শিল্পীর
সম্মান
অমরনাথ কর্মকার ০৩/০৬/২০২২
বিনয় শব্দটা এবং
সহিষ্ণুতা ইদানিং অনেকের মধ্যেই
অনুপস্থিত। সামান্য ব্যপারেই অশালীন
ভাষা প্রয়োগ, ব্যক্তিগত আক্রমণ এসব রাজনীতির অঙ্গণ ছেড়ে সাংস্কৃতিক জগতেও ঢুকে পড়েছে।
নিজেকে
জাহির করার মধ্যেও একটা
বিনয় প্রয়োজন। শিল্পী রুপঙ্কর বাগচি নিঃসন্দেহে বাংলা
সঙ্গীতজগতে খ্যাতিমানদের মধ্যে একেবারে প্রথম
দিকের নাম। তিনি যখন জাতীয় পুরষ্কার পেলেন
তখন বাঙালীরা কি গর্ববোধ করেন নি ? তাঁর জাতীয়
পুরষ্কার প্রাপ্তি কি বাংলা গানকে জাতীয় স্তরে সমৃদ্ধ করেনি ? ভালো জিনিসের কদর পাবার জন্য তাঁর উচ্চ গুণমানের
সাথে সাথে প্রচারের ব্যাপ্তি অর্থাৎ বিজ্ঞাপণও প্রয়োজন। রুপঙ্করবাবু তাঁর অমার্জিত
বক্ত্যব্যের মাধ্যমে খবরের শিরোনামে উঠে আসার যে বিজ্ঞাপণটা প্রচার করলেন তা না ক’রে
তিনি যদি বাংলা গান জনপ্রিয় করার বিজ্ঞাপণ দিতেন সেটা অনেক বেশি মার্জিত হ’ত, বাংলা
গানের অনেক বেশি উপকার হ’ত।
কেকে’র মত শিল্পী সারা ভারতের মঞ্চ কাঁপিয়ে
বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন ভাষার গান গেয়ে। এমনকি রুপঙ্করবাবু তাঁর বক্ত্যব্যে যে সমস্ত বাঙালী
শিল্পীদের নাম নিয়েছেন তাঁদের অনেকের কাছেই কেকে উচ্চ মানের শিল্পী। তাঁদের বেশিরভাগই
রুপঙ্করবাবুর মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। রুপঙ্করবাবু তাঁর (এবং আমাদেরও) মনের
বাস্তব যন্ত্রণা প্রকাশ করার জন্য অন্যভাবে
বলতে পারতেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্য প্রকাশের ভাষা ও অঙ্গভঙ্গি ছিল যে কোন মানুষকে ক্রোধান্বিত করার পক্ষে যথেষ্ট
এবং তার পরিণাম তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। কেকে-এর মৃত্যু এই ক্রোধকে হয়ত আরোও একটু
জোড়ালো করেছে মাত্র। বিষ্ময়ের ব্যাপার, একই
পেশার একজন আর একজনকে
প্রকাশ্যে অপমান করাটা কি আদৌ কোন ভদ্র মানুষের কাজ ?
একসময় ঊষা উথথুপকে অপমানিত হয়ে গাইতে হয়েছিল ‘আমি শিল্পী আমি শিল্পী চাই শিল্পীর সম্মান..’।
সেক্ষত্রে প্রেক্ষিত ভিন্ন হলেও শিল্পী কে অপমান করা হয়েছিল। জানিনা কেকে বেঁচে থাকলে
রুপঙ্করবাবুর বক্ত্যব্যের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এরকম ভাষায় গান সৃষ্টি করতেন কি না।
রুপঙ্করবাবু বারবার বোঝাতে চাইছেন, যারা তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে
সমালোচনায় সোচ্চার, তারা নাকি তাঁর বক্ত্যব্যের ভুল ব্যাখ্যা করছেন। আসলে তিনি নিজেই ভুল করছেন। তিনি সঙ্গীত
ভালো বোঝেন বটে, কিন্তু তাঁর বক্তব্য বোঝার ক্ষমতা বহু মানুষের আছে। আর একটা
ব্যাপার খুবই লক্ষ্যনীয়, ফেসবুকে
বক্তব্য রাখার সময় তিনি বাংলা আর বাঙালী নিয়ে অনেক কথা বললেন অথচ কথা বলার মধ্যে ইংরেজির
বন্যা বইয়ে দিলেন। বাস্তবে, এঁরা
বাংলা বা বাঙালীর পরিচিতির ব্যপ্তি ঘটানোর লক্ষ্যে বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া বাস্তবে কোন
কাজই করেন না। বাংলা
আর বাঙালীকে বিশ্বের দরবারে আরোও প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষমতা যাঁদের আছে তাঁদের বেশিরভাগেরই
সঙ্কীর্ণতায় আটকে থাকাটা আজ বাংলা ও বাঙালীর
জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিতির ক্রমহ্রাসমানতার অন্যতম কারন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, কুমার শানু, শ্রেয়া ঘোষাল, অরিজিৎ সিংরা যখন জাতীয় বা
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি পান, তা সে
যে ভাষার গানের জন্যই হোক না কেন,
আমরা বাঙালীরা গর্বিত হই তিনি বাঙালী
ব'লে, তাঁর মাতৃভাষা
বাংলা ব'লে। সত্যজিৎ
রায় আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছেন বাংলা ছবির জন্যই। আসলে বাঙালী ও বাংলা ভাষা
বেশি ক'রে আন্তর্জাতিক
হয়ে উঠতে গেলে সঙ্কীর্ণতার
বেড়াজাল ভাঙতে হবে। ঈর্ষাপরয়ণতা আসলে
আমাদের পিছিয়ে দেয়। রুপঙ্করবাবু নিজেও জানেন, শিল্পের
কোন ভাষা হয় না। গানও তো একটা শিল্প। লতাজীর কন্ঠে গান শোনার সময় আমরা মন্ত্রমুগ্ধ
হয়ে শুধু তাঁর গানই শুনি, একবারও ভাবার চেষ্টা আসেনা গানটা হিন্দি না বাংলা বা অন্য
ভাষার অথবা লতাজী বাঙালী না মারাঠি বা অন্য কিছু। আসলে রুপঙ্করবাবু যা করলেন, তাতে
বাংলা গান তো বটেই, বাঙালীকেও অনেকটা পিছিয়ে দিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন