শনিবার, ৭ জুলাই, ২০১৮

আজকের গৃহপরিচারিকারা

মনে পড়ছে মৃণাল সেনের ‘খারিজ’ চলচ্চিত্রটি যেখানে নাবালক পরিচারকের শ্বাসকষ্টের সমস্যার কথা জানা সত্ত্বেও মালিক তাকে শুতে দিয়েছিলেন কয়লার উনুন-জ্বলা রান্নাঘরে এবং ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পরিচারকের মৃত্যু ঘটেছিল। অথচ পুলিশের কাছে গৃহকর্তা জানিয়েছিলেন পরিচারককে তিনি নিজের সন্তানের মত দেখতেন। আমাদের রাজ্যে বর্তমান সময়ে সংসারের কাজের জন্য মহিলারাই সাধারণত নিয়োজিত হন। বলতে বাধা নেই, ব্যতিক্রম বাদ দিলে কাজের মাসি, কাজের মেয়ে এরা অভাবের তাড়নায় স্বামী, সন্তান, বাড়ি ছেড়ে প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি কাজে যায় এবং গৃহকর্তাদের আপাত সহানুভুতির অন্তরালে আসলে এদের অবস্থান কিন্তু দাসত্বেরই। ক্যানিং, লক্ষ্মীকান্তপুর, বনগাঁ লোকালে প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে মহিলারা কলকাতা বা তার আশেপাশের বাবুদের বাড়িতে কাজ করতে আসেন – মূলত একটু বেশি অর্থ রোজগারের উদ্দেশ্যে।আধুনিক ব্যস্ত জীবনে এই সমস্ত কাজের মাসি বা কাজের মেয়েদের প্রয়োজনটাও হয়ে উঠেছে অবশ্যম্ভাবী। কেউ বাবুদের বাড়িতে বাচ্চা সামলান, কেউ বাসন মাজে্ন, কেউ রান্না করেন আবার কেউ বা ছেলে-মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসার কাজ করেন। মূলতঃ এটা তাদের কর্মসংস্থান। কিন্তু অভাবগ্রস্থ এই সব গৃহপরিচারিকারা অনেক ক্ষেত্রেই মালিক শ্রেণির ইচ্ছার বা শখের দাসে পরিণত হন। আমি স্বচক্ষে দেখেছি এক গৃহকর্তাকে যিনি তার হতদরিদ্র গৃহপরিচারিকার সন্তানদের স্কুলে ভর্তি ক’রে পড়াশোনা করাতেন, এমনকি পরিচারিকার মেয়েকে নিজ অর্থ খরচ ক’রে ধুমধাম ক’রে বিয়ে পর্যন্ত দিয়েছিলেন। সে অবশ্য অনেক দিন আগের কথা। সময়ের সাথে সাথে গৃহপরিচারিকা আর গৃহকর্তার মধ্যে সম্পর্কেরও পরিবর্তন আসছে। মনিব ঈশ্বর, অন্নদাতা – এই প্রচলিত সামাজিক বিশ্বাসেও চিড় ধরেছে। ট্রেনে ফেরার সময় পরিচারিকাদের কথোপকথনে কানে আসে বাবুদের অন্যায় আচরণের কথা, একদিন কামাই করলে মাইনে কেটে নেওয়ার ক্ষোভ এরকম অনেক কিছুই। আবার অফিসের সহকর্মীকে কাজের মাসির খবর না দিয়ে ডুব মারার কারনে চরম দুর্ভোগে পড়ার কাহিনীও বলতে শুনি মাঝে মাঝে। বাড়িতে চুরির কিনারা করতে গিয়ে অনেক সময়ই বাড়ির কাজের মাসি ধরা পড়ে। এমনকি গৃহকর্তার বাড়িতে খুনের নেপথ্যেও অনেক সময় গৃহকর্মীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত থাকে। খবরের কাগজ খুললে এরকম খবর যেমন হামেশাই চোখে পড়ে, তেমনি বাড়ির কাজের মেয়ের প্রতি যৌন নির্যাতন বা নির্মম অত্যাচারের মত খবরও বাদ যায় না। যখন উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাড়িতে অর্থনৈতিক কাঠামোয় সমাজের সবচেয়ে নীচুতলার বাসিন্দারা কাজ করতে