বুধবার, ৩ নভেম্বর, ২০২১

ভূত চতুর্দশী

ভূত চতুর্দশী – অমরনাথ কর্মকার ০৪/১১/২০২১ মাঝ রাতে উঠোনে দাঁড়িয়ে আশপাশের বাড়িগুলোতে আলোকসজ্জা দেখার চেষ্টা করছিলাম। নির্জন, নিঃশব্দ মধ্যরাত্রে অপূর্ব লাগছিল। ইংরেজদের শাসন থেকে আমাদের মুক্তি ঘটেছে বটে কিন্তু চীনারা সশরীরে এদেশে না এলেও তারা আমাদের দেশে চৈনিক রাজত্ব বিস্তার ক’রে ফেলেছে তাদের প্রযুক্তিপণ্য দিয়ে। এই যে আলোর এত চিত্তাকর্ষক বৈচিত্র্য তার সব কৃতিত্ব চীনাদের। প্রযুক্তির হাত ধ’রে চীন ঢুকে পড়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে । আগামী কাল কালী পূজো। মাঝরাত্রে একাকী আলোক মালায় সুসজ্জিত বাড়িগুলোর দিকে বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ভূত চতুর্দশীর কথাটা মাথায় এল। মনটা আকষ্মিক যেন টাইম মেশিনে চ’ড়ে ফিরে গেল ছোট বেলায়। ছোটবেলায় কালীপুজোর আগের রাত ছিল ভয়ঙ্কর। বড়দের মুখে শোনা ভূত চতুর্দশীর নানান ভয় ধরানো গল্প সরল মনের অন্দরে নির্দ্বিধায় ঢুকে গিয়ে মনে যে তান্ডব চালাতো তাতে সারা শরীর কম্বল চাপা দিয়ে, বাইরে বেরোনোর ভয়ে সমস্ত প্রাকৃতিক কর্ম কষ্ট ক’রে বন্ধ রেখে চোখ বুজে স্থির হয়ে শুয়ে থাকতাম। শত চেষ্টাতেও সহজে ঘুম আসত না। সামান্য শব্দও বিপদ সংকেত মনে হ’ত। মা পাশে থাকত। তবুও সে আশ্রয় নিরাপদ মনে হ’ত না। আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও আশপাশের প্রায় সবটাই অন্ধকার। এখনকার মত স্ট্রীট ল্যাম্পের ব্যবস্থা সর্বত্র ছিলনা। তাই প্রায় অন্ধকার পরিবেশ আর হাড় হিম করা ভূত চতুর্দশীর গল্প মনে যে ভয়ানক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত সেই সব কথা মনে হ’ল আজ। না, ভয় পাওয়ার বয়সও নেই, আর বিঃশ্বাসটাও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরল থেকে জটিল, জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। পড়াশুনা আর সচেতনতা দুয়ে মিলে কিছু অন্ধ বিশ্বাস কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, আবার কিছু সহজ সত্যকে মিথ্যা প্রমাণিত হতেও দেখছি চোখের সামনে। ফলে সরল মনে জটিলতাগুলো জট পাকিয়ে মনটা জটিলতর হয়ে উঠছে ক্রমশ। ভূত চতুর্দশীর ভয়ের গল্পে যে কোন সত্যতা নেই একথা একটু পেটে বিদ্যে থাকা মানুষ মাত্রেই জানেন। বিশেষ ক’রে শহুরে শিক্ষিত মানুষেরা, চারিদিকে সর্বক্ষণ আলোর রমরমায় যারা দিন আর রাতের ব্যবধান বোঝেন না তাঁদের কাছে ভূত চতুর্দশী কোন কৌতুহলের বিষয়ই নয়। শহরের বেশিরভাগই, বিশেষত কম বয়সীরা এই ধরণের শব্দ আদৌ শুনেছে কি না সন্দেহ আছে। একদা গ্রামে মানুষ হওয়ার সুবাদে ‘ভূত’ শব্দটার সঙ্গে আমার সম্যক পরিচয়। ভূতে বিশ্বাস করি কি না সে ব্যাখ্যায় না গিয়ে এটুকু বলতে পারি ভূতের অস্তিত্ব নিয়ে যে বইগুলো আছে সেগুলো পড়তে খুব ভালো লাগে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে এই বিষয়ে বই লেখা বন্ধই হয়ে যেত। গ্রামের মানুষের কাছে এখনোও ‘ভূত’ শব্দটার অস্তিত্ব আছে, সেই সাথে ‘ভয়’ও অস্তিত্বহীন হয়ে যায়নি। তার মুল কারন সেখানে মানুষের সারল্য আছে, সেই সাথে আছে শিক্ষার অভাবও। খুব আশ্চর্য লাগে শহুরে মানুষদের দেখে, যারা শিক্ষিত, সচেতন অথচ তাঁদের অনেকেই অনেক কৌতুহল চেপে রাখে আত্মমর্যাদা বজায় রাখতে গিয়ে। পাশের বাড়ির বা ফ্লাটের ছেলেটা ভালো খেলেছে বলে খবরের কাগজে ছবি বেরিয়েছে, সেটা দেখেও তিনি ছেলেটাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য ছোটেন না। আত্মমর্যাদা না ব’লে একে আত্মমর্যাদাহীনতা বলাই যুক্তিযুক্ত। ঘরে অসুস্থ মা বা বাবা, অবিলম্বে হাসপাতালে নেওয়া জরুরী, আশপাশের বাড়ি বা ফ্ল্যটের কেউ জানতেও পারলনা ঘটনাটা। বৃদ্ধ মা বা বাবা যখন অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হলেন, তখন অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনে ব্যালকনি থেকে বা জানলা দিয়ে দেখে বুঝতে পারলেন আশপাশের বাসিন্দারা। যান্ত্রিকতা যে এভাবে মানসিকতাকেও গিলে খাবে ধারণা ছিলনা। আত্মকেন্দ্রিকতা শহুরে মানুষের মনে এমন ভাবে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে যে অদূর ভবিষ্যতে সমাজ শব্দটার মানেই পাল্টে যাবে। ভূত চতুর্দশী দিয়ে লেখা শুরু ক’রে কথা প্রসঙ্গে অনেক কথা চ’লে এল। আসলে আমি বলতে চাইছি আধুনিক শহুরে জীবন যাত্রায় ‘কৌতুহল’ শব্দটা ক্রমশ অবলুপ্তির পথে। কৌতুহল অনেক ক্ষেত্রে মানসিক আনন্দ দেয়। এগুলো মানসিক সারল্যের বহিঃপ্রকাশ। গ্রামের মানুষের মধ্যে এখনোও সারল্য আছে। হয়ত শিক্ষার অভাব আছে, কিন্তু এই শিক্ষার অভাব আছে ব’লেই তাঁদের মানবিকতা আছে। ভূত চতুর্দশীর ভূতের ভয়ে তাঁরা যেমন আতঙ্কিত হয়, তেমনি কেউ বিপদে পড়লে তাকে উদ্ধারের জন্য সবাই মিলে ছুটেও যায়, বিপদে আপদে একে অপরের পাশে দাঁড়ায়। আর শহুরে মানুষের শিক্ষা আছে, সচেতনতা আছে ব’লে এরা ভূতে বিশ্বাস করে না, আবার অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ানো তো দূরে থাক, ফিরেও থাকায় না।

