শুক্রবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১

সামাজিক মাধ্যম ও বাংলা ভাষা

 

                                           সামাজিক মাধ্যম বাংলা ভাষা

                                                                                                   অমরনাথ কর্মকার ২৫/১২/২০২১

            আজকাল কিছু শব্দ ইন্টারনেট বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে বিশ্বময় বিপুল জনপ্রিয়। কিছুদিন আগে একটি সিংহলি গানমানিকে মাগে হিথে..’ ভাইরাল হয়েছিল। অতি সম্প্রতি ভূবন বাদ্যকারেরকাঁচা বাদামভাইরাল হয়েছে। কিন্তু বিষ্ময়ের ব্যাপার ইংরেজি অভিধান অনুযায়ীভাইরালশব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার কথা এক্ষেত্রে তার সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মূলত শাব্দিক অর্থের পরিবর্তে এখানে ভাবার্থই প্রাধান্য পেয়েছে। বিশেষ্যভাইরাস-এর গুণবাচক বিশেষণ হিসাবেভাইরালশব্দটির জনপ্রিয়তা। আবার আভিধানিক অর্থের ভিত্তিতে, ভাইরাস যেহেতু অতি দ্রুত বিস্তার লাভ করে তাই অতি দ্রুত বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে কোন বিষয় অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়া অর্থে ভাইরাল শব্দের ব্যবহার আভিধানিক স্বীকৃতি পেতেই পারেপার্থক্য একটাই, আভিধানিকভাবে এই ছড়িয়ে পড়া একটি বিষক্রিয়া অর্থাৎ ক্ষতিকারক আর সামাজিক মাধ্যমে এটি বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত ২০১৭ সালে গুগল, ইউটিউব, ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বা খোঁজ করা শব্দগুলোর মধ্যে ভাইরাল শব্দটি অন্যতম।

তবে সামাজিক মাধ্যমে এইভাইরালশব্দটির ব্যাপক ব্যবহারের একটা ইতিহাস আছে।  ২০০০ সালের ৩১ জুলাই মার্কিন লেখক সেথ গোডিনফাস্ট কোম্পানি ডট কমনামক ওয়েব সাইটে  আনলিশিং দ্য আইডিয়া ভাইরাসশিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যেখানে একটি লাইন ছিল Have the Idea behind your online experience go viral… সেই থেকেইভাইরালশব্দটির ভাইরাল হওয়ার সূত্রপাত। আর এখন তো গ্রামবাংলার মানুষও রানু মন্ডল বা ভূবন বাদ্যকারেরভাইরাল হওয়ার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। সেইসঙ্গে নেটদুনিয়ায় সর্বক্ষণ চলছে রাতারাতি ভাইরাল হওয়ার ইদুরদৌড়। বিষয়ের ভালো-মন্দ এক্ষেত্রে হয়ত মূল বিচার্য নয়, কত বেশি সংখ্যক মানুষ তার দর্শক সেটাই বিচার্য এতে কেউ হয়ত রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে উঠছেন আবার কেউ বা হয়ে উঠছেন খলনায়ক। ভূবন বাদ্যকারেরকাঁচা বাদামভাইরাল হয়ে তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন রাতারাতি, আবার একদা ভাইরাল হওয়া প্রশংসিত গায়িকা রানু মন্ডল পুনরায় ভাইরাল হয়েছেন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের পাত্রী হিসাবে। সুতরাং এই ভাইরালিজমের ভালো, মন্দ দুটো দিকই আছে। 

ভাইরাল-এর মত আরোও অনেক শব্দ সামাজিক মাধ্যমের বদান্যতায় বিশ্বময় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বলা যেতে পারে ইন্টারনেট তথা বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের কারনে ভাষাবিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। অনেক দেশে নিয়ে রীতিমত গবেষণা শুরু হয়েছে। ইউরোপের  ভাষাবিজ্ঞানী গবেষক ডেভিড ক্রিস্টালইনটারনেট লিঙ্গুইস্টিক্স(আন্তর্জালিক ভাষাবিজ্ঞান) নামে নতুন এক বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তিনি মনে করেন, একাডেমিক শৃঙ্খলায় একটি নতুন বিষয়ের সংযোজন করা খুব সহজ নয়, কিন্তু  ইন্টারনেটের আবির্ভাব ভাষাকে এতটাই প্রভাবিত করেছে যে ইন্টারনেটের ভাষা নিয়ে গবেষণা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই সমস্ত ভাষার স্থায়ীত্ব সাময়িক, খুব কম সময়ের ব্যবধানে এই ভাষা পরিবর্তিত হচ্ছে,

সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে বাংলাভাষীদের মধ্যেও ভাষার পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক মাধ্যমের কিছু শব্দ আজকাল বাংলাভাষীদের মধ্যে প্রায় মাতৃভাষার মতই উচ্চারিত তে শোনা যায়। এমনকি যারা ইংরেজী পড়তে পর্যন্ত পারে না তাদের মুখেও এই সমস্ত শব্দ স্বচ্ছন্দে উচ্চারণ করতে শোনা যায়। আবার ফেসবুক, হোয়াটসআপ-এর দৌলতে বাংলা ভাষাও বিকৃত হতে শুরু করেছে। বাক্য বা শব্দগুচ্ছ একত্র সংক্ষিপ্ত করার প্রবণতা এক নাটকীয় মোড় নিতে শুরু করেছে। আছে লেখা হচ্ছে a6 কিংবা রাইট বোঝাতে লেখা হচ্ছে r8. এছাড়াও বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিশিয়ে জগাখিচুরি মার্কা একটা বহুভাষিক পরিস্থিতি তৈরি করারও প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ইদানিং নেটিজেন শব্দটি বহুশ্রুত। সিটিজেন শব্দটা আজও যে তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে সেটাই  বিষ্ময়ের। যে সামান্য সংখ্যক নাগরিক এখনোও অন্তর্জালে আবদ্ধ হননি তাদের সৌজন্যেই বোধ হয় সিটিজেন শব্দটি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। অদূর ভবিষ্যতে যখন একশ শতাংশ মানুষই অন্তর্জালে বন্দি হবেন তখনই সিটিজেন তার অস্তিত্ব হারিয়ে নির্ঘাত নেটিজেন- রুপান্তরিত  হবে।

মোদ্দা কথা, ইন্টারনেট সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে চর্চিত ভাষা প্রমিত বাংলা যেমন নয়, তেমনি আঞ্চলিক বাংলাও নয়। এই মিশ্র ভাষারীতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গন্ডি ছাড়িয়ে আমাদের বাস্তব জীবনের ভাষা ব্যবহারকে বদলে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাষার এই পরিবর্তনে বদলে যাচ্ছে বাংলা ভাষা। আবির্ভাব ঘটছে এক মিশ্র প্রকৃতির ভাষারীতি।

সামাজিক মাধ্যমকে কেন্দ্র রে  বাংলা ভাষার এই বিকৃতি বাংলা ভাষা আর বাংলাভাষীদের পক্ষে কতটা গ্রহণযোগ্য তা বিবেচনার বিষয়। সামাজিক মাধ্যমের সৌজন্যে কিছু ইংরেজি বা বিদেশী  শব্দ বা শব্দগুচ্ছ বিশ্বময় জনপ্রিয় হচ্ছে কিন্তু যদি বাংলা শব্দ বা শব্দগুচ্ছও একইভাবে বিশ্ব ময় গ্রহণীয় হয়ে উঠত তাহলেই বোধ হয় বাংলা ভাষার সম্মান বাড়ত কারন বাংলা ভাষার উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে এই ভাষার আন্তর্জাতিকিকরণ অনেকটাই ভূমিকা রাখে।

ইন্টারনেট এখন যোগাযোগের অপরিহার্য শক্তিশালী মাধ্যম। আজ আর ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ব্যবহার বিনোদনের গন্ডিতে আবদ্ধ নেই,  রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিতর্ক, জনমত তৈরি, দাবি আদায়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেও এখন ব্যাপকভাবে ভূমিকা রাখছে এটি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের প্রভাবে পালটাতে শুরু করেছে আমাদের সামগ্রিক জীবনযাত্রা। ফেসবুক, ব্লগ প্রভৃতিতে চলছে বাংলা ভাষায় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা। ইন্টারনেটে  একদিকে যেমন বাংলার বিকৃত ব্যবহার বাড়ছে অন্যদিকে প্রমিত শুদ্ধ বাংলার ব্যবহারও রয়েছে। এভাবেই ভালো-মন্দে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেটের বাংলা ভাষা।

 

ভাষা ব্যবহারে তাই আমাদের সবারই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ভাষার নিজস্ব একটা সংস্কৃতি আছে, একটা ঐতিহ্য আছে। সুতরাং ভাষাকে বিকৃত করতে গিয়ে কোনভাবেই ভাষা যেন তার নিজস্ব ঐতিহ্য না হারায়, ভাষা কালিমালিপ্ত না হয়। বাংলা ভাষার বিশ্বজনীনতা কিন্তু এসেছে অনেক সংগ্রাম, রক্তক্ষয় আর বলীদানের মধ্যে দিয়ে। সুতরাং প্রতিটি বাংলাভাষীর উচিৎ বাংলা ভাষার যে কোন ঐতিহ্যহরণকারী বিকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করা।

বুধবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২১

শৈশবের বনভোজন

 শৈশবের বনভোজনঃ অমরনাথ কর্মকার 

শীত পড়লেই ছোটবেলার পিকনিকের কথা মনে পড়ে যায়। সত্যি বলতে কি শীতের হাওয়ার নাচন আমলকি বনে লাগল কি লাগল না, এসব চিন্তাভাবনা তখন মনেও আসত না। খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে শরীরে কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে শুয়ে। রেডিওতে খবর শুনতাম অমুক রাজ্যে শৈত্য প্রবাহ চলছে। তখন শৈত্যপ্রবাহ মানে ভাবতাম বরফ পড়া। একটু বড় হয়ে অবশ্য সঠিক মানেটা জানতে পেরেছি। সে যাই হোক শীত মানেই ছিল বনভোজন। তার না থাকত কোন পূর্ব পরিকল্পনা, না থাকত কোন বিশেষ স্থান নির্বাচন কিংবা বিশেষ আড়ম্বর। কয়েকজন ক্ষুদে মিলে মিটিং ক’রে ঠিক ক’রে নিতাম বনভোজনের দিন বা সময়। সত্যি বলতে কি ত খন আমাদের মধ্যে পিকনিক শব্দের প্রচলন খুব একটা ছিল না। বনভোজন বা চড়ুইভাতি বলতেই অভ্যস্ত ছিলাম। হয়ত দুপুর বেলা ঠিক করলাম বিকেলে বনভোজন হবে। মেয়েরা রান্নাবান্নার কাজ ভালো পারে ব’লে ওদেরকে সাথে রাখতাম । তারপর বাড়ি গিয়ে মায়ের কাছে একটা চায়ের কাপ নিয়ে কানে কানে মায়ের কাছে আবদার করতাম এককাপ চাল, দুটো আলু আর একটা ডিম দেওয়ার জন্য। পাছে বাবা জানতে পেরে রাগারাগি করে সেই ভয়ে গোপনে কাজ সারতে হ’ত। লাল্টুদের বড় মুদি দোকান ছিল, ওর ওপরে সর্ষের তেল আনার দায়িত্ব দেওয়া হ’ত।  ওই বয়সেও আমরা ধনী-গরীবের পার্থক্য বুঝতাম, তাই দায়িত্ব দেওয়ার সময় সেই পার্থক্য মাথায় রাখা হ’ত। যদিও বন্ধুত্বে সে পার্থক্য স্থান পেত না।  যেমন রতনরা খুব গরীব ব’লে নীলিমাই রতনের চাল, ডিম এনে দিত। নিষ্কলুষ সেই বন্ধুত্বের কথা আজ যখন ভাবি, বড্ড কষ্ট হয়। ভাত আর ডিমের ঝোল রান্না হল। শাকিবদের বাগানের এক কোনে সন্ধ্যে নামার আগেই বনভোজনের পালা সাঙ্গ। শীত পড়লে মাঝে মাঝেই এই আয়োজন চলত। তারপর একটু বড় হলে, মায়ের কাছে চাল, ডিম চাওয়ার পরিবর্তে বনভোজনের জন্য পয়সা চাওয়া শুরু হ’ল। বনভোজনে ডিমের পরিবর্তে মুরগীর মাংস এল। নিজেরা  মুরগী কাটতে পারব না ব’লে আমাদের চেয়ে বয়সে বড় কোন দাদাকে ডাকা হ’ত মুরগী কেটে দেওয়ার জন্য। মুরগী কেটে দেওয়ার সৌজন্যে সেই দাদাটির জন্য বনভোজনে খাওয়ার আমন্ত্রণ থাকত। শুধু মুরগীর মাংস আর ভাত ছাড়াও অনেক সময় ফুলকপির তরকারী, চাটনি এসবের ব্যবস্থাও করা হ’ত। তার জন্য একটু সাহসী বন্ধুদের অবদান থাকত। কারন আশপাশের মাঠ থেকে ফুলকপি বা টমেটো চুরির কাজটা তারাই করত। প্রাইমারী ইস্কুলে পড়া অবধি শীতকাল এভাবেই বনভোজনের আনন্দে কাটত। হাই ইস্কুলে ভর্তি হবার পর বনভোজনের ধরণ পাল্টাতে শুরু করল। ধীরে  ধীরে বনভোজন বা চড়ুইভাতি পিকনিকে রুপান্তরিত হ’ল। বনভোজন বা চড়ুইভাতির সঙ্গে পিকনিকের আভিধানিক অর্থের মিল যতই থাক, মানসিক অনুভূতি আর উপভোগ্যতায় এদের মধ্যে মনে হয় বিস্তর ফারাক।

গত দু’তিন দিন জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। এখন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে শৈশবের স্মৃতিবিলাসে মশগুল হয়ে ছোটবেলার বনভোজনের কথা মনে হচ্ছিল বারবার।

এখন এক-একেকটা পিকনিক বাবা-মায়েদের কাছে খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। ছেলে বা মেয়ে পিকনিক থেকে না ফেরা পর্যন্ত দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। এখন পিকনিক মানে শুধু হৈ হুল্লোড় ক’রে রান্না খাওয়া-দাওয়া নয়, থাকে বিনোদনের নেপথ্যে অনেক অশালীনতা, আধুনিকতার দোহাই দেওয়া অসদাচরন। এর মানে এই নয় যে জেনারেশন গ্যাপকে মাথায় রেখে নবীন প্রজন্মের পিকনিক আমাদের সময়ের থেকে খারাপ এই ধারণা পোষণ করছি। তবে মাঝে মাঝে ভাবি মাত্র অর্থ শতকের ব্যবধানে আচার-ব্যবহারের এতটা গুণগত পরিবর্তন হয়ে গেল। এটা আদৌ কোন শুভ লক্ষণ কিনা এব্যাপারে মাঝে মাঝে সন্দিহান হয়ে পড়ি।

আজ একটা জিনিস জানলাম যে Picnic শব্দটির উৎপত্তি ফরাসি শব্দ pique-nique থেকে যেটি ১৬৯২ সালে টনি উইলিস’এর ‘ওরিজিনস দি লা ল্যাঙ্গু ফ্র্যানচেইস’ বইতে ব্যবহৃত হয়েছিল যার অর্থ নিজেরা সঙ্গে ক’রে মদ নিয়ে রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে খাওয়া। জানিনা, এই কারনেই আমাদের ছোটবেলার বনভোজন বা চড়ুইভাতির সঙ্গে আজকের পিকনিকের এত অমিল কিনা !


মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?