কেউ
ভিখারি নয় – অমরনাথ কর্মকার ১৪/০৯/২০২২
না,
কোনদিন আমি কাউকে ভিক্ষা
দিইনা। 'ভিক্ষা' শব্দটা আমার কাছে মনে
হয় বাংলা শব্দভান্ডার থেকে উঠিয়ে দেওয়া
উচিৎ, একই ভাবে 'ভিখারি'
শব্দটাও। আমার বারবার মনে
হয় পৃথিবীতে কেউই 'ভিক্ষুক' নয়। যাঁদেরকে আমরা
ভিখারি বা ভিক্ষুক বলি,
তাঁরা আসলে সাহায্যপ্রার্থী। সাধারনত
অপরিচিত, পোশাক পরিচ্ছদে ও চেহারায় দৈন্য
আছে এমন ব্যক্তি যখন
অর্থ প্রাপ্তির আশায় আপনার কাছে
কাকুতিমিনতি করে তখন আমরা
তাকে ভিখারি আখ্যায়িত করি। শুধু অর্থ
নয়, এরকম চেহারার কোন
প্রতিবন্ধী বা অন্ধ মানুষ
আপনার কাছে সাহায্য চায়,
তা অর্থ হ'তে
পারে, খাদ্য হ’তে পারে, হ’তে পারে বস্ত্র বা অন্য কিছু
তাকেও ভিক্ষুক বলি। অথচ এই
শব্দ প্রয়োগে একটা সাহায্যপ্রার্থী মানুষকে
কতটা হেয় করা হয়
তা অভাবনীয়। খুব সহজেই 'ভিখারি'
শব্দের প্রয়োগ কতটা হীন করতে
তার একটা উদাহরণ দিলেই
ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। ধরুন, বিয়ে
বাড়িতে খেতে ব'সে
দেখলেন কোন এক নিমন্ত্রিত
খুব বেশি খাচ্ছেন। পাশ
থেকে হয়ত কেউ একজন
মন্তব্য ক'রে বসলেন
- একেবারে ভিখারির মত খাচ্ছে' এবং
কথাটা ওই ব্যক্তির কানেও
গেল। তারপর সেই ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া
কি হবে ভেবে দেখেছন? হ্যাঁ,
এই সাহায্য প্রার্থীর প্রকারভেদ আছে। কেউ স্বভাবগত
ভাবে সাহায্য প্রার্থনা করে, কেউ শারীরিক
পরিশ্রম না ক'রে
পরের কাছে সাহায্যে নিয়ে
জীবন ধারণের পথ খোঁজে। এরা
মূলত প্রতারক। পথে-ঘাটে চলতে
গিয়ে এরকম প্রতারক প্রায়শই
চোখে পড়ে। আবার একদল
মানুষ আছে যারা ধর্মের
নামে, ঈশ্বরের গুনগান গেয়ে অর্থোপার্জনের জন্য
অন্যের দিকে হাত বাড়ায়।
এরাও মানুষের মনে ধর্ম বা
ঈশ্বরের ভাবাবেগ জাগিয়ে প্রতারণা করে। সত্যিকারের সাহায্যপ্রার্থীর
সংখ্যা দুর্লভ বলেই বহুদিন আগে
থেকেই আমি রাস্তা-ঘাটে
এই ধরণের কাউকে অর্থসাহায্য করা বন্ধ করেছি।
না, সাহায্য একেবারে যে করি না
তা কিন্তু নয়। ক'দিন
আগে ট্রেনে শিয়ালদা যাচ্ছিলাম। গড়িয়া থেকে এক অন্ধ
প্রতিবন্ধী উঠলেন। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুরু
করলেন খঞ্জনী বাজিয়ে। আমার মন ভারাক্রান্ত
হ’ল। ভাবছেন অন্ধ প্রতিবন্ধী রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন ব’লে আমি আবেগাপ্লূত হলাম ? না
আদৌ তা নয়। তিনি যে গানটি গাইলেন তা চলন্ত ট্রেনের কামড়ায় গেয়ে তাঁদের মনোরঞ্জন করা
সম্ভব কি না তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অথচ অন্ধ লোকটি খঞ্জনী বাজিয়ে একাগ্র
চিত্তে একেবারে নির্ভুল সুর, তাল ছন্দে গেয়ে চললেন ‘আধেক ঘুমে নয়ন চুমে’। আমি বিষ্মিত
হলাম। তাঁর সঙ্গে থাকা ছোট্ট ছেলেটির হাতে ধরা বাটিতে সামান্য দু’একজনের ফেলা মুদ্রার
আওয়াজ শোনা গেল মাত্র। আমি তাঁকে কাছে ডেকে গানটি আর একবার শোনানোর অনুরোধ জানালাম।
কিন্তু তখন ট্রেন যে শিয়ালদা স্টেশনে ঢুকে গেছে বুঝতে পারিনি। ইচ্ছেটা অপূর্ণই রয়ে
গেল। তাঁকে অর্থ সাহায্য করলাম বটে কিন্তু
তাতে মন ভরল না। এঁকে ভিক্ষুক বলতে ইচ্ছে হয় ? আবার এও দেখেছি লাঠি ভর দিয়ে খোঁড়াতে
খোঁড়াতে ট্রেনের কামরায় যাত্রীদের সহানুভূতি আদায় ক’রে পয়সা নেওয়া লোকটা কামরা থেকে
নেমে দৌড়ে পরের কামড়ায় উঠে আবার একই ছদ্মবেশ ধারন করছে। না, এরাও ভিখারি নয়, এরা প্রতারক।
