প্রথম দিনে অফিসে ঢুকে অফিস বসের কাছে যোগদানপত্র জমা দিয়ে
দোতলায় আমার নির্দিষ্ট কক্ষে ঢোকার মুখেই বিপত্তি । দেখলাম একদল বৃদ্ধ-বৃদ্ধা,
কিছু প্রতিবন্ধী প্রায় দরজা আগলে দাঁড়িয়ে । তাদের মধ্যে রয়েছেন কিছু অশীতিপর
মানুষও । ভেতর থেকে আমার এক সহকর্মী বেরিয়ে এসে তাদেরকে ধমক দিয়ে আমাকে ভেতরে নিয়ে
এলেন । নির্দিষ্ট কম্পিউটারের সামনে বসে পড়লাম । একটু ধাতস্ত হয়ে সেই সহকর্মীর
কাছেই জানতে পারলাম এই হতদরিদ্র বৃদ্ধ-বৃদ্ধা প্রতিবন্ধীরা মাঝে মাঝেই আসেন তাদের
প্রাপ্য মাসিক ভাতার খবর জানতে । আমার যোগদানের আগাম খবর পেয়ে এই কাজের দায়িত্বে
থাকা কর্মী বেশ কিছুদিন হ’ল কাজ-কম্ম শিকেয় তুলে বসে আছেন । ফলে এঁদের মাসিক ভাতা
বন্ধ হয়ে আছে । আমার যোগদানের খবর পেয়ে আমার কাছে তাঁদের দুর্দশা নিবারণের আর্জি
নিয়ে সকাল থেকে হত্যে দিয়ে বসে আছেন । সরকারী অফিসের নামে এত বদনামের বাস্তব কারণ
সেই প্রথম এতটা গুঢ়ভাবে উপলব্ধি করলাম । যাইহোক, সহকর্মী এবং আমার যৌথ অনুরোধে এবং
আগামী সপ্তাহে প্রাপ্য মেটালোর প্রতিশ্রুতি পেয়ে পিতৃ-মাতৃ স্থানিয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা
আমাকে আশীর্বাদ করে ফিরে গেলেন । সে যাত্রা রক্ষা পেলাম । এঁরা কেউ কেউ সমস্যা
নিয়ে এখনও প্রায়ই আসেন, চেষ্টা করি মেটাতে । মাসের শেষে আমাদের এক-দুদিনের
সংসার-খরচের সমতুল্য সামান্য অর্থ ভাতা পেয়ে যে পরিতৃপ্তির কুঞ্চিত মুখের হাসি
নিয়ে সামনে দাঁড়ান তাঁরা, তাতে মন ভরে যায় ।
আমি থাকি কম্পিউটার সেলে, কম্পিউটার নিয়েই কাজ-কারবার । সাজানো
গোছানো কাচের বড় ঘর । এই ঘরেই একমাত্র এসি’র ব্যবস্থা আছে । গরমকালে বাইরের লোকেরা
অফিসে এসে অনেকেই চ্যাঁচামেচি শুরু করে দেন কারণ অধিকাংশ কর্মীকেই খুঁজে পাওয়া যায়
না । আসলে গরমকালে অনেকেই আমাদের এসি ঘরে এসে বসে থাকেন । একবার তো এক রাজনৈতিক
নেতা অফিস বসের কাছে সরাসরি নালিশ করেছিলেন । তারপর থেকে অফিস বসের কড়া নির্দেশ
জারি হওয়ায় সেই প্রবনতা কমলেও নির্মূল হয়নি । আমাদের ঘরটা কাচে ঘেরা বলে শব্দ
বাইরে যায় না । তাই কোন সহকর্মীর পেছলে লাগার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করার এটাই আদর্শ
স্থান । বিশেষ করে, সিংজী, যিনি এই অফিসের একমাত্র অবাঙালি কর্মী, তার পেছনে লাগার
সবরকম কলা কৌশল এখানেই ঠিক হয় । তবে শেষ পর্যন্ত দোষের ভাগীদার হই একমাত্র আমি ।
মাঝে মাঝেই সিংজীর সাথে আমার বাক্যালাপ বন্ধ থাকে । তারপর প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের
পর আমি নির্দোষ প্রমাণিত হলে আবার শুরু হয় বাক্যালাপ । আদতে রাজপুত বংশীয় হলেও
উড়িষ্যায় মানুষ হওয়ার কারনে সিংজীর কথা-বার্তায় ওড়িয়া টান, যদিও তাঁর চেহারায়
রাজপুত বংশের ছাপ বেশ স্পষ্ট । সিংজী আদৌ রাজপুত নন একথা বললেই তিনি রেগে
অগ্নিশর্মা । এই দুর্বলতা কাজে লাগিয়েই তাঁকে রাগিয়ে দেওয়া আমাদের প্রায় রুটিন কাজ
। তবে অফিসের যে কোন অনুষ্ঠান লখান সিং (লক্ষ্মণ সিং বললে রেগে যান, যদিও ইচ্ছে
করে সবাই সেই নামেই ডেকে থাকে) অপরিহার্য । তাঁর নান্দনিক দিকটি সত্যিই প্রশংসনীয়
। মেকানিক শিশির বাবুকে কেউ কোনদিন অফিসে কাজ করতে দেখেনি। অথচ, তিনি প্রতিদিন উপস্থিত ।
বেশিরভাগ সময়ই তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখা যায় । রিটায়ারমেন্টেরও বেশি দেরি নেই ।
অফিস বস কাজ চাপিয়ে দিলে সহাস্যে তা গ্রহণও করেন কিন্তু
দিনের পর দিন পরে থাকে । শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে অফিস বস তা অন্যকে দেন । তখন
শিশিরবাবুর মুখে বিজয়ীর চটুল হাসি ‘কেমন দিলাম ?’ মিড-ডে মিলের সঞ্জয় একদিন অফিসে
না এলে অফিসটা কেমন যেন আলুনী লাগে । কারণ অফিসের বিভিন্ন কর্মচারীর বিচিত্র
স্বভাবের মিমিক্রি সঞ্জয়ের মুখে লেগেই থাকে । একদিন তো অফিসবসের মিমিক্রি করার সময়
অফিস বস কখন পেছন থেকে সেখানে এসে হাজির বুঝতেই পারেনি । অফিস বস একটুও না রেগে
বরং তার প্রশংসাই করেছিলেন । আমাদের অফিসে মহিলা কর্মচারী হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র
। অফিসের এক উচ্চপদাধিকারীর অতিরিক্ত মহিলাপ্রীতি আছে । ইলেকশনের কাজে অনেক সময়
অন্যান্য অফিস ও স্কুল থেকে অনেক মহিলা কর্মী নিয়োগ করা হয় । পূর্ব পরিকল্পনামাফিক
ওই সমস্ত মহিলাদের দায়িত্ব তাকেই দেওয়া হয় এবং অফিসের গ্রুপ-ডি থেকে শুরু করে সবাই
তাড়িয়ে তাড়িয়ে মহিলাদের সঙ্গে সেই আধিকারিকের ঢলাঢলি উপভোগ করে ।
অফিসের পলিটিক্স আছে, উপর মহলের চোখরাঙ্গানি আছে, কাজের চাপ
আছে কিন্তু পাশাপাশি এই উপভোগ্যতাগুলো আছে বলেই অফিস একঘেয়ে মনে হয় না । অফিস বস
কিংবা সহকর্মীর সঙ্গে মনমালিন্য হলে মন খারাপ হয়, সহকর্মীর অবসর গ্রহণের জন্য
আয়োজিত বিদায় অনুষ্ঠানে মন ভারাক্রান্ত হয়, চোখে জল আসে, কিন্তু দু’এক দিনেই আবার
সব ঠিক হয়ে যায় ।