বই পড়ার উপকারিতাঃ অমরনাথ কর্মকার ২৫/০৩/২০২০
ছোটবেলায় বাবা-মার কাছে অনেক বকা শুনেছি বই না পড়ার কারনে। কোন বই ? ভুল ভেবে থাকতে পারেন হয়ত। বকা খেয়েছি স্কুলের পাঠ্য বই না পড়ার কারনে আদৌ নয়। স্কুলের পাঠ্য বই পড়া তো দৈনিক খাবার খাওয়ার মত। ওটা তো নিয়মমাফিক পড়তেই হ'ত। অবশ্য আমার বাবা-মা অতিরিক্ত খাওয়াতে পছন্দ করতেন না। বাবা বলতেন ক্ষিদে পেলে এমনিতেই খাবে। এখন অবশ্য বেশিরভাগ অভিভাবককে দেখি সন্তানের ভরা পেটেও জোর ক'রে গেলাতে। জানিনা, হয়ত বা জলবায়ুর পরিবর্তনের ফল। সে যা হোক, বকা খেয়েছি স্কুলের পাঠ্যের বাইরে বই না পড়ার কারনে। তার কারনও একটা ছিল। বাবা আমাদের স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরির সভ্য ছিলেন। বাড়িতে অনেক বিখ্যাত লেখকের বই আনতেন। নিজে পড়ার পর সাথে সাথে ফেরত না দিয়ে অতিরিক্ত কয়েকটা দিন বাড়িতে রেখে আমাকে পড়তে বলতেন। আমি বই পড়ছি কি না সে রিপোর্ট দেওয়ার দায়িত্ব ছিল মায়ের ওপর। আমি নিরুপায় হয়ে বই পড়ার নাম ক'রে অহেতুক পাতা উল্টে পড়ার ভান করতাম মাকে দেখানোর জন্য। বলা দরকার, আমার বাবা স্বল্পশিক্ষিত ছিলেন কিন্তু বই পড়ার অসম্ভব নেশা ছিল। মা ছিলেন অতি স্বল্পশিক্ষিতা কিন্তু আমার পড়ার নজরদারিতে শিক্ষকদেরও হার মানাতে পারতেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বই হাতে বসার অভ্যেস ক্রমশ বই-এর প্রতি আকর্ষণের জন্ম দিল। আস্তে আস্তে বিভিন্ন ধরনের বই, পত্র-পত্রিকা পড়ার প্রতি আগ্রহ এমনভাবে জন্মালো যে আজ আমার আয়ের একটা অংশ শুধু বই আর পত্র-পত্রিকা কিনতে ব্যয় হয়ে যায়। চাকরি পাবার আগে যখন কেবল টিউশানি করতাম তখন থেকেই আমার খরচে বাড়িতে নিয়মিত পত্র-পত্রিকা নিতাম। আর বই-এর একটা ছোটখাটো লাইব্রেরিই বানিয়ে ফেলেছিলাম। না, আমরা ধনী ছিলাম না, ছিলাম নিম্ন মধ্যবিত্ত। সেই অভ্যেস রক্তে মিশে গেছে ব'লে অবসর পেলেই বই পড়ি, আনন্দ পাই। বাবা আমার কেনা বই আর পত্র-পত্রিকায় মশগুল হয়ে থাকতেন অবসর সময়ে। মারা যাবার আগেও বাবাকে দেখেছি দুপুরে না ঘুমিয়ে বই পড়তে। দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে লক ডাউন - ভয়ঙ্কর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে। চলবে আরোও অন্তত ১৪ দিন। রাত দুটো নাগাদ বাড়ির বাইরের উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখলাম অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। মনে হ'ল পৃথিবী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অথচ অন্য সময় হ'লে রাত দুটোতেও পাড়া জেগে থাকে। কখনোও মাইকে গান ভেসে আসে, কখনোও পাশের বাড়ির জানলা দিয়ে ভেসে আসে শিশুর কান্না কিংবা স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার আওয়াজ। এই ভাবে দীর্ঘ দিন অলস ঘর বন্দী হয়ে থাকাটা কি সবার পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে? বিশেষ ক'রে যারা সারাদিন কাটান কর্মব্যস্ততায়? যাঁরা নাচ-গান বা অন্যান্য শৈল্পিক কাজে করেন তাঁদের সময় কাটবে শিল্প চর্চায়।কিন্তু যাঁরা এসবের মধ্যে নেই তাঁদের কি হবে? মোবাইল ঘেঁটে কতদিন চলবে? টিভিতেও চলছে সিরিয়ালের পুরোনো এপিসোডের পুনঃপ্রচার।সুতরাং এতদিন কাজের চাপ সামলে ছুটির উপভোগ্যতা যেভাবে অনুভব করেছি আজ থেকে তার বিপরীত। এখন ছুটির চাপ সামলানোই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমার বা আমার মত যাদের বই পড়ার নেশা আছে তাদের ক্ষেত্রে বোধ হয় এই দীর্ঘ সময় অলস সময় কাটানো কঠিন হবে না। 'বই পড়ে কি হবে' এই প্রশ্নের সম্মুখীন বহুবার হয়েছি। আমি ভালো চাকরি করি না, আর্থিক ভাবেও স্বচ্ছল নই, সামাজিক পরিচিতিও আমার নেই। তাই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে চলেছি কারন প্রশ্নকর্তার চাহিদামত উত্তর দেওয়ার যোগ্যতায় আমি ডাঁহা ফেল। আর যে উত্তর আমি দিতে পারি তাতে হাসির খোরাক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি। তাই বই পড়ি নিভৃতে, ভালোবেসে মানসিক প্রশান্তির ছায়ায় বসে। তবে আজ সেই সমস্ত প্রশ্নকর্তাদের 'বই পড়ার উপকারিতা'র উত্তর নির্দ্বিধায় দিতে পারি। উত্তরটি হ'ল - বই পড়া সময় কাটানোর সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। এক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তা একশ তে একশ দিতে দ্বিমত করবেন না নিশ্চয়। যেহেতু আগামী বেশ কয়েকদিন আমাদের বন্দিদশা চলবে।