এই ধরণের প্রতারক সমাজের সর্বত্র ছেয়ে গেছে। নেতা,মন্ত্রীরাও এই ধরণের প্রতারনা করেন,
খবরের কাগজের শিরোনাম হন। ভোটের আগে করজোড়ে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আদায় ক’রে ভোটে জিতে সমাজ সেবার নামে নানা ভাবে অর্থ
লোপাট করেন। এঁদেরকে ভিখারি বিশেষণে বিশেষিত করলে ব্যপারটা কোন দিকে গড়াবে একবার ভেবে
দেখেছেন কখনো ? এঁদের প্রতারনা যখন খবরের কাগজের প্রাত্যহিক সংবাদ শিরোনাম হয়, কিংবা
টিভিতে সর্বক্ষণ এঁদের প্রতারণার সংবাদ পরিবেশিত হয়, তখন দারিদ্রপীড়িত সাধারণ মানুষের
ছোটখাট প্রতারণা নিতান্তই লঘু মনে হয়। বাংলা ব্যাকরণে সম্প্রদান কারক ক্রমশ অবলুপ্ত
হয়ে গেছে। আমাদের সময় ‘ভিখারিকে ভিক্ষা দাও’ ছিল সম্প্রদান কারক আর ‘ধোপাকে কাপড় দাও’
ছিল কর্মকারক। যুক্তি ছিল, ভিখারীকে ভিক্ষা দেওয়ার বিনিময়ে কোন প্রাপ্তির প্রত্যাশা নেই, অর্থাৎ এটি একপ্রকার
নিঃস্বার্থ দান। কিন্তু ধোপাকে কাপড় দিলে ধোয়া-কাচার পর সেই কাপড় ফেরত আসবে, অর্থাৎ
এটি দান নয়, তাই এটি কর্মকারক। কিন্তু এই যুক্তির ব্যাপারে মতবিরোধ এড়াতে সম্প্রদান
কারককে তুলে দিয়ে শুধুমাত্র কর্মকারককে রেখে দেওয়া হ’ল। কারন কোন
দানই নিঃস্বার্থ নয়। ঠিক একই যুক্তিতে ভিক্ষুক বা ভিখারি শব্দটি তুলে দিয়ে ‘সাহায্যপ্রার্থী’
শব্দটি পরিবর্ত হিসাবে ব্যবহার করলে অন্ততঃ কাউকে হেয় করা হয় না।
সেই
বছর দশেক আগে ‘আধেক ঘুমে নয়ন চুমে’ গাওয়া অন্ধ মানুষটাকে সামান্য অর্থ সাহায্য করার
পর আজ বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় আর একজন মহিলাকে অর্থসাহায্য করলাম। ক্যানিং স্টেশনে
স্টলে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি। দেখলাম কয়েক হাত দূরে এক বয়স্কা মহিলা দাঁড়িয়ে। জীর্ন নোংরা
শাড়ি। না, সাহায্য দেওয়ার আবেদন করেন নি। এমনকি আমার চা খাবার সময় আমার দিকে লোলুপ
দৃষ্টিতে তাকিয়েও ছিলেন না। মুখটার সঙ্গে আমার মায়ের মুখের মিল পেলাম। উনি অন্য দিকে
আনমনে তাকিয়ে ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম ‘চা খাবেন ?’। উত্তর দিলেন না। মনে হ’ল খেতে আপত্তি
নেই অথচ ‘হ্যাঁ’ বলার একটা দ্বিধা কাজ করছে। দোকানের ছেলেটাকে এক কাপ চা আর বিস্কুট
দিতে বললাম। ছেলেটি দিল। মহিলা নিলেন । কিন্তু চোখে মুখে পাওয়ার বিন্দুমাত্র বহিঃপ্রকাশ
দেখলাম না। ট্রেন ছেড়ে দেবে ব’লে দোকানদারকে পয়সা মিটিয়ে দিয়ে দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম।
কিছুটা যাবার পর আবার ফিরে এলাম। দেখলাম ঐ মহিলা প্লাটফর্মের মেঝেতে ব’সে চা-বিস্কুট
খাচ্ছেন। কাছে যেতে আমাকে দেখলেন। কিন্তু তখনও ভাবলেশহীন। হাতে কুড়িটা টাকা দিয়ে আবার
দ্রুততায় চললাম ট্রেন ধরতে। ট্রেনে ব’সে ব’সেই মোবাইল ফোনে লিখছি এখন। সেই মহিলার মুখটা
এখনও চোখের সামনে ভাসছে। ভাবছি ‘আত্মমর্যাদা’ সকলের মধ্যেই আছে। আমরা বিপদগ্রস্থ হ’লে
অন্যের সাহায্য প্রার্থনা করতে দ্বিধা বোধ করি। কেন জানিনা বার বার মনে হচ্ছে ঐ মহিলার
ভাবলেশহীন মুখ তাঁর আত্মমর্যাদার প্রতিফলন নয় তো ? হয়তো কোন প্রতিকূল পরিস্থিতির কারনে
তাঁর এই পরিণতি। কে জানে ! ভিড় ট্রেনে ঠেলাঠেলি ক’রে গন্তব্যে নেমে পড়লাম। একটু আগের
অনুভূতি মিলিয়ে গেল বাস্তবের গড্ডলিকা প্রবাহে। বাড়ি ফিরে টিভিতে মুখরোচক রাজনীতির
খবর, রাতের খাওয়া, ঘুম, সকাল, অফিস এভাবেই দিন চলে যায়। কে কার খবর রাখে ?