আসেন,স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের জন্য থাকে খারাপ ব্যবস্থা। একদিকে যেমন কম টাকায় বেশি কাজ করতে বাধ্য করা হয়অন্যদিকে শ্রমিক হিসাবে মর্যাদা দূরে থাক, মানুষ হিসাবে ন্যূনতম সম্মানটুকুও জোটে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। প্রতিদিনই অধিকাংশ কাজের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় এই পেশার সাথে যুক্ত মেয়েদের,কারুর কারুর উপর চলে শারীরিক নির্যাতনও।
বাড়িতে গৃহকর্মী নিয়োগের সময় গৃহকর্মীর তথ্য স্থানীয় থানায় জানিয়ে রাখার নিয়মও চালু আছে। অধিকাংশ বাড়িতে এখনো কাজের লোক বলে বাথরুম ব্যবহার করতে দেয় না,খেতে দেয় না জলটুকু পর্যন্ত। কোনো লিখিত চুক্তির ব্যবস্থা নেই বলে বেশিরভাগ দিনই কাজে ঢোকার আগে হওয়া মৌখিক চুক্তি লঙ্ঘন করেই চাপিয়ে দেওয়া হয় বাড়তি কাজ,থাকে না মাসে কোনো  সুনির্দিষ্ট ছুটির ব্যবস্থাও। পরিবারের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে দিনে পাঁচ-ছটা বাড়িতে কাজ নেওয়াপ্রত্যেক বাড়িতে দেড় থেকে দু-ঘণ্টা করে টানা কাজমাঝখানে ন্যুনতম বিশ্রামের অবকাশ মেলে না। একটানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রান্না করা বা নীচু হয়ে বাসন মাজার ফল পড়ে শরীরের উপর – হাত-পা-কোমরে ব্যথাসারাক্ষণ জল ঘাঁটার কারণে হাতেপায়ে হাজাসর্দি-কাশি-জ্বর লেগেই আছে। তার সঙ্গে সময়ে খাবার খেতে না পাবার  কারণে হওয়া আরও পাঁচটা সমস্যা পরিচারিকার কাজের সাথে যুক্ত মেয়েদের জীবনের নিত্য সঙ্গী।
আমি, আপনি সবাই ছোটবেলা  থেকে ঘরে কর্মসংস্থানের জন্যে আসা শ্রমিকটিকে দাস ভাবতে শিখি সামাজিক অবস্থাতেই। আমরা ক্লান্ততারা অক্লান্তএটাই স্বাভাবিক আমাদের শিক্ষায়। আমরা বয়োজ্যেষ্ঠদের আপনি সম্বোধন করতে শিখি অথচ একটু খেয়াল করে দেখবেন বাড়ির কাজের মাসিকে তুমি বা তুই বলে সম্বোধন করতেই আমরা অভ্যস্ত।  বিষয়টি মালিক শ্রমিকের সম্পর্কেরবয়স কোন বিষয় নানা শ্রমিকের জন্যনা মালিকের জন্য।
এই সামাজিক অবস্থানটি মেনে নিয়ে আইন এবং সামাজিক প্রতিবাদ এবং প্রতিকূল ব্যবস্থায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পরিচারিকারা একত্রিত হয়ে পথে নামবেন এতে গৃহস্থের জুজু দেখার কোন কারন দেখা যায় না।  গৃহকর্তা যেমন অর্থের বিনিময়ে পরিচারিকার কাছ থেকে কাজ বুঝে নেবেন তেমনি পরিচারিকারও অধিকার থাকবে উপযুক্ত পারিশ্রমিক বুঝে নেওয়ার, আইনানুগ ভাবে কাজের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ এবং নিয়মানুযায়ী ছুটি পাওয়া। দেশে যখন শ্রম আইন আছে তখন গৃহপরিচারিকাদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হওয়াটা জরুরী এবং তার জন্য তারা পথে নামবেন এটাই তো স্বাভাবিক। তাতে দু’ পক্ষেরই লাভ।   
-------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?