সোমবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২০

করোনা সংক্রমণ ও ইতিহাসের শিক্ষা


করোনা সংক্রমণ ও ইতিহাসের শিক্ষা  - অমরনাথ কর্মকার
বিশ্বময় করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের ব্যাপকতায় বাংলার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কতকগুলি ইংরেজি  শব্দের পরিচিতি ঘটেছে ব্যাপকভাবে। ইংরেজি ভাষায় শব্দগুলো অতি সাধারণ কিন্তু শব্দগুলির আবির্ভাব,আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে,করোনা ভাইরাসের হাত ধরেই। অনেকটা ঠেকে শেখার মত। যেমন একদা কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে ‘লকআউট’ শব্দটি ছিল অতি পরিচিত। কারন কারখানা লকআউট হয়ে মাঝে মাঝেই প্রচুর শ্রমিক কাজ হারান। তবে লকআপ শব্দটির সঙ্গে আমরা প্রায় সকলেই কম-বেশি পরিচিত কারন পুলিশ আর অপরাধ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। করোনা ভাইরাসের দৌলতে জনপ্রিয় হওয়া ‘লকডাউন’ শব্দের অর্থ খুঁজতে কাউকেই বোধ হয় আর অভিধানের শরণাপন্ন হতে হয় না। কারন ঠেলায় প’ড়ে বাস্তবতার মধ্যে শব্দটির প্রকৃত অর্থ আমাদের মাথায় ঢুকে গেছে।
তবে লকডাউন, লকআউট, লকআপ শব্দের পার্থক্য জিজ্ঞেস করলে অনেকেই আমতা আমতা করবেন। না, কাউকে ইংরেজি শেখানো আমার উদ্দেশ্য নয়, তার জন্য ইংরেজির শিক্ষকমশাইদের অভাব নেই। আসলে লকডাউনে সময় কাটাতে গিয়ে এই চিন্তাভাবনাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ব’লে লিখে ফেললাম। একদম সরল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ‘লকআউট’ হ’ল কোন স্থানে বা ঘরে বাইরে থেকে কাউকে প্রবেশ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী ক’রে ঐ স্থান বা ঘর তালাবদ্ধ ক’রে রাখা । যেমন কোন কারখানায় লকআউট ঘোষিত হলে বাইরে থেকে শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশ করতে পারে না। পক্ষান্তরে, লকডাউন শব্দটি ঠিক বিপরীত অর্থ প্রকাশ করে। এক্ষেত্রে অর্থটি হ’ল কোন স্থান বা ঘর থেকে বাইরে আসার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা। উদ্দেশ্য ঐ স্থান বা ঘরের মধ্যে নিজেকে তালাবদ্ধ রেখে বাইরের শত্রু থেকে আত্মরক্ষা। বর্তমান লকডাউনের দিনে শত্রুপক্ষ কে তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এ এক আণুবীক্ষণিক অদৃশ্য ভয়ঙ্কর শত্রু। দুটি ক্ষেত্রেই কিন্তু স্থান বা ঘরে অবস্থানকারীরা কেউ বন্দী নন – শুধু সুরক্ষার কারনে স্বেচ্ছায় বন্দীদশার আবহ প্রস্তুত করা। তবে লকআপে থাকেন যারা তাদেরকে কোন ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করা হয় বন্দী হিসাবে। থানায় যাদের যাতায়াত আছে তারা নিশ্চয়ই এব্যাপারে ওয়াকিবহাল। তবে একথাও ঠিক, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার প্রয়োজনে দীর্ঘ লকডাউন দশায় আমাদের মানসিক লকআপ হতে চলেছে অর্থাৎ মানসিকভাবে আমরা নিজেদেরকে বন্দী ভাবতে শুরু করেছি।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে আর একটি শব্দ বা শব্দবন্ধ ‘সোস্যাল ডিসট্যান্সিং’ অনেকেরই মুখে মুখে ঘুরছে যার বাংলা প্রতিশব্দ ‘সামাজিক দূরত্ব’। সেই সাথে ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটিও বাজারে খুব চলছে যার অর্থ ‘পৃথকীকরণ’।
তবে এই ‘সামাজিক দূরত্ব’ বা ‘শারীরিক দূরত্ব’ বিষয়টি বর্তমান পরিস্থিতিতে বহুচর্চিত হ’লেও সংক্রামক ব্যাধির সংক্রমণ রোধে ঔষধবিহীন এই পন্থা বহুদিন আগে থেকেই প্রচলিত। মানুষে মানুষে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং পারস্পরিক সাক্ষাতের সংখ্যা হ্রাস এই পদ্ধতির মূল মন্ত্র।
এই সামাজিক দূরত্ব তৈরির প্রয়োজন পৃথিবীর বহু দেশেই ইতিপূর্বে হয়েছে। কুষ্ঠ রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারের আগে এই রোগের সংক্রমণ রোধের উদ্দেশে অষ্টাদশ শতকে ইতালির অ্যাংকোরা বন্দরনগরীর কাছে ‘দ্য ল্যাজারিটে অফ অ্যাংকোরা’ নামে একটি কৃত্রিম দ্বীপ প্রস্তুত করা হয় যেখানে মানুষজন কোয়ারেন্টিনে থাকতেন কুষ্ঠ রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে। তখনও কিন্তু আজকের মতই মুখ-শরীর ঢেকে রাখা হ’ত। ঐতিহাসিক ইতালিতে করোনা ভাইরাসে যে মৃত্যুর মিছিল চলছে তা অতীতের সব নজির ছাপিয়ে গেছে। এক করুন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলছে পৃথিবী।
১৯১৬ সালে নিউইয়র্ক শহরে পোলিও মহামারীর সময়  ২৭০০০ জন পোলিও আক্রান্তদের মধ্যে নিউইয়র্কে ২০০০ জন সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন ৬০০০ জনের মৃত্যু হয়েছে তখন নিউইয়র্ক শহরের সমস্ত অপেরা হাউস, পার্ক, রেস্তোরা বন্ধ ক’রে দেওয়া হয়েছিল। বন্ধ করা হয়েছিল সবরকম জমায়েত। ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারীতে ফিলাডেলফিয়াতে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল। প্রায় ২ লাখ লোকের প্যারেড ও জনসমাগমে ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ এমনভাবে ছড়িয়েছিল যে প্রায় এক সপ্তাহ হাসপাতালের কোন বেড খালি ছিল না এবং সাতদিনে ৪৫০০ জনের মৃত্যু ঘটেছিল এই রোগে। এই ঘটনার অব্যবহিত পরেই সেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।   
২০০৩ সালে সার্স যখন ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হ’তে শুরু করে তখনও মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব স্থাপনের চেষ্টা হয়। স্কুল-কলেজ, সিনেমা হল, বাজার, জনসমাগম সবকিছুই বন্ধ ক’রে দেওয়া হয়। সেই সময় কানাডাতে ‘কম্যুনিটি কোয়ারেন্টিন’ ব্যবহার ক’রে সার্সের সংক্রমণ রোধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল।  
এরপর এল ২০২০-এর করোনা হানা। আমরা এখন সেই করোনার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। এ এক কঠিন লড়াই। ইতিহাসের কাছে শিক্ষা নিয়ে আমরা যে লড়াইয়ে নেমেছি তাতে আমাদের বিজয় কেতন উড়বেই – শুধু সময়ের অপেক্ষা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?