নবমীতে
মন খারাপ – অমরনাথ কর্মকার
০৪/১০/২০২২
নবম
শ্রেণী শেষ করা মানে স্কুল জীবনের প্রান্তে হাজির হওয়া। আর দশম পাশ করলেই স্কুল
জীবনের ইতি। স্কুল জীবনের মত আনন্দঘন সময় কোথাও পাওয়া যায় না। বাঙালীর দুর্গোৎসবে
আজ নবমী। বিগত কয়েকদিনের অনাবিল আনন্দ-উচ্ছ্বলতার অবসানের নির্মম সঙ্কেত। মহানবমীর দিন হচ্ছে
দেবী দুর্গাকে প্রাণভরে দেখে নেওয়ার ক্ষণ।
অগ্নি সব দেবতার যজ্ঞভাগ
বহন করে যথাস্থানে পৌঁছে
দিয়ে থাকেন। আজই দুর্গাপূজোর অন্তিম
দিন। আগামীকাল কেবল বিজয়া ও
বিসর্জনের পর্ব। নবমীর রাত তাই বিদায়ের
অমোঘ পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয়েছে।
আজ তাই আধ্যাত্মিকতার চেয়েও অনেক বেশি লোকায়ত
ভাবনায় ভাবিত মন। আমার তো এমনিতেই মন খারাপ।
বলেইছি চারিদিকে যখন দুর্গাপুজোর উৎসব মুখরতা তখন আমার মন ভালো থাকে না। আজ নবমীতে
যখন উৎসবের আতিশয্য নিষ্প্রভ, মানুষের মনে যখন বিষাদময়তার মেঘ তখন আমার মনের মন
খারাপের মেঘ কাটতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। কিন্তু পরিবেশে উৎসবের গন্ধ ম্লান হচ্ছে
ব’লে নয়, সকলের চোখে-মুখে এক প্রতিকী মহিষাসুর মর্দিনীর বিদায়ে যে বিষন্নতার ছায়া,
তা দেখে আমার মনেও যে তার প্রভাব পড়ছে না তা কিন্তু নয়। আমিও তো এই সমাজেরই জীব (সামাজিক
জীব কি না বলা কঠিন)। গ্রাম বাংলায় আজও কোথাও কোথাও তিন-চারদিন বা সপ্তাহ জুড়ে
যাত্রা পালা অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতার নামীদামী যাত্রাদল আসে। প্যান্ডেল বাধা থেকে শুরু
ক’রে শেষ দিন পর্যন্ত এলাকার মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার জোয়ার বয়ে যায়, বিশেষ
ক’রে কম বয়সীদের মধ্যে আনন্দের অন্ত থাকে না। পাড়ায় পাড়ায় মাইকে অনর্গল প্রচার
চলতে থাকে। কিন্তু শেষ যাত্রা পালার দিন
মাইকে যখন প্রচার চলে ‘অদ্যই শেষ রজনী’ তখন মন খারাপ হ’তে শুরু করে। এই অভিজ্ঞতা
আমার আছে ব’লেই এই উপলব্ধি। আজ নবমী – স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি কারা যেন ঘন ঘন প্রচার
করছে ‘অদ্য শেষ রজনী’। সে শব্দের ডেসিবেল শূণ্য কিন্তু বুকের বাঁ পাশটায় ডিজে’র শব্দের
মত আঘাত হানছে ঘন ঘন। না, কোন পৌরাণিক কাহিনী বিশ্বাস ক’রে নয়, নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত
মানুষ উৎসবের আবহে সবকিছু ভুলে ছিল, কাল থেকে আবার সেই সমস্যার সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে
শুরু করবে – এই কথা ভেবে মন খারাপ করছে। আসলে উৎসবের আবিষ্টতায় আমরা, বিশেষত বাঙালীরা,
সেই মহালয়া থেকে শুরু ক’রে আজ অবধি যে ভাবে মগ্ন ছিলাম তা থেকে আকষ্মিক নিষ্ক্রমণ
আমাদের মন ভারাক্রান্ত করে। তাই নবমীতে দৃষ্টিভ্রমে কেউ দেখেন উমার চোখে জল। স্বামীর ঘরে উমার অশ্রুসজল প্রত্যাবর্তন
আসলে সাময়িক আনন্দ, হৈ-হুল্লোড় থেকে গতানুগতিক, কঠিন নৈমিত্তিক বাস্তবতায় ফিরে
যাওয়ার প্রতীক। সকলেরই আন্তরিক প্রত্যাশা সব ভেদাভেদ, দুঃখ-কষ্ট, মনোমালিন্য ভুলে
মিলেমিশে জীবনের শেষ অবধি জীবনের আনন্দ উপভোগ করা। কিন্তু এই ইউটোপিয় জীবনের
স্বপ্ন বাস্তবে আদৌ সম্ভব নয়। তাই ‘যেওনা নবমী নিশি’ ব’লে আর্তনাদ করাও থাকবে,
আবার সুখ-দুঃখ-কষ্ট সমৃদ্ধ জীবনে ফিরে যাওয়া থাকবে।
একটু
বাদেই নবমীর রাত শেষ হয়ে বিসর্জনের প্রভাত নামবে। মাটির প্রতিমা জলে গলে যাবে। রঙিন
থেকে আবার সাদা-কালো দিন। কিন্তু যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই উৎসবের আয়োজন সেই
উদ্দেশ্য সার্থক করতে পারাটাই আজ জরুরী।
বাস্তব
বড্ড কঠিন আর এই কঠিনটাই বাস্তব। নবমী শেষ হ’ল। আসলে কঠিন বাস্তবের সঙ্গে নিত্য
লড়াই করার অভ্যস্ত জীবনে ফিরে যেহেতু যেতেই হবে, তাই সামান্য ৫ দিনের আনন্দের চেয়ে
৩৬০ দিনের লড়াই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমার মন খারাপের মেঘ কেটেছে
অনেকটাই। বাঙালী উৎসবপ্রিয়। নবমীতেই যে উৎসব শেষ হয়ে গেল তা কিন্তু নয়। সবে তো উমা
গেলেন। এরপরে লক্ষ্মী আসবেন (অর্থনীতির বেহাল দশার হাল ফেরাতে পারবেন কি না
জানিনা), আসবেন মা কালী। এছাড়াও রয়েছে ভাইফোঁটা ইত্যাদি ইত্যাদি।
অনেক
হ’ল। আর নয়। কলম চললে থামতে চায় না, লাগাম টানলাম। কাল দশমীতেও কলম চালানোর ইচ্ছে
রইল। তবে কম চলবে। শুভ নবমী নিশি।