শুক্রবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২১

দশমীতে মন খারাপ - ১৫/১০/২০২১

দশমীতে মন খারাপ ১৫/১০/২০২১ – কথা যখন দিয়েছিলাম ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতি বছরের মত এবারেও মন খারাপের বৃত্তান্ত লিখব, তখন লিখতেই হবে। তাছাড়া সব ভালো যার শেষ ভালো। যদিও শেষটা ভালো হ’ল না, কারন দিনের শেষে আকাশ চোখ রাঙাতে শুরু ক’রে এখনোও চালিয়ে যাচ্ছে তার খামখেয়ালিপনা। আজ তো স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ সবার। আমার মন খারাপ ভিন্ন কারনে। উৎসব শেষ হয়্রে গেল ব'লে একটুও নয়। আমার খারাপ লাগছে বিজয়া দশমীতে পারস্পরিক মিলনের করুন অবস্থা দেখে। কোভিডের আতঙ্কে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে তো এতদিন অনেক কিছুই চলল। কিন্তু কোলাকুলি, প্রণাম, আশির্বাদ এগুলো কি ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে সম্ভব। স্পর্শ না থাকলে অনুভূতি অনুপস্থিত। মানুষ তো আর রোবট নয়, রীতিমত রক্ত-মাংসে গড়া। অতএব, স্পর্শ ছাড়া অনুভূতি আসা অসম্ভব। হ্যাঁ, মন দিয়েও অনুভূতির আস্বাদ মেলে। সে তো ব্যতিক্রমী উচ্চ দর্শন। প্লেটোনিক প্রেম, ইউটোপিয়া এসব সাধারণ ব্যাপার-স্যাপার নয়। কোলে কোলে মিলনের নাম কোলাকুলি। অতএব সোস্যাল মিডিয়ায়, অন লাইনে কোলাকুলি আদৌ সম্ভব নয়। বিদেশ থেকে বাবা ছেলেকে যতই আশির্বাদ করুন ভিডিও কলে, আশির্বাদের হাত তো আর ছেলের মাথায় পড়ে না! কিংবা বাবার পায়ে ছেলের হাতের স্পর্শ পেলে বাবার যে অনুভূতি হয় তা কি ভার্চুয়াল মাধ্যমে সম্ভব? মোটকথা এগুলো মূলত যান্ত্রিকতা, মানবিকতা বা সামাজিকতা কোনটাই নয়। গত বছরের মত এবছরেও দশমীতে বাঙালীর এই বঞ্চনা প্রবহমান। জানিনা, এই বঞ্চনাই একদিন হয়ত স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হবে কি না। কল্পবিজ্ঞানের বিখ্যাত লেখক উইলিয়াম গিবসনের স্বকপোলকল্পিত 'ভার্চুয়াল জগত' আজ কল্পবিজ্ঞানের গণ্ডী ছাড়িয়ে সটান হাজির আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। মানুষে মানুষে যে যোগাযোগ ও লেনদেন তা বাস্তব জীবনের বিপরীতে বিশ্বজনীন করার স্বপ্ন সত্যি সত্যিই আজ সফল হতে চলেছে এবং কোভিড-১৯ নামক অপ্রত্যাশিত অতিমারীর প্রভাব নিঃসন্দেহে একে ত্বরান্বিত করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের মত অনুন্নত দেশে ভার্চুয়াল পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা কতটা? যে দেশে অধিকাংশ মানুষ কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন ব্যবহার তো দূরের কথা,বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহের জন্যে হিমশিম খায় সেখানে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে পড়াশুনা চালানো বা নানাবিধ কাজ সম্পন্ন করা সত্যি দুরুহ। আর শিক্ষার হার কম হবার কারনে অত্যাধুনিক এই ভার্চুয়াল ব্যবস্থার ইতিবাচক দিক নিয়েও অনেকে সন্দিহান। ফলে উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মত আমাদের দেশে ভার্চুয়াল যোগাযোগ দ্রুত সর্বজনীন হওয়া সম্ভব নয়। তবুও শত অসুবিধা সত্ত্বেও নিরুপায় হয়ে মানুষকে এই ভার্চুয়াল পথেই হাঁটতে হচ্ছে। গত বছর বেশির ভাগ মানুষই বাড়িতে ব’সে টিভিতে বা সামাজিক মাধ্যমে পুজোর আনন্দ উপভোগ করেছে। এবারে করোনার প্রকোপ কম থাকায় দুর্গাপুজো্র আনন্দ ফিরেছিল অনেকটাই স্বাভাবিক ছন্দে। কিন্তু এই ছন্দে ফিরতে গিয়ে যে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে তাতে আগামী বছরের পরিণাম নিয়ে চিকিৎসক মহন যথেষ্ট সন্দিগ্ধ। তবে আশা করব, মানুষ মানুষের পাশে থাকুক সশরীরে, ভার্চুয়াল পথে আর যাই হোক মেলামেশার অনুভূতিটা ঠিক পাওয়া যায় না। মুখচ্ছদে ঢাকা মুখ মুখোশ মনে হয়। মনটা ভালো হতে শুরু করেছিল এমনিতেই। তারপর এতগুলো মনের কথা শব্দের আকারে সাজিয়ে তুলে মনটা আরোও খানিকটা হাল্কা লাগছে। শেষ পাতে দই-এর মত লেখার শেষে আমার লেখা একটা ছড়া পরিবেশন না ক’রে পারছি না। মন খারাপের সুরঃ অমরনাথ কর্মকার রঙ বেরঙে এই ক’টা দিন কাটলো ভালো আজকে হঠাৎ পালটে গিয়ে সাদা-কালো। এই ক’টা দিন বাজছিল ঢাক ঢ্যাং কুরাকুর আজকে কেন বাজছে তবে মন খারাপের সুর ? ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষন ? ঠাকুর যাবে বিসর্জন।‘ সবাইকে শুভ বিজয়ার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে এবং সারাবছর সকলের সুস্থতা ও শান্তি কামনা ক’রে এবছরের মত ‘পুজোয় মনখারাপ’ শেষ করলাম। শুভরাত্রি।

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?