমন আধুনিকতার নামে অন্য ভাষা, অন্য সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার প্রতি আসক্ত হচ্ছি তেমনি কালবৈশাখীর বাঙালীয়ানাও কি সেইভাবে বদলে যাচ্ছে ? বাঙালীর ঢেড়স যেমন নামী হোটেলের খাদ্যতালিকায় ‘লেডিস ফিঙ্গার’ হয়ে যাচ্ছে তেমনি আমাদের চির পরিচিত বাংলার ঝড়ই আয়লা, আম্পান, ইয়াস প্রভৃতি বিচিত্র নামের আড়ালে আসলে সেই বাংলার ঝড়ই রয়ে গেছে।
প্রযুক্তির এই আকাশচুম্বী উন্নতির আগে ঝড়ের আগাম খবর পাওয়া যেত না। হঠাৎই নেমে আসত দুর্যোগ, সমুদ্র নদী ফুলে-ফেঁপে বাঁধ ভাঙত, প্লাবিত করত গ্রামের পর গ্রাম, ঝড়ের তান্ডবে বাড়িঘর, গাছপালা লন্ডভন্ড হ’ত । দুর্যোগে তখনও শোনা যেত মানুষের আর্তনাদ। আবার জীবন সংগ্রামে জিতে ফিরে আসত স্বাভাবিক জীবনস্রোতে। পার্থক্য একটাই – তখন আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর থেকে আসন্ন ঝড়ের সময়, ঝড়ের ভয়াবহতা নিয়ে আজকের মত (প্রায় নির্ভুল) সঠিক পূর্বাভাস মিলত না। ঝড়ের দুর্যোগ নেমে আসত প্রায় আচমকা। আসলে সে সময় মানুষের দুর্দশা জানা বা জানানোর মত আজকের মত উন্নত মাধ্যম ছিল না। ফলে মানুষের দুর্গতি সকলের দৃষ্টিগোচর হ’ত না। এখন বিচিত্র নামের আড়ালে সেই একই ঝড় আসে তবে আগাম বার্তা দিয়ে। দুর্যোগ মোকাবিলায় সবরকম প্রস্তুতি আগাম নিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে, ত্রাণের ব্যবস্থা থাকে। এত কিছু সত্ত্বেও আমাদের চোখের সামনে দেখি গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হ’তে – দেখি মানুষের আশ্রয়হীনতা, পশু-পাখিদের অসহায়তা।
তাহলে পাল্টালো কি ? কিছুই পাল্টায়নি এক সময় ছাড়া। বরং ভিন্ন নামধারী ঝড়ের তান্ডবলীলা বেড়েছে, প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়তা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকৃতির রোষানল আমাদের আধুনিক বিজ্ঞান নির্ভরতাকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
আধুনিকতার নামে প্রকৃতির প্রতি আমাদের অযত্ন আর অবহেলাই প্রকৃতির এই বিধ্বংসী মনোভাবের কারন নয় তো ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন