রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

বসন্ত থেমে গেল

 

বসন্ত থেমে গেল  - অমরনাথ কর্মকার ০৬/০২/২০২২

 

ভারতের সঙ্গীত জগতের নক্ষত্র পতন আজ। ভারত তথা পৃথিবীর ইতিহাসের বিরল কন্ঠ থেমে গেল আচমকাই। আজ ছোট বেলার একটা স্মৃতি খুব মনে পড়ছে বার বার। আমাদের ছোট বেলায় টিভির পর্দায় এত সিনেমা দেখার সুযোগ ছিল না। তার চেয়েও বড় কথা, তখন খুব বিত্তশালী ছাড়া কারো বাড়িতে টিভি থাকাটা ছিল এক বিরল ঘটনা। কখনো কখনো ক্লাবে গিয়ে দূরদর্শন বা বাংলাদেশ টেলিভিশনের ঝিরঝিরে সম্প্রচার দেখতে অ্যান্টেনার মুন্ডু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আর মোবাইল ফোন ? সে ছিল নেহাতই কল্প বিজ্ঞানের গল্প। মোট কথা বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচিত হবার পথ ছিল অতি দুর্গম। খবরের কাগজ সেই অভাব খানিকটা পূরণ করত বটে, কিন্তু প্রতিদিন পাঠকের মাথার ওপর হুমড়ি খেয়ে খবর পড়তে প্রতিদিন ভালোও লাগত না। আবার প্রতিদিন খবরের কাগজ কেনার সাধ্য সাধকে সহায়তা করত না। মোদ্দা কথা আমাদের ছেলেবেলায় এখনকার মত পৃথিবী হাতের মুঠোয় থাকত না। ফলে জানাশোনার পরিধি ক্লাসের বই কিংবা পাড়ার লাইব্রেরীর সীমিত বইএর বৃত্তেই আবদ্ধ থাকত। কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমি অনেকটা বড় হয়ে লতা মঙ্গেশকার নামক কিংবদন্তীর নাম শুনেছি। লতাজীর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর আমার শৈশবের একটা স্মৃতি একদম স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল মনে।

    আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় কিমি দূরে ছিল আমাদের অঞ্চলের একমাত্র সিনেমা হল। সিনেমা হলের মাথায় স্থায়ীভাবে বসানো ছিল মাইক প্রতিদিন ঠিক দুপুর দুটোর সময় সিনেমা হল থেকে গান ভেসে আসত। এটাই ছিল দুপুরের শো শুরু হওয়ার আগাম বার্তা। প্রতিদিন, নিয়মের বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় না ঘটিয়ে, পর্যায়ক্রমে কয়েকটি নির্দিষ্ট গান বাজত যার মধ্যে প্রথমটি ছিল নিঝুম সন্ধ্যায় …’, দ্বিতীয়টি ছিলআকাশ প্রদীপ জ্বলে…’, তৃতীয়টি ছিলম্যানে দোলে …’ এবং আরোও কয়েকটি যেগুলো এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। ঠিক আড়াইটে বাজলেই গান থেমে যেত অর্থাৎ সিনেমা শুরু হয়ে গেল। কার কন্ঠ, কার সুর কার কথা তখন এসব কিছুই বুঝতাম না, বোঝার চেষ্টাও করতাম না। তবে প্রতিদিন শুনতে শুনতে সুর রপ্ত রে ফেলেছিলাম, গানের কথা পুরো বুঝে উঠতাম না লে মন গড়া শব্দ বসিয়ে নিতাম। একটু বড় হয়ে জানতে পারলাম সেই গানের কন্ঠ ছিল লতা মঙ্গেশকারের। আজ লতাজীর মহাপ্রয়াণে ছোট বেলায় শোনা সেই গানগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে আর মনে পড়ছে আমার সেই সব মনগড়া শব্দ যা দিব্যি গানের কথায় অবলীলায় বসিয়ে নিতাম। আমার জীবনের শুরু থেকেই যে কোকিল প্রতিদিন গান শোনাত, ভেবেছিলাম সেই কোকিলের গানেই জীবন কাটবে বসন্তে।  কিন্তু হল কই ? আজ সেই কোকিলের কন্ঠ থেমে গেল, মনে হচ্ছে আমার জীবনের বসন্তও থেমে গেল

    ভারতের সঙ্গীত জগতে তিনি সুদীর্ঘ দিন বসন্তের কোকিল হয়েই বিরাজমান ছিলেন। আজ হঠাৎই যেন ঋতু পরিবর্তন ঘটল সেখানে। ঋতু পরিবর্তন তো স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক। তবুও সারা দেশ জুড়ে শোকের ছায়া। আবার বসন্ত ফিরবে কবে কিংবা আদৌ ফিরবে কিনা কে জানে ! সঙ্গীত জগতের জীবন্ত সরস্বতী আজ অকস্মাৎ আগামীর আরাধ্যা প্রতিমায় রুপান্তরিত হলেন। মহা প্রস্থানের পথে লে গেলেনভারতরত্নলতা মঙ্গেশকার। তাঁর প্রয়াণে শোক জ্ঞাপনের কোন বিশেষণই যেন তাঁর জন্য উপযুক্ত নয়। লতাজী ছিলেন গানের সুরে সকলকে মুখর করার শিল্পী। তাঁর মহাপ্রয়াণে শোকস্তব্ধতার চেয়ে তাঁর গানের সুরে মুখর হওয়ার মধ্যে দিয়ে তাঁকে স্মরণ করাটাই বোধ হয় যুক্তিযুক্ত।

    


আমি সত্যিই গান বুঝি না। শখে হারমোনিকা বাজানোর চেষ্টা করি। লতা মঙ্গেশকারের প্রয়াণে তাঁরই কন্ঠে গাওয়া অমর গান আকাশ প্রদীপ জ্বলে (১৯৫৫) গানটির সুর হারমোনিকায় বাজিয়ে লতাজীকে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করছি।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মুখ চাপা সত্য

 মুখ চাপা সত্য শেষ দিয়ে সত্যের শুরু  নাকি সত্যের চির সমাধি?  নাকি মুখ চাপা সত্যের গোঙানি স্পষ্ট বাক্যে শোনা যাবে একদিন?