ভূত চতুর্দশী – অমরনাথ কর্মকার ০৪/১১/২০২১
মাঝ রাতে উঠোনে দাঁড়িয়ে আশপাশের বাড়িগুলোতে আলোকসজ্জা দেখার চেষ্টা করছিলাম। নির্জন, নিঃশব্দ মধ্যরাত্রে অপূর্ব লাগছিল। ইংরেজদের শাসন থেকে আমাদের মুক্তি ঘটেছে বটে কিন্তু চীনারা সশরীরে এদেশে না এলেও তারা আমাদের দেশে চৈনিক রাজত্ব বিস্তার ক’রে ফেলেছে তাদের প্রযুক্তিপণ্য দিয়ে। এই যে আলোর এত চিত্তাকর্ষক বৈচিত্র্য তার সব কৃতিত্ব চীনাদের। প্রযুক্তির হাত ধ’রে চীন ঢুকে পড়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে । আগামী কাল কালী পূজো। মাঝরাত্রে একাকী আলোক মালায় সুসজ্জিত বাড়িগুলোর দিকে বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ভূত চতুর্দশীর কথাটা মাথায় এল। মনটা আকষ্মিক যেন টাইম মেশিনে চ’ড়ে ফিরে গেল ছোট বেলায়। ছোটবেলায় কালীপুজোর আগের রাত ছিল ভয়ঙ্কর। বড়দের মুখে শোনা ভূত চতুর্দশীর নানান ভয় ধরানো গল্প সরল মনের অন্দরে নির্দ্বিধায় ঢুকে গিয়ে মনে যে তান্ডব চালাতো তাতে সারা শরীর কম্বল চাপা দিয়ে, বাইরে বেরোনোর ভয়ে সমস্ত প্রাকৃতিক কর্ম কষ্ট ক’রে বন্ধ রেখে চোখ বুজে স্থির হয়ে শুয়ে থাকতাম। শত চেষ্টাতেও সহজে ঘুম আসত না। সামান্য শব্দও বিপদ সংকেত মনে হ’ত। মা পাশে থাকত। তবুও সে আশ্রয় নিরাপদ মনে হ’ত না। আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও আশপাশের প্রায় সবটাই অন্ধকার। এখনকার মত স্ট্রীট ল্যাম্পের ব্যবস্থা সর্বত্র ছিলনা। তাই প্রায় অন্ধকার পরিবেশ আর হাড় হিম করা ভূত চতুর্দশীর গল্প মনে যে ভয়ানক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত সেই সব কথা মনে হ’ল আজ। না, ভয় পাওয়ার বয়সও নেই, আর বিঃশ্বাসটাও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরল থেকে জটিল, জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। পড়াশুনা আর সচেতনতা দুয়ে মিলে কিছু অন্ধ বিশ্বাস কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, আবার কিছু সহজ সত্যকে মিথ্যা প্রমাণিত হতেও দেখছি চোখের সামনে। ফলে সরল মনে জটিলতাগুলো জট পাকিয়ে মনটা জটিলতর হয়ে উঠছে ক্রমশ। ভূত চতুর্দশীর ভয়ের গল্পে যে কোন সত্যতা নেই একথা একটু পেটে বিদ্যে থাকা মানুষ মাত্রেই জানেন। বিশেষ ক’রে শহুরে শিক্ষিত মানুষেরা, চারিদিকে সর্বক্ষণ আলোর রমরমায় যারা দিন আর রাতের ব্যবধান বোঝেন না তাঁদের কাছে ভূত চতুর্দশী কোন কৌতুহলের বিষয়ই নয়। শহরের বেশিরভাগই, বিশেষত কম বয়সীরা এই ধরণের শব্দ আদৌ শুনেছে কি না সন্দেহ আছে। একদা গ্রামে মানুষ হওয়ার সুবাদে ‘ভূত’ শব্দটার সঙ্গে আমার সম্যক পরিচয়। ভূতে বিশ্বাস করি কি না সে ব্যাখ্যায় না গিয়ে এটুকু বলতে পারি ভূতের অস্তিত্ব নিয়ে যে বইগুলো আছে সেগুলো পড়তে খুব ভালো লাগে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে এই বিষয়ে বই লেখা বন্ধই হয়ে যেত। গ্রামের মানুষের কাছে এখনোও ‘ভূত’ শব্দটার অস্তিত্ব আছে, সেই সাথে ‘ভয়’ও অস্তিত্বহীন হয়ে যায়নি। তার মুল কারন সেখানে মানুষের সারল্য আছে, সেই সাথে আছে শিক্ষার অভাবও। খুব আশ্চর্য লাগে শহুরে মানুষদের দেখে, যারা শিক্ষিত, সচেতন অথচ তাঁদের অনেকেই অনেক কৌতুহল চেপে রাখে আত্মমর্যাদা বজায় রাখতে গিয়ে। পাশের বাড়ির বা ফ্লাটের ছেলেটা ভালো খেলেছে বলে খবরের কাগজে ছবি বেরিয়েছে, সেটা দেখেও তিনি ছেলেটাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য ছোটেন না। আত্মমর্যাদা না ব’লে একে আত্মমর্যাদাহীনতা বলাই যুক্তিযুক্ত। ঘরে অসুস্থ মা বা বাবা, অবিলম্বে হাসপাতালে নেওয়া জরুরী, আশপাশের বাড়ি বা ফ্ল্যটের কেউ জানতেও পারলনা ঘটনাটা। বৃদ্ধ মা বা বাবা যখন অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হলেন, তখন অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনে ব্যালকনি থেকে বা জানলা দিয়ে দেখে বুঝতে পারলেন আশপাশের বাসিন্দারা। যান্ত্রিকতা যে এভাবে মানসিকতাকেও গিলে খাবে ধারণা ছিলনা। আত্মকেন্দ্রিকতা শহুরে মানুষের মনে এমন ভাবে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে যে অদূর ভবিষ্যতে সমাজ শব্দটার মানেই পাল্টে যাবে।
ভূত চতুর্দশী দিয়ে লেখা শুরু ক’রে কথা প্রসঙ্গে অনেক কথা চ’লে এল। আসলে আমি বলতে চাইছি আধুনিক শহুরে জীবন যাত্রায় ‘কৌতুহল’ শব্দটা ক্রমশ অবলুপ্তির পথে। কৌতুহল অনেক ক্ষেত্রে মানসিক আনন্দ দেয়। এগুলো মানসিক সারল্যের বহিঃপ্রকাশ। গ্রামের মানুষের মধ্যে এখনোও সারল্য আছে। হয়ত শিক্ষার অভাব আছে, কিন্তু এই শিক্ষার অভাব আছে ব’লেই তাঁদের মানবিকতা আছে। ভূত চতুর্দশীর ভূতের ভয়ে তাঁরা যেমন আতঙ্কিত হয়, তেমনি কেউ বিপদে পড়লে তাকে উদ্ধারের জন্য সবাই মিলে ছুটেও যায়, বিপদে আপদে একে অপরের পাশে দাঁড়ায়। আর শহুরে মানুষের শিক্ষা আছে, সচেতনতা আছে ব’লে এরা ভূতে বিশ্বাস করে না, আবার অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ানো তো দূরে থাক, ফিরেও থাকায় না।