সমীরণবাবুঃ অ.না.ক. ১৯/০২/২০১৬
ক্লাসে
মাস্টারমশাইয়ের রক্তচক্ষু, বেত্রাঘাত, দু’আঙুলের মধ্যে পেন্সিল ঢুকিয়ে চাপ দেওয়া,
দু’হাতে থান ইট চাপিয়ে নিল ডাউন বা বিভিন্ন ধরণের কষ্টকর শাস্তির ভয়ে ত্রস্ত হওয়ার
প্রবণতা ছাত্রদের মধ্যে থাকেই । আবার এসব উপেক্ষা করে উল্টে মাস্টারমশাইদের
বিড়ম্বনার কারণ হওয়া ডানপিটে ছাত্রের সংখ্যাও কম নয় । যেমন আমাদের ক্লাসের পার্থ
আর অসীম বেত্রাঘাতে নিপুন কার্ত্তিক স্যারকে আড়াল থেকে বিকৃত স্বরে ‘ট্যারা
কার্ত্তিক’ ব’লে পালিয়ে যেত প্রায়ই । স্যার ধরতেও পারতেন না । তবে আমাদের ইংরেজি স্যার সমীরণ বাবু ছিলেন ছিলেন সত্যিকারের কড়া, যদিও
শেষ পর্যন্ত তাঁকেও পার্থদের কাছে হার মানতে হয়েছিল । একসময় আমাদের কাছে তো বটেই,
অন্যান্য মাস্টারমশাইদের কাছেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক মজার চরিত্র ।
সমীরণ বাবু একসময়
ছিলেন প্রেসিডেন্সির ইংরেজির কৃতি ছাত্র । ফর্সা, লম্বা চেহারা । মুখে সর্বদা পাইপ
। কোট-টাই পড়া একদম সাহেবদের মত ফিটফাট চেহারা । একটা ইংরেজি কবিতা শেষ করতে তাঁর
লেগে যেত মাসখানেক । স্বভাবতই সিলেবাস শেষ হ’ত না । কবির জীবনী শেষ করতে প্রায় মাস
কাবার । পড়াতে পড়াতে প্রসঙ্গক্রমে নিজেই গান গাইতেন (তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ভালো
গাইতে জানতেন), অভিনয় করতেন । এহেন সমীরণ স্যারের ক্লাসে দেখা যেত ৮০ শতাংশ ছাত্র
উধাও । না, পড়া না পারার ভয়ে নয়, এমনকি শাস্তি পাবার ভয়েও নয় – কারণ তাঁর পড়ানোর
ধরণ হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র ভালো ছাত্রের কাছে ভালো লাগত, বাকীরা বিন্দুমাত্র
আনন্দ পেত না । তাঁর পড়ানো শুরু হওয়া মাত্র বিরক্ত ছাত্রদের মধ্যে শুরু হ’ত
চঞ্চলতা । সামান্য অসহিষ্ণুতাও সমীরণবাবু সহ্য করতে পারতেন না, কারোও মধ্যে
অমনোযোগিতা দেখলেই দুগালে বসাতেন টেনে থাপ্পর । পার্থ বসত একদম শেষ বেঞ্চে ঠিক
দরজার পাশে । স্যার পড়ানো শুরু করার পর স্যারের অলক্ষ্যে পার্থ প্রায়ই বেরিয়ে যেত
ক্লাস থেকে । একদিন স্যারের নজরে পড়ে গেল । পার্থ বেরিয়েছে – স্যারও বেরিয়ে
পার্থকে হাতেনাতে ধরার উদ্যোগ নিচ্ছেন । বুঝতে পেরে পার্থ দোতলার বারান্দা দিয়ে
দৌড় লাগাল । নাছোড়বান্দা স্যারও শুরু করলেন ওর পেছন পেছন দৌড় । দোতলা থেকে একতলা –
স্যারও সমানে দৌড়ে চলেছেন । স্যারকে নিরস্ত করার জন্য অফিসরুম থেকে অন্যান্য
স্যারেরাও ছুটে এলেন । কোনরকমে তাঁকে শান্ত করা হ’ল । ততক্ষণে পার্থ কিন্তু পগার
পার । ফর্সা টুকটুকে সমীরণবাবুর মুখ তখন রাগে লাল । হেডস্যারের কাছে নালিশ হ’ল ।
পরদিন হাতে পায়ে ধরে পার্থর শাস্তি লাঘব হ’ল । এরপর থেকে ক্লাসে বসে প্রায়ই আমরা
শুনতে পেতাম দুপদাপ শব্দ । দেখা যেত অনেকেই সমীরণবাবুকে উত্তক্ত করার ক্ষেত্রে
পার্থর অনুসারী হয়ে উঠেছে । সমীরণবাবু দৌড়চ্ছেন আর তাঁর সামনে দৌড়চ্ছে অন্য কোন
ছাত্র । এ দৃশ্য হামেসাই চোখে পড়ত ।
তবে সমীরণবাবুর
পড়াশোনার পরিধি ছিল তুলনাতীত । ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর জ্ঞান ছিল অপরিসীম । হয়ত
আমাদের মত সাধারণ মানের ছাত্রদের পক্ষে তা হজম করা কঠিন ছিল বলেই তাঁকে নিয়ে মজা
করেছি । কিন্তু এখন বুঝতে পারি তিনি কি বিরাট মাপের মানুষ ছিলেন ।