রবিবার, ১২ জুন, ২০২২

অশ্লীল শব্দের ব্যবহার

 অশ্লীল শব্দের ব্যবহার

অমরনাথ কর্মকার ১২/০৬/২০২২


বাসে, লরিতে ড্রাইভারের কাছের আসনে ব’সে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তাঁরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য ক’রে থাকবেন, গতিপথে সামান্য ব্যাঘাত ঘটানো গাড়ির চালককে অশ্লীল ভাষায় গালি দিতে। একই সাথে অন্যদিক থেকেও অশ্রাব্য ভাষার ফুলঝুড়ি ছোটে। এমনকি জানলা দিয়ে দুই গাড়ির চালকের মধ্যে সাধারণ বাক্যালাপেও মিশে থাকে অজস্র দুই চার অক্ষরের অশ্লীল শব্দমালা। এই সমস্ত শব্দ প্রয়োগের মধ্যে তাদের মধ্যে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে না। বরং এই সমস্ত গালাগালি (সাধারণ কথায় খিস্তি) ব্যবহার না করলে তাদের কথা বলায় স্বাচ্ছন্দ্য আসে না। ঠিক যেমন পাড়ার রকে আড্ডা মারার সময় ছেলেরা অবলীলায় অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার ক’রে থাকে। মনে হয় কথার মাঝখানে গালাগাল না দিলে যেন কথা বলায় তৃপ্তি আসে না। এই সমস্ত অশিষ্ট শব্দ প্রয়োগের সময় ইচ্ছা অনিচ্ছা স্থান কাল পাত্র কোন প্রশ্নই মাথায় আসে না। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার মতই অবলীলায় বেরিয়ে আসে শব্দগুলো। মোট কথা গালি দেওয়ার মধ্যে তারা খুঁজে পান প্রাণের আরাম।  

কিন্তু কারনে অকারনে অশ্লীল শব্দ প্রয়োগের কারন কি ? অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ কি স্বেচ্ছায় করা হয় নাকি এই সমস্ত শব্দ প্রয়োগকালে আমাদের মস্তিষ্কে এবং দেহে কোন পরিবর্তন ঘটে ? আচমকা হোঁচট খেলে প্রায় প্রত্যেকেরই তাৎক্ষণিক ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে মুখ থেকে নিঃসৃত হয় ছাপার অযোগ্য কিছু শব্দ, অনেকে আবার সেগুলো উচ্চারণ করেন মনে মনে। আর সত্যি বলতে কি এই শব্দগুলো উচ্চারিত হওয়ার মধ্যে দিয়েই কোন এক যাদুমন্ত্রে ক্রোধের তাৎক্ষণিক প্রশমন ঘ’টে মনের আরাম আনে। তার অর্থ, কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে একটা বা একগুচ্ছ অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ, ব্যতিক্রম বাদ দিলে, আমাদের সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যেই পড়ে।   

আমাদের ‘ভদ্র’ সমাজে অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ শ্রুতিকটু এবং যিনি কারনে-অকারনে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেন তার ওপর ‘অভদ্রতা’র সিলমোহর দিয়ে দেওয়া হয়। আবার অশ্লীল শব্দের সংজ্ঞা নিয়েও বিতর্কের অন্ত নেই। আপনাদের মনে থাকবে নিশ্চয়ই, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বিরোধী বিএনপির সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু ‘চুদুরবুদুর’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন যা অশ্লীল ব’লে তুমুল সোরগোল উঠেছিল। কিন্তু পরে অনেক বিচার বিবেচনায় দেখা গেল এই শব্দটি আদৌ অশ্লীল নয়, সচরাচর শব্দটি ব্যবহৃত না হলেও শব্দটির অর্থ মূলত উল্টোপাল্টা কাজ করা, নড়বড়ে থাকা, বাড়াবাড়ি করা । সুতরাং কোন শব্দ শ্লীল না অশ্লীল এ নিয়েও নানান মতবিরোধ আছে। তবে আমাদের বাঙালী সমাজে কিছু পেটেন্ট শব্দ বা শব্দগুচ্ছ বহুদিন ধরেই অশ্লীলতার দায়ে দুষ্ট যে গুলির প্রকাশ্য ব্যবহার আদৌ বাঞ্চনীয় নয়। বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক ডঃ এমা বার্ন (Dr. Emma Byrne) তাঁর Swearing Is Good For You বইটিতে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সহযোগে দেখিয়েছেন যে গালি দেওয়া মূলত একজন মানুষের জন্য ভালো। আবার গালি জিনিসটা আসলে ঠিক কি, তা নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করা খুব কঠিন।

সব সংস্কৃতিরই একটা নৈতিক কাঠামো থাকে। সেই কাঠামোকে ভাঙাটাই আসলে অশ্লীলতা। আমাদের বাঙালী সমাজেও কিছু নির্দিষ্ট শব্দ বা শব্দগুচ্ছ  আছে যেগুলির প্রকাশ্য ব্যবহার আমাদের সমাজের নৈতিক কাঠামোকে লঙ্ঘিত করে, যা গালি হিসাবে চিহ্নিত। ব্যাপারটা প্রকাশ্যে মদ্যপানের মতন। ড. বার্ন বলছেন, গালি হচ্ছে এমন এক ধরনের ভাষা যা আমরা চমকিত বা স্তম্ভিত বা উৎফুল্ল হলে ব্যবহার করি, অথবা ব্যবহার করি মজা করার জন্য বা কারো প্রতি আক্রমণাত্মক হবার জন্য। প্রকৃতপক্ষে কোন শব্দটা একটা গালি হয়ে উঠবে তা আমরা সবাই মিলেই নির্ধারণ করি। গালি হচ্ছে সেই ধরনের ভাষা - যা সমাজের নৈতিক শৃঙ্খলাকে অবমাননা করে।

তাহ’লে আমরা গালি দিই কেন ? সহজ এবং সাধারণ ব্যাখ্যা  – বাঁধভাঙা আনন্দ, চরম বিষ্ময়, বা গভীর দুঃখ, বেদনা, বা ক্রোধ- যে কোন রকম পরিস্থিতিতেই মনের আবেগ প্রকাশ করার জন্য অশ্লীল শব্দের উচ্চারণ সবচেয়ে উপযুক্ত উপায় । আবার অনেক সময় ভদ্র শব্দে গালির মত আবেগ প্রকাশ করা যায়না। অশিক্ষিত বা কম শিক্ষিত দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যে অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ অত্যন্ত বেশি। তার কারন ক্রমাগত দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম এবং চাহিদা অনুসারে প্রাপ্তির অপ্রতুলতা এসবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের হাতিয়ার হিসাবে এরা অশ্লীল শব্দের লাগামছাড়া ব্যবহার ক’রে থাকেন । এর পেছনে লুকিয়া থাকে একরাশ যন্ত্রণা। ভদ্র, রুচিশীল শব্দ ব্যবহারেই বরং তারা স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতে পারেন না – কারণ ওই শব্দগুলো তাদের আবেগের ওপর সেই প্রভাব ফেলতে পারে না, যা গালিসূচক শব্দগুলো পারে।  

ড. স্টিভেন্স তাঁর গবেষণায় দেখেছেন - সাধারণ শব্দ ব্যবহারের তুলনায় গালি দেবার সময় মানুষের হৃৎপিন্ডের গতি বেড়ে যায় । গালি এক ধরনের আবেগপূর্ণ ভাষা, এবং এরকম ভাষায় কথা বলার সময় একধরনের আবেগগত প্রতিক্রিয়া হয় । ডঃ স্টিভেন্স তাঁর পরীক্ষালব্ধ সিদ্ধান্ত থেকে জানিয়েছেন - যখন মানুষ বেদনাহত হয়ে গালাগালি করে - তখন তারা আসলে তাদের স্ট্রেস বা মানসিক চাপের স্তর বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং এর মধ্যে থেকেই এমন একটা প্রক্রিয়া ঘটছে যাতে তার ব্যথার অনুভূতি অসাড় হয়ে যাচ্ছে - যাকে বলা হয় 'স্ট্রেস ইনডিউসড এ্যানালজেসিয়া' - এবং এটা 'যুদ্ধ করো অথবা পালাও' এ জাতীয় বৃহত্তর প্রতিক্রিয়ার অংশ। 

একাধিক মার্কিন গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে মানসিক চাপ, অবসাদ, মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজনা কমানোর ক্ষেত্রে গালিগালাজ খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এই ধারণার সঙ্গে একমত ব্রিটিশ গবেষক এবং মনোবিজ্ঞানীরাও। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক ও ফলিত ভাষাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ডঃ কিরিকুস অ্যান্টনিও জানান, গালিগালাজ আসলে মন থেকে রাগ, ক্ষোভ বের করে মানসিক চাপ কাটানোর সহজ উপায়। অ্যান্টনিওর মতে, যে সব মানুষ উত্তেজিত হলেও গালিগালাজ দিতে পারেন না বা দেন না তাঁদের মধ্যে মানসিক অবসাদ, উচ্চ রক্তচাপ, নানা স্নায়বিক সমস্যা দেখা যায়। শুধু তাই নয়, কখনও এই সব ব্যক্তিদের মধ্যে দ্বৈত ব্যক্তিত্বের (split personality) সমস্যাও দেখা যায়। তুলনায় যাঁরা সহজে গালাগাল দিয়ে চাপমুক্ত হন তাঁরা অনেক বেশি সুস্থ থাকেন।

পৃথিবীর সব ভাষাতেই কমবেশি গালির ভান্ডার আছে। তবে রুশ ভাষা হচ্ছে গালি দেবার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট ভাষা। এ ভাষায় প্রায় যে কোন কিছুকেই অশিষ্ট বানানো যায়। আর, গালি দেয় না এমন একজন রাশিয়ান লোক কল্পনা করাই দুষ্কর। 

গালি বা অশ্লীল শব্দের ব্যবহার আগেও ছিল, এখনোও আছে। শুধু সমাজ কেন, আমাদের সাহিত্যে-সিনেমাতেও অশ্লীল শব্দের অহরহ ব্যবহার। কিন্তু আমাদের সমাজের যে নৈতিক কাঠামো তা মেনে চলাই নিয়ম হওয়া উচিৎ। আমাদের সমাজে যা অশ্লীল ব’লে পরিগনিত হয়ে আসছে এতদিন,  তাকে পরিহার ক’রে  সমাজের শিষ্টতাকে মান্যতা দেওয়া আমাদের নৈতিক কর্তব